মহাশ্বেতা দেবী জীবনী/Life Story Of Mahasweta Devi - Psycho Principal

Fresh Topics

Monday, 6 September 2021

মহাশ্বেতা দেবী জীবনী/Life Story Of Mahasweta Devi

মহাশ্বেতা 
দেবী


 

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়ঃ প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা শহরে । তার বাবা ছিলেন ‘ যুবনাশ্ব ' ছদ্মনাম গ্রহণকারী বিশিষ্ট কবি এবং স্বনামধন্য গদ্যকার মনীশ ঘটক , মা ধরিত্রী দেবী । বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক ছিলেন মহাশ্বেতা দেবীর কাকা । ' নবান্ন ' - খ্যাত , প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর বিবাহ হয় । সাহিত্যিক - সাংবাদিক নবারুণ ভট্টাচার্য তাদের একমাত্র সন্তান ।

শিক্ষাজীবনঃ মহাশ্বেতা দেবীর শিক্ষা শুরু হয় রাজশাহিতে । পরবর্তীকালে কলকাতার আশুতােষ কলেজ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশােনা করেন । তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন । কমঞ্জিীবন , কর্মজীবনে নানাপ্রকার পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি । স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন , কলেজে অধ্যাপনা করেছেন , পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন । সাংবাদিক জীবনে তিনি যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সাহিত্যরচনাই তার একমাত্র পেশা হয়ে  দাঁড়ায় ।

সমাজসেবা ও রাজনীতি্ঃ মহাশ্বেতা দেবী সমাজসেবী এবং রাজনীতিবিদ হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন । বাবা ও কাকার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি যৌবন থেকেই বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন । বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তার রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামেগঞ্জে । শবর , খেড়িয়া ইত্যাদি অরণ্যচারী উপজাতির উন্নয়নে তিনি নিজেকে সঁপে দেন । ভারতের বিভিন্ন উপজাতি অধুষিত অঞ্চলেও তার কর্মধারা প্রসারিত হয়েছে । তার সাহিত্যকর্মে সমাজসেবা এবং রাজনীতির এই বিপুল অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ।

সাহিত্যকর্মঃ মহাশ্বেতা দেবীর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ইতিহাসনির্ভর জীবনী বাসীর রাণী ( ১৯৫৬ ) । তাঁর প্রথম উপন্যাস নটী ( ১৯৫৭ ) । তার অন্যান্য উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি হল মধুর প্রেম , রুদালি , প্রেমতারা , বায়ােস্কোপের বাক্স , আঁধারমানিক , কবি বন্দ্যঘটী গাঞ্জির জীবন ও মৃত্যু , হাজার চুরাশির মা , অরণ্যের অধিকার , চোট্টি মুণ্ডা ও তার তীর , বিশ - একুশ , ব্যাধখণ্ড , গণেশ মহিমা , সিধু - কানুর ডাকে , নৈঋতে মেঘ , বীরসা মুণ্ডা , স্তন্যদায়িনীও অন্যান্য গল্প ইত্যাদি । তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিতে সমাজের তথাকথিত নিম্নবিত্ত ও নিম্নবর্গের মানুষের জীবনযাপন এবং তাদের আশা , হতাশা , স্বপ্ন , সংগ্রামের সংবেদনশীল এবং প্রতিবাদী রূপ উঠে এসেছে । তিনি যেমন আদিবাসী এবং সমাজের অন্যান্য সর্বহারা মানুষের জীবনের উন্নয়নে ব্রতী হয়েছেন , তেমনই তাদের জীবনকথা নিয়েই তিনি বহু শিল্পসার্থক ছােটোগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন । মহাশ্বেতা দেবী বর্তিকা নামক একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন ।

সম্মান ও স্বীকৃতিঃ মহাশ্বেতা দেবী তার নিরলস সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যসাধনার জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন । তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানপীঠ ’ , ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ’ - এ , ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ম্যাগসেসে পুরস্কার ’ - এ এবং ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ পদ্মবিভূষণ ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন । এ ছাড়াও তিনি ‘ পদ্মশ্রী ’ , ‘ দেশিকোত্তম ’ প্রভৃতি উপাধি লাভ করেছেন । তবে নিছক পুরস্কারপ্রাপ্তির মানদণ্ডেই তার কর্মময় জীবন এবং সৃজনশীল অবদানের মূল্যায়ন করা যায় না ।

