কবি
জীবনানন্দ দাশ
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়: ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বরিশালে কবি জীবনানন্দের জন্মনয় হয়। সত্যানন্দ দাশ এবং কুসুমকুমারী দেবীর তিন সন্তানের মধ্যে জীবনানন্দ ছিলেন প্রথম।জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দেবী সাহিত্যচর্চা করতেন। বাংলার বিখ্যাত কবিতা "আমাদের দেশে হবে, সেই ছেলে কবে/কোথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে" র রচয়িতা তিনিই। কবির পৈতৃক পদবি ' দাশগুপ্ত ' ছিল , তবে তাঁর পিতামহ ' গুপ্ত ' পদবীটি বর্জন করেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দের সঙ্গে লাবণ্য গুপ্তের বিবাহ হয়।
ছাত্র - জীবন: বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে জীবনানন্দের ছাত্রজীবন শুরু হয়। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী। বইপড়া ছিল তাঁর নেশা। ১৯১৫ তে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে প্রথম বিভাগে আই এ পাস করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ বি এ পাস করেন । ১৯৯২১ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ দাশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেন এবং পাশাপাশি আইনের পাঠও শেষ করেন।
(Read in English to Klick here)
কর্ম জীবন: স্নাতকোত্তরের পরের বছরেই অর্থাৎ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর এই চাকরি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি । এরপর তিনি খুলনা বাগেরহাট কলেজে অল্প সময় এবং পরে দিল্লির রামযস কলেজে বছর খানেক অধ্যাপনা করেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বরিশালের বি এম কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন কবি । বছর দশেক পরে জীবনানন্দ কলকাতায় ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। দেশভাগ তাঁর কলকাতায় আসাকে নিশ্চিত করে। এইসময় দীর্ঘদিন তাঁকে কর্মহীন থাকতে হয়। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হলেও স্ত্রীর অসুস্থ্যতার জন্য তাঁকে সে চাকরিও ছাড়তে হয়। পরে বড়িশা কলেজে অধ্যাপনার পর হাওড়া গার্লস কলেজে তিনি পড়ানো শুরু করেন ।
সাহিত্য কর্ম: জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত কবিতা "বর্য আবাহন" । ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রম্মবাদি পত্রিকায় এটি ছাপা হয়। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দের প্রথম কাব্য গ্রন্থ "ঝরাপালক" । এরপরে ১৯৩৬ - এ প্রকাশিত হয় "ধূসর পান্ডুলিপি" । কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ "বনলতা সেন" প্রকাশিত হয় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে । এর দু - বছর পরে একে একে প্রকাশিত হয়, "মহাপৃথিবি" এবং "সাতটি তারার তিমির। কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল - "রূপসী বাংলা", "বেলা অবেলা কালবেলা", এবং এক মাত্র কাব্যগ্রন্থ - "কবিতার কথা" । পরবর্তী কালে তাঁর গল্প সংকলন জীবনানন্দ দাশের গল্প এবং "মাল্যবান ও সুতির্থ", ইত্যাদি উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে।
সম্মান ও স্বীকৃতি : রবীন্দ্র - পরবর্তী বাংলা কবিতার অন্যতম প্রতিভাশালী কবি জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় সম্মান - সমাদর পাননি। মৃত্যুর পরে ভারত সরকার তাঁকে ' সাহিত্য অ্যাকাডেমি' পুরস্কারে সম্মানিত করে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে " চিত্ররূপময়" বলে আখ্যা দেন।
জীবনাবসান: কবি জীবনানন্দের মৃত্যু ঘটে এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ২২ অক্টোবর কলকাতায় ট্রামের ধাক্কায় আহত হয়ে কবি জীবনানন্দ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কিছু কবিতা:
আকাশলীনা
সুরঞ্জনা , ওইখানে যেয়াে নাকো তুমি ,
বােলাে নাকো কথা এই যুবকের সাথে কথা ;
ফিরে এসাে সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে ;
ফিরে এসাে এই মাঠে , ঢেউয়ে ;
ফিরে এসাে হৃদয়ে আমার ;
দূর থেকে দূরে –
আরাে দূরে যুবকের সাথে তুমি যেয়াে নাকো আর ।
কী কথা তাহার সাথে ? তার সাথে !
আকাশ আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতাে তুমি আজ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে ।
সুরঞ্জনা ,
তােমার হৃদয়ে আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস ।
আকাশের ওপারে আকাশ ।
সুদর্শন
একদিন ম্লান হেসে আমি
তােমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নরকণ্ঠ দেবদারু গাছে ,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে ।
সব চেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালাে ,
তুমিও সময় স্থির নয় ,
আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে
দেখেছে সে তােমার বলয় ।
এই পৃথিবীর ভালাে পরিচিত রােদের মতন
তােমার শরীর , তুমি দান করােনি তাে ;
সময় তােমাকে সব দান করে মৃতদার বলে
সুদর্শনা , তুমি আজ মৃত ।
পৃথিবী-লোক
দুরে কাছে কেবলি নগর , ঘর ভাঙে;
গ্রামপতনের শব্দ হয় ;
মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে ,
দেয়ালে তাদের ছায়া তবু
ক্ষতি , মৃত্যু , ভয় ,
বিহুলতা বলে মনে হয় ।
এ - সব শূন্যতা ছাড়া কোনােদিকে আজ
কিছু নেই সময়ের তীরে ।
তবু ব্যর্থ মানুষের গ্লানি ভুল চিন্তা সংকল্পের
অবিরল মরুভূমি ঘিরে
বিচিত্র বৃক্ষের শব্দে স্নিগ্ধ এক দেশ ,
এ পৃথিবী , এই প্রেম , জ্ঞান , আর হৃদয়ের এই নির্দেশ ।
শিকার
ভোর ;
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মত কোমল নীল :
চারিদিকের পেয়ারা ও নােনার গাছ টিয়ার পালকের মতাে সবুজ । একটি তারা এখনও আকাশে রয়েছে :
পাড়াগার বাসরঘরে সব চেয়ে গােধূলি - মদির মেয়েটির মতাে ;
কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে - মুক্তা আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিলাে
হাজার - হাজার বছর আগে এক রাতে তেন্নি
একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনও ।
হিমের রাতে শরীর ‘ উ রাখবার জন্য দেশােয়ালীর সারারাত মাঠে আগুন জেলেছে
মােরগ ফুলের মতাে লাল আগুন ;
শুকনাে অশ্বথপতি । দুমড়ে এখন ও আগুন জ্বলছে তাদের ;
সূর্যের আলােয় তার রং কুঙ্কুমের মতাে নেই অর ;
হয়ে গেছে বােগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে ।
সকালের আলােয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ ময়ূরের
সবুজ নীল ডানার মতাে ঝিলমিল করছে ।
ভোর;
সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে - বাচিয়ে নক্ষত্রহীন , মেহগনির মতাে অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জনের বনে ঘুরে - ঘুরে
সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভােরের জন্য অপেক্ষা করছিলাে ।
বনলতা সেন
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে ,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশােকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি ; আরাে দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে ;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক , চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন ,
আমারে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা ,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ; অতিদূরে সমুদ্রের ' পর
হাল ভেঙে যে - নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি - দ্বীপের ভিতর তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে , ' এতদিন কোথায় ছিলেন
পাখির নীড়ের মতাে চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন ।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়ােজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ;
সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী ফুরায় এ - জীবনের সব লেনদেন ; থাকে শুধু অন্ধকার , মুখােমুখি বসিবার বনলতা সেন ।
No comments:
Post a Comment