জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়: আধুনিক বাংলা কবিতায় নগরজীবনের বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজের চেতনার ক্লান্তি , নৈরাশ্য আর অবক্ষয়ের নিপুণ রূপকার ছিলেন কবি সমর সেন। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক ও ইতিহাসবিদ দীনেশচন্দ্র সেনের পৌত্র সমর সেনের জন্ম ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর, কলকাতার বাগবাজারে । কবির পিতৃপুরুষের আদিবাড়ি ছিল ঢাকার মানিকগঞ্জে । পিতা অরুনচন্দ্র সেন এবং মাতা চন্দ্রমুখী দেবীর সপ্তম সন্তান ছিলেন সমর সেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল সুলেখা সেনের সঙ্গে সমর সেনের বিয়ে হয়। (You can read in English also)
ছাত্রজীবন: প্রথম জীবনে বাড়িতেই কবির লেখা পড়া শুরু হয়। বারো বছর বয়সে মা - র মৃত্যুর পরে সমর সেন কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভরতি হন । কিন্তু কবির স্কুলে উপস্থিতি ছিল খুবই অনিয়মিত । তাঁর উৎসাহ ছিল শরীরচর্চায় , প্রকৃতির সৌন্দর্য সাধনায়। কবি পারিবারিক সূত্রে নিজেকে গড়ে তোলার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছিলেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ , নজরুল, জসীমউদ্দীনের, মত কবি আব্বাসউদ্দীনের মত গায়কের সান্নিধ্যে যেমন ছিল, তেমনই ছিল বঙ্কিমবিহারী মুখোপাধ্যায়, রাধারমন মিত্রের মত রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয়ও। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিক পাস করে কবি স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। শীঘ্রই ইংরেজি সাহিত্যে কবির দক্ষতা প্রকাশ পায়। একদিকে ছিল কল্লোল, কালিকলম এর মতো পত্রিকার প্রভাব, অন্যদিকে ইয়েটস , শেক্সপিয়ারের বিভিন্ন রচনায় তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরন করতেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বি এ পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এরপর ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
সাহিত্যকর্ম: বাংলা কবিতার জগতে সমর সেন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। বিষয় নির্বাচন এবং রচনারীতির বিশিষ্টতায় খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। রোমান্টিকতাবর্জিত তীক্ষ্ণ ভাষার ব্যাবহার তাঁর কবিতাগুলোকে তিনি শতন্ত্র করে তুলেছেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহর্স পত্রিকায় সমর সেনের প্রথম কবিতা প্রকাশ পায়। এরপর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের "পূর্বাশা" এবং বুদ্ধদেব বসুর "কবিতা" পত্রিকাতেও তাঁর কবিতা প্রকাশ পায়। এই কবিতা পত্রিকাতেই সমর সেনের কবিতা পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন - "সাহিত্যে এর লেখা ট্যাঁকসই হবে বলেই বোধহচ্ছে।" ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় সমর সেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "কয়েকটি কবিতা" । ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "গ্রহন" । এর পরের বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ "নানাকথা" । এরপরে তিনপুরুস, খোলা চিঠি, ইত্যাদি কবিতার বয় প্রকাশ পাওয়ার পরে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই কবিতা লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ ক্রমশ কমে আসে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বিষ্ণু দে মশাইকে কবি লেখেন - "গদ্য কবিতা কেন, কোনো কবিতা সম্পর্কেই এখন আর উৎসাহ নেই" । ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ' জন্মদিনে ' কবিতা লেখার পর তিনি তাঁর কবি জীবনের ইতি টানেন। কবিখ্যাতির শীর্ষে থেকেও পরবর্তী প্রায় চল্লিশ বছরের জীবদ্দশাতেও তিনি তাঁর এই স্বেচ্ছা নির্বাসন বজায় রেখেছিলেন।
কর্মজীবন: ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে কাঁথি কলেজে সমর সেনের অধ্যাপনা জীবন শুরু হয়। পরে তিনি দিল্লিতে অধ্যাপনা শুরু করেন । তবে কবিতার পাশাপাশি কবি অধ্যাপনার জীবনেও স্বেচ্ছায় ইতি টানেন। অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে তিনি সংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করেছিলেন । "অল ইন্ডিয়া রেডিও, দ্য স্টেটসম্যান " এ সম্পাদনার কাজে যোগ দেন তিনি। এরপর ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে অনুবাদকের চাকরি নিয়ে তিনি মস্কোয় যান। চার বছর পরে ফিরে এসে যোগ দেন "হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড" পত্রিকায় । এরপরে প্রথম "নাউ" ও পরে "ফ্রন্টিয়ার" পত্রিকায় তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। নির্ভীক কবি সমর সেন সশস্ত্র বিপ্লববাদের সমর্থনে এই সাময়িক পত্রে লিখে গিয়েছেন। (Read in English)
জীবনাবসান: "ফ্রন্টিয়ার" এর সম্পাদক থাকাকালীনই ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট সমর সেন প্রয়াত হন। গোষ্ঠী এবং দলীয় রাজনীতির বাইরে জাগ্রত মুক্তকণ্ঠ, প্রতিবাদী , স্বাধীন, বিবেকের অন্য নাম ছিল সমর সেন।
নিঃশব্দতার ছন্দ
স্তন্ধরাত্রে কেন তুমি বাইরে যাও ?
আকাশে চাঁদ নেই , আকাশ অন্ধকার ,
বিশাল অন্ধকারে শুধু একটি তারা কাপে ,
হাওয়ায় কাপে শুধু একটি তারা ।
কেন তুমি বাইরে যাও শুন্ধরাত্রে
আমাকে একলা ফেলে ?
কেন তুমি চেয়ে থাক ভাষাহীন , নিঃশব্দ পাথরের মতাে ;
আকাশে চাঁদ নেই , আকাশ অন্ধকার ,
বাতাসে গাছের পাতা নড়ে ,
আর দেবদারুগাছের পিছনে তারাটি কাঁপে আর কাপে ;
আমাকে কেন ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত হতে বিরহের স্তব্ধতায় ?
মাঝে মাঝে চকিতে যেন অনুভব করি
তােমার নিঃশব্দতার ছন্দ ;
সহসা বুঝিতে পারি
দিনের পরে কেন রাত আসে
আর তারারা কাঁপে আপন মনে ,
কেন অন্ধকারে
মাটির পৃথিবীতে আসে সবুজ প্রাণ ;
চপল , তীব্র , নিঃশব্দ প্রাণ
বুঝতে পারি কেন
স্তব্ধ অর্ধরাত্রে আমাকে তুমি ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত থেকে বিরহের স্তব্ধতায় ।
পাঁচমিশালি
বাস্ থেকে দেখি বিরস গাছ ,
কিন্তু কি সবুজ ঘাস !
ডিজে তেলের পােড়াটে স্বাদ ।
খালি মনে পড়ে তােমার ঠাণ্ডা হাত ,
গুমােট গরমে পান্তা ভাত ,
লঙ্কা , কাসুন্দা , পেঁয়াজ ;
বারে বারে বেহাত হওয়া কি তােমার রেওয়াজ ?
কারাে কারাে চোখে দেখি
আলাের কুহেলিকা ,
ভুরুর রেখা
নদীর ওপারে বলাকা ,
দেহ - মদির কবিতা
খোয়ারির জােরে লেখা ।
ফিকে জোৎস্না ছড়ায়
জোলাে , বাসি দুধের রং ।
কাকেরা ফিরেছে বর্ষার গাছে
মেয়েটি ভিজে ফুটপাথে ;
জণসার শিশু তার পাশে
হয়ত দুধের স্বপ্ন দেখে হাসে ।
ট্রেনের না স্টীমারের গুমােট ডাকে
যশােদা - পৃথিবীর আবেশ কাটে
No comments:
Post a Comment