জীবনাবসানঃ ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে এই মহান সাহিত্যপ্রতিভার জীবনাবসান হয় ।


 

প্রথম অধ্যায় 

মহাশ্বেতা দেবীর ব্যক্তি পরিচয় ও সাহিত্য পরিচয় 

গল্প বলা বা গল্প শােনার আগ্রহ মানুষের চিরকালের । আর এই গল্প বলতে বলতে গল্পকার হয়ে ওঠা খুব কম সংখ্যক মানুষের পক্ষেই সম্ভব । কিন্তু মহাশ্বেতাকে বিধাতা যেন গড়েছিলেন অন্য ধাতু দিয়ে । মণীশ ঘটক এবং ধরিত্রী দেবীর ন'জন সন্তানের মধ্যে মহাশ্বেতা প্রথম । অনেকগুলি ছােট ছােট ভাইবােন থাকার ফলে মহাশ্বেতা শুরু থেকেই দায়িত্ব সচেতন ছিলেন । ছােট ছােট ভাইবােনদের ছােটখাটো বিষয়ে খেয়াল রাখার পাশাপাশি তাদের মানসিক বিকাশের প্রতিও তীক্ষ নজর ছিল । তার অনুজ বােন সােমা মুখােপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায় মহাশ্বেতার ভাইবােনের প্রতি আচরণ সবই ‘ শিক্ষামূলক ’ ছিল । সুতরাং মহাশ্বেতার গল্পকার হয়ে ওঠার পেছনে গল্প বলার গুণটি বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল , একথা বলাই বাহুল্য । আসলে ‘ আধুনিকতার নামে বাংলার সাহিত্যকোষ যখন মেঘ - সূর্যের লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত , তখন রামধনু ‘ উঠি উঠি’র মত উদিত হচ্ছেন মহাশ্বেতা ‘ ছন্দ ছাড়া’র হাত ধরে । ছেলেবেলাকার বন্ধু রাজলক্ষ্মীকে সঙ্গে নিয়ে ‘ ছন্দ - ছাড়া ’ পত্রিকার যাত্রা । শুরু । বেলতলা গালর্সের অষ্টম শ্রেণীর দুই ছাত্রীর দু’জনেই যুগ্ম সম্পাদিকা হন ১৯৩৯ সালে । ত্রয়ােদশী মহাশ্বেতা হাতে লেখা পত্রিকাটির প্রতি ভীষণভাবে যেন দায়বদ্ধ ছিলেন । তাই স্বনামে - বেনামে গল্প - কবিতা - ছড়ার যােগান দিচ্ছিলেন পত্রিকার উদরপূর্তির জন্য । রাজলক্ষ্মী দেবীর সেই ছন্দ - ছাড়া ’ যুগ থেকে জানা যায়— “ ছন্দ - ছাড়া নিয়ে মেতে গিয়েছিলাম আমরা । লেখক বলতে তাে দুই সম্পাদিকা । ... ছন্দ - ছাড়ার আরেক নিয়মিত লেখক ছিলেন সুধীরা সেনগুপ্ত— আমি পরিচয় দিতাম ‘ সুধীরাদি ’ বলে । ভালাে ভালাে লেখা আমার মারফৎ তিনি পাঠাতেন ‘ ছন্দ - ছাড়ার’দফতরে । মহাশ্বেতার লেখার প্রশংসাও আমি বয়ে নিয়ে যেতাম তার কাছ থেকে । মহাশ্বেতা তাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত । ” সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে , কিশােরী মহাশ্বেতার মধ্যে যে সাহিত্যবীজ শুধু অঙ্কুরিত হয়েছিল তা নয় , প্রকৃত সাহিত্যগুণ ও শিল্পগুণেরও প্রস্ফুটন শুরু হয়েছিল । প্রকৃত শিল্পীই যে আরেকজন শিল্পীর কদর বােঝেন তা বােঝা যায় এ লেখা থেকে । মহাশ্বেতার মধ্যে যে শুধু সম্ভাবনা ছিল তাই নয় , ছিল ভালাে লেখক হয়ে ওঠার প্রকৃত গুণাবলী । তাই অপরিচিত কারাে ভালাে লেখা দেখে ঈর্ষা নয় , বরং তাকে চোখের দেখা দেখার জন্য আকুলতা- মহৎ লেখকের পক্ষেই তা সম্ভব । আর এ সম্ভাবনাই আজকের মহাশ্বেতা ।

