রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলাদেশের শিল্প - সংস্কৃতিতে শ্রেষ্ঠ বহুমুখী প্রতিভা সত্যজিৎ রায় । চলচ্চিত্র থেকে সাহিত্য কিংবা ছবি আঁকা — সত্যজিত রায়ের প্রতিভার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে সর্বত্র ।
ব্যক্তিগত জীবন ও শিক্ষাঃ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২ মে উত্তর কলকাতার বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারে সত্যজিত রায়ের জন্ম হয় । তাঁর পিতা ছিলেন বাংলাদেশের আর - এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা সুকুমার রায় । পিতামহ শিশুসাহিত্য ও সামাজিক - ধর্মীয় আন্দোলনের আরেক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব উপেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী । সত্যজিত রায়ের মা ছিলেন সুপ্রভা দেবী । বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে তাৰ্থনীতিতে ভরতি হন । তারপরে তিনি শান্তিনিকেতনে যান এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পচর্চার পাঠ নেন ।
কর্মজীবনেঃ শান্তিনিকেতনের পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই সত্যজিৎ কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারে মাত্র ৮০ টাকা বেতনের চাকরিতে যােগ দেন ‘ জুনিয়র ভিশুয়ালাইজার পদে । ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎ রায় বিখ্যাত ‘ সিগনেট প্রেস ’ - এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং প্রচ্ছদ শিল্পকে এক অনন্য উন্নতায় নিয়ে যান ।
চলচ্চিত্রে সত্যজিৎঃ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎ চিদানন্দ দাশগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে কলকাতা ফিল্ম সােসাইটি স্থাপন করেন । ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পায় তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘ পথের পাঁচালি ' — যা বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার গতিপথকেই পালটে দেয় । এই সিনেমার ফটোগ্রাফি এক নতুন চিত্রভাষার জন্ম দিল । ১৯৫৭ র ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হল “ পথের পাচালি । এরপর ‘ অপরাজিত ’ ও ‘ অপুর সংসার নির্মাণ করে ট্রিলজিকে সম্পূর্ণতা দেন সত্যজিৎ রায় । এর মধ্যেই তৈরি করেন ‘ পরশপাথর ' — নিম্নমধ্যবিত্তের স্বপ্নপূরণের ফ্যান্টাসি এবং জলসাঘর' পতনােন্মুখ সামন্ততন্ত্রের এক নিঃস্ব জমিদারের কাহিনি । বিষয়বৈচিত্র্যে সত্যজিত রায়ের সিনেমা অনবদ্য । রবীন্দ্রনাথের ' নষ্টনীড় ' নিয়ে তিনি যেমন বানিয়েছেন ‘ চারুলতা ’ , আবার সমাজের নানা আবর্তকেও তুলে এনেছেন ‘ সীমাবদ্ধ ’ , কাপুরুষ ও মহাপুরুষ ’ , ‘ জন অরণ্য ' এইসব সিনেমায় । গুণী গাইন বাঘা বাইন ’ , ‘ হীরক রাজার দেশে ’ এইসব সিনেমায় আপাত হাসির আড়ালে গভীরতর সমাজভাবনাকে অনবদ্য শিল্পকৌশলে রূপ দিয়েছেন সত্যজিৎ রায় । আবার ‘ সােনার কেল্লা ' , জয়বাবা ফেলুনাথ ’ - এর মতাে গােয়েন্দা কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্রও তিনি তৈরি করেছেন । শেষপর্বে ‘ আগন্তুক ’ বা ‘ শাখাপ্রশাখায় এক নতুন জীবনদর্শনের খোঁজ করেছেন সত্যজিৎ রায় , দেখিয়েছেন প্রজন্মের ব্যবধান ।
সাহিত্যকর্মঃ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় দুটি চরিত্র ফেলুদা এবং প্রােফেসর শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যজিৎ । এ ছাড়াও সত্যজিৎ নিজের ছেলেবেলার কাহিনি নিয়ে লিখেছেন— “ যখন ছােট ছিলাম । চলচ্চিত্র নিয়ে তার প্রবন্ধ সংকলনগুলাে হল- Our films , Their films ' , ‘ বিষয় চলচ্চিত্র ইত্যাদি ।
পুরস্কার ও সম্পাদনাঃ সত্যজিৎ এমন এক চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট দেন । ১৯৮৫ - তে তিনি পেয়েছিলেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার । ১৯৮৭ - তে ফ্রান্সের সরকার সে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ‘ লিজিয়ন দ্য অনার ’ - এ সম্মানিত করে তাঁকে । ভারত সরকার তাকে দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ' ভারতরত্ন ।
বিশ্বের দরবারে ভারতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি সত্যজিৎ রায় । বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরােসাওয়া তার সম্পর্কে বলেছেন— “ সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে সূর্য দেখা একই কথা । ”
মৃত্যুঃ ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় প্রয়াত হন ।
No comments:
Post a Comment