মহাশ্বেতা একদিনে মহাশ্বেতা হয়ে ওঠেননি । বরং মহাশ্বেতা ঘটক থেকে আজকের সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী হয়ে ওঠার এই যাত্ৰপথ যত না দীর্ঘ তার চেয়েও বেশি বৈচিত্র্যময় । বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে স্বাতন্ত্রের অধিকারী মহাশ্বেতা অধুনা বাংলাদেশের এক খ্যাতনামা পরিবারে ১৯২৬ সালে ১৪ ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন । পিতা মণীশ ঘটক এবং কাকা ঋত্বিক ঘটক এদেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতের সর্বজন স্বীকৃত নাম । মহাশ্বেতা দেবীর পিতা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক । ‘ যুবনাশ্ব ’ ছদ্মনামেই তিনি সমধিক পরিচিত । বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার নতুন ভারেঙ্গা গ্রামে ছিল তার পৈতৃক নিবাস । পিতা সুরেশচন্দ্র ঘটক ছিলেন ডেপুটি এবং পরে ম্যাজিস্ট্রেট । ফলে পিতার কর্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের অনেক জায়গায় কাটাতে হয়েছিল মণীশ ঘটককে । কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মণীশ ঘটক আয়কর উপদেষ্টা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন । ১৯২৪ সালে তিনি গল্পকার হিসেবে সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন । তাঁর রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ শিলালিপি । কল্লোল যুগের কবি , সাহিত্যিকেরা যে বাস্তবতাবােধের প্রতিফলন তাদের সাহিত্যে দেখাতে চেয়েছিলেন মণীশ ঘটক তাদের অন্যতম । তাঁর রচিত ‘ পটলডাঙ্গার পাঁচালী ’ কল্লোলযুগের বাস্তবতার এক বিশ্বস্ত দলিল । এছাড়াও তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল— ‘ সন্ধ্যা ’ , ‘ বিদুষী বাক্‌ ’ , ‘ কনখল ’ , ‘ মান্ধাতার বাবার আমল ’ ( আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ) , একচক্রা প্রভৃতি । এছাড়া পাবলাে নেরুদার কবিতা অনুবাদ করেছিলেন । মণীশ ঘটক পত্রিকা পরিচালনাতেও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন । বহরমপুর থেকে তিনি বর্তিকা ’ নামে একটি পত্রিকা আমৃত্যু সম্পাদনা করেছেন । এছাড়া ঢাকা থেকে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্তের সম্পাদিত ' প্রগতি ’ ( ১৯২৭ ) পত্রিকারও একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন । সুতরাং বলা যেতেই পারে যে পিতার এই বহুমুখী প্রতিভা মহাশ্বেতা দেবীকে প্রাণিত করেছিল । পিতার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি যুগান্তর পত্রিকায় ( ১৫ ই এপ্রিল , ১৯৮৩ ) ‘ পয়লা বৈশাখ ' নামে একটি প্রবন্ধে বলেছেন “ কল্লোলের যুবনাশ্ব এবং কিংবদন্তীস্বরূপ মণীষ ঘটক , বাবা হিসেবে খুব অদ্ভুত ছিলেন । আমাকে উনিচারের দশকে সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন , বহরমপুরেআমার পাশে সাইকেল চড়ে নিজেও বেড়াতেন । আমার সেজবােন অপালা সাইকেল চড়ত এবং ভয়ঙ্কর বকুনি খেত । দুর্ভিক্ষের কাজে বা কিশাের বাহিনীর জন্য আমি হরদম ঘুরতাম , সে ঠিক আছে । কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্য করছি জানলে বাবা গর্জন করবেন । ”
মহাশ্বেতা দেবী রংসাবানের ব্যবসা করে সাবলম্বী হতে চেয়েছিলেন । সে কারণে বাবাকে । লুকিয়ে কাদম্বিনী দেবী ’ ছদ্মনামে খেলাচ্ছলে ব্যবসা শুরু করেছিলেন , কিন্তু ছ'ফুট চার ইঞ্চির পিতামণীশ ঘটক জানতে পেরে এমন ভাবে মেয়ে মহাশ্বেতার দিকে তাকালেন যে মেয়েকে সেদিনই সে ব্যবসায় ইতি টানতে হয়েছিল । বাংলা চলচ্চিত্র জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ঋত্বিক ঘটক ছিলেন সুরেশ চন্দ্র ঘটক এবং ইন্দুবালা দেবীর আর এক কৃতী সন্তান । ঋত্বিক ঘটক বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা শহরে ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় , মৃণাল সেনের সঙ্গে এক সঙ্গে উচ্চারিত হয় ঋত্বিক ঘটকের নাম ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র পরিচালনায় তিনি যেমন প্রশংসিত হয়েছিলেন তেমনি ছিলেন বিতর্কিত । প্রথম জীবনে তিনি নাটক লিখতেন , পরিচালনা করতেন এবং অভিনয়ও করতেন । তার রচিত প্রথম নাটক ‘ কালােসায়র ’ ( ১৯৪৮ ) । ১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে ( IPTA ) যােগদান করেন । বের্টোল্ট ব্রেষ্ট এবং নিকোলাই গােগােলের রচনাবলী বাংলায় অনুবাদ করেন । চলচ্চিত্রজগতে তার যাত্রা শুরু হয় নিমাই ঘােষের ছিন্নমূল ’ ( ১৯৫১ ) সিনেমার মধ্য দিয়ে । সেখানে তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন । এরপর ১৯৫৩ সালে এককভাবে পরিচালনা করেন ‘ নাগরিক ’ এরপর এক এক করে মুক্তি পায় তার উল্লেখযােগ্য চলচ্চিত্রগুলাে — ‘ মেঘে ঢাকা তারা ' ( ১৯৫০ ) , ‘ কোমল গান্ধার ’ ( ১৯৫১ ) , সুবর্ণরেখা ’ ( ১৯৫২ ) । এই তিনটি চলচ্চিত্রকে ট্রিলজি বা ত্রয়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় । সত্তরের দশকে মুক্তি পায় ‘ তিতাস একটি নদীর নাম ' ছবিটি । বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে গিয়ে তিনি ছবিটি পরিচালনা করেন । তাঁর শেষ চলচ্চিত্রটি হল ‘ যুক্তি , তক্কো আর গল্পো ( ১৯৭৪ ) ; নিয়মিত মদ্যপান এবং বােহিমিয়ান জীবন যাপনের জন্য তাঁর পক্ষে আর কাজ করে যাওয়া সম্ভব ছিল না।‘পদ্মশ্রী সম্মান প্রাপ্ত খ্যাতিমান এই পরিচালকের জীবনাবসান ঘটে ১৯৭৬ সালের ৬ ই ফেব্রুয়ারি । মাতা ধরিত্রী দেবীও যে শুধু সাহিত্যানুরাগী ছিলেন তাই নয় , তিনি নিজেও একসময় সাহিত্যচর্চা করতেন । সাহিত্য সাধনার এই পর্বে তিনি পার্লার্কের বই অনুবাদ করেছেন । সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি তিনি সমাজ সেবাও করতেন । মায়ের এই গুণটিই সম্ভবত মহাশ্বেতার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল । মহাশ্বেতা দেবীর মাতামহীও ছিলেন বিদূষী মহিলা । সে সম্পর্কে মহাশ্বেতা দেবী যুগান্তর পত্রিকায় ( ১৫ এপ্রিল , ১৯৮৩ ) স্মৃতিচারণ করেছেন-----“ আমার মাতামহী কিরণময়ী দেবী মহিলা না হলে , তখনকার সমাজে বিদ্বান ও মনস্বী বলে যশ পেতেন , তাতে আমার সন্দেহ নেই । যেমন ছিল , তার বাংলা বই - এর সংগ্রহ , তেমনি ছিল পড়াশােনা । অনেক বয়সে ইংরেজি শিখে ইংরেজি বইও কম পড়েননি । ” মণীশ ঘটক এবং ধরিত্রী দেবীর নয়জন সন্তানের মধ্যে মহাশ্বেতা ছিলেন সবার বড় । অন্য ভাই - বােনেরা হলেন শাশ্বতী ( ১৯২৯-১৯৯৫ ) অনীশ ( ১৯৩০-১৯৪৮ ) অবলােকিতেশ ( ১৯৩৩-১৯৭৩ ) অপালা ( ১৯৩৫ ) সমীশ ( ১৯৩৮ ) মৈত্রেয় ( ১৯৪১ ) সােমা ( ১৯৪২ ) শারী ( ১৯৪৫ ) । ছােট ছােট ভাই বােনেদের প্রতি মহাশ্বেতা ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্ব সচেতন । ভাইবােনেদের ছােটখাটো বিষয়ে খেয়াল রাখার পাশাপাশি তাদের মানসিক বিকাশের প্রতিও তীক্ষ্ণ নজর ছিল । অনুজ বােন সােমা মুখােপাধ্যায় দিদির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘ কোরক ’ পত্রিকার ‘ মহাশ্বেতা বিশেষ সংখ্যায় ‘ আমার দিদি মহাশ্বেতা ' প্রবন্ধে বলেছেন “ দিদির সব কিছুই ছিল মজবুত , কাজের শক্তপােক্ত । যাতে জীবনটা শৃঙ্খলায় মােড়কে বেশ আঁটসাট থাকে । সবই শিক্ষামূলক হবে ।... একটা জিনিস দিদির জীবনে বারবার দেখেছি— জীবন যখন সব থেকে অকরুণ বা সহস্র কণ্ঠময় , স্থায়ী সুখ শান্তি যখন বারবার বিঘ্নিত তখনই দিদিমনের গভীরে স্থির , অচঞ্চল । পরবর্তী বই - এর জন্য হয়তাে বা ইতিহাস , ভূগােল , সেনসাস রিপাের্ট বা ভূমিরাজস্ব সংক্রান্ত কাগজপত্র তন্ন তন্ন করে পড়ছে তখন লেখা হচ্ছে , ‘ আঁধার মানিক ’ ‘ কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু ’ বা ‘ অপারেশন বসাই টুডু ’ , ‘ স্তনদায়িনী ’ বা ‘ এইচ.এফ. ৩৭ : একটি রিপাের্টিজ ’ - এর মতাে গল্প । জীবন ও লেখাকে একাকার করে দেওয়ার শুরু সত্তরের দশকের শেষের দিকে । অনেক কঠিন কাজ , চিরকালই দেখেছি , অনেক সহজেকরে ফেলা ওর অভ্যাস ছিল । আর কাজ ছাড়া ও থাকতেই পারেনা মােটে । ”
এই প্রবন্ধ থেকেই আরও জানা যায় , গল্প বলার একটা চমক্কার ক্ষমতা ছিল মহাশ্বেতার । সেই সঙ্গে ছিল মনে রাখার ক্ষমতা । মহাশ্বেতা তাদের পারিবারিক আত্মীয় স্বজনদের বহু পুরােনাে স্মৃতি অনায়াসে মনে করতে পারতেন । যে কোন বই - ও মহাশ্বেতা খুব সহজেই পড়ে ফেলতেন যে , মাঝে মাঝে মনে হত তিনি সত্যিই পড়েন কিনা । অজিত চক্রবর্তী ( মহাশ্বেতার মামা ) একবার পরীক্ষা নিয়েছিলেন মহাশ্বেতার , বলা বাহুল্য মহাশ্বেতা সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সসম্মানে । মহাশ্বেতার আরও একটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন সােমা মুখােপাধ্যায় । মানুষজনের কাছে পৌঁছানাের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল মহাশ্বেতার । মনীশ ঘটক যখন কর্মসূত্রে রংপুরে থাকতেন তখন কিশােরী মহাশ্বেতা একটি সাইকেল নিয়ে গােটা শহর চষে বেড়াতেন । আর বাজারে লােকজনদের কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের গল্প শুনতেন । অর্থাৎ ভালাে গল্পকারের একটি প্রকৃত গুণ হল ভালাে শ্রোতা হওয়া , তা মহাশ্বেতা অতি অল্পবয়সেই রপ্ত করেছিলেন । পরবর্তীকালে মহাশ্বেতা যে ' Voiceless section of Indian Society ' র কথা বলেছেন তাও সম্ভব হয়েছিল মহাশ্বেতার এই গুণের জন্য । যে আদিবাসী সমাজ ও চরিত্র মহাশ্বেতার উপন্যাসের বিষয় হয়েছে , তাদের সম্পর্কে জানতে মহাশ্বেতা চলে গেছেন তাদের জীবনের কাছাকাছি । তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উপলব্ধি করেছেন তাদের সুখ - দুঃখ - আনন্দ - বেদনা । দিনের পর দিন কাটিয়েছেন খেড়িয়া , শবর প্রমুখ মানুষজনের সঙ্গে , তাদের একজন হয়ে তাই মহাশ্বেতা যখন এই আদিবাসী সমাজের কথা বলেন তা এক জীবন্ত দলিল হিসেবেই পাঠকের কাছে ধরা দেয় ।। মহাশ্বেতার লেখায় যেমন ভিড় করে এসেছেন বিচিত্র সব মানুষেরা , তাদের বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে , তেমনি মহাশ্বেতার উত্থানও ঘটেছেব্যক্তিজীবনের নানা ঘাত - প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে । যেহেতু মহাশ্বেতার জন্ম বাংলাদেশে , তাই প্রাথমিক শিক্ষার শুরুও হয়েছিল সেখানে । প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ মায়ের কাছে সমাপ্ত করে ১৯৩০ সালে ঢাকার ইডেন স্কুলের মন্টেসরি বিভাগে স্বল্প দিনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নেন । এরপরে চলে আসেন এপার বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে । মেদিনীপুরের মিশন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন । এরপর ১৯৩৫ সালে তিনি ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে । ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি সেখানে লেখাপড়া করেন । সেদিনের শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় ও শিক্ষাভবন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিল । শৈশবের শান্তিনিকেতন ছিল মহাশ্বেতা দেবীর কাছে স্বর্গ । শৈশবের শান্তিনিকেতন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছেন এবং শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসতে হয়েছিল বলে যে তিনি যথেষ্ট বেদনাতুর হয়েছিলেন তারও স্পষ্ট উল্লেখ আছে স্মৃতিচারণায়— “ স্কুল জীবনে শান্তিনিকেতন ছাড়ব সে তাে কোনদিন ভাবিনি । শান্তিনিকেতন
মানে ভারি মজা । খুবশৃঙ্খলার মধ্যে লেখাপড়া করিয়ে নিচ্ছে শান্তিনিকেতন , কিন্তু কোন কষ্ট নেই । তার মধ্যেই কত যে স্বাধীনতা । মস্ত জগৎ বন্ধুদের নিয়ে । গাছে । চড়ে , সাঁতার কাটো , যথেচ্ছ ফল পেড়ে খাও , হকি খেলাে , তাছাড়া নাচ - গান - ছবি তাে জীবনের অঙ্গ । বলতে নেই , পড়াশােনাতেও মন ছিল তখন , পরে আর ছিল । শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে হবে , কখনাে ভাবিনি । ... ১৯৩৮ সালের শেষে ক্লাস এইটে উঠব । তার অনেক আগে থেকেই ছােটমামা শঙ্খ চৌধুরি ওখানে কলেজে ছাত্র । কলাভবনেও যান । ১৯৩৭ সালে ছােটমাসি স্বপ্নময়ী আরসিন্ধু - সুন্দরী বিষ্ণি জগাশি , সঙ্গীত ভবনের স্কলারশিপ নিয়ে ওখানে গেছেন । ১৯৩৮ সালে পৌষমেলা যে কয়েক বছরের মত শেষ পৌষমেলা তাও জানি না । আট আনা , চার আনা ইত্যাদি মেলা খরচা নিয়েই মহানন্দে দিন কাটছে । বিশ্বভারতীতে ঢােকার পুরনাে যে লােহার গেট , সেখান থেকে রতনকুঠি অবধি যে পথ , তার দু'পাশ তখন ধূধূফাকা । সে পথের দু'ধারেই বসে মেলা । মেলাতে একটা ছড়ি কিনে নাগরদোলা চড়ছি , বড়দের দেখলেই ‘ খাওয়াও না বলে ঝুলে পড়ছি , রাতে বাউল গান শােনার প্রলােভনও খুব , তবে সে জন্যে ছােটদের হস্টেলে অনুমতি নিতে হতাে । ১৯৩৯ সালে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন বেলতলা বালিকা বিদ্যালয়ে । সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন । ১৯৪৪ সালে আশুতােষ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মহাশ্বেতা আবার ফিরে যান শান্তিনিকেতনে । সেখান থেকে ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি.এ পাশ করেন , ১৯৪৬ সালে । এর প্রায় সতেরাে বছর পরে তিনি প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেন । এর আগেই তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রথিতযশা কথাশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন । এম.এ পাশ করার আগেই মহাশ্বেতা প্রবেশ করেন পেশাগত জীবনে । ১৯৪৮-৪৯ সালেই তিনি কলকাতার ‘ পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশনে’র প্রাতঃবিভাগে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন । এরপর ১৯৪৯-৫১ এই সময়কালে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের ডেপুটি অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল পােস্ট অ্যাণ্ড টেলিগ্রাফ ( ডি.এ.জি.পি.টি ) অফিসে আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন । কিন্তু রাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকার মিথ্যা অপবাদে সেখান থেকে বরখাস্ত করা হয় । যদিও এই ভ্রান্ত ধারণার প্রতিবাদ করে তিনি পুনর্বহাল হলেন কিন্তু কিছুদিন পর অস্থায়ী বাড়তি কর্মী বলে তাকে আবার চাকরি খােয়াতে হয় । জীবিকার সন্ধানে মহাশ্বেতাকে বহু বিচিত্র কাজের সম্মুখীন হতে হয়েছে ।
কাপড় - কাচার সাবান বিক্রি , কাপড় রং করার সরঞ্জাম বিক্রির পাশাপাশি আমেরিকাতে বাঁদর চালান দেওয়ার জন্য টেন্ডার পাওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে হয়েছে । ব্যক্তি জীবনে এই সংগ্রাম ও সংঘাত পরবর্তীকালে সাহিত্যিক মহাশ্বেতাকে লেখার জগতে সংগ্রামী করে তুলেছিল । সেই সঙ্গে একাত্ম করেছে সংগ্রামী মানসিকতার মানুষের সঙ্গে । সে কারণেই হয়তাে প্রথম গ্রন্থের বিষয় নির্বাচিত হয় ‘ ঝাসির রাণী লক্ষ্মী বাঈ ’ - এর অদম্য লড়াই - এর কথা । ব্যক্তিজীবনে সংগ্রামের সূত্র ধরেই হয়তাে মহাশ্বেতা পিছন ফিরে তাকিয়েছেন । পৌছানের ইতিহাসেও প্রত্যক্ষ করেছেন সেই সংগ্রামী মানসিকতা । সংগ্রামমুখর মানসিকতার প্রকাশ ঘটলাে ১৯৫৬ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থকঁসির রানিতে লেখক হিসেবে মহাশ্বেতার আত্মপ্রকাশ ঘটলেও জীবিকার সন্ধান ছিল অব্যাহত । এরপর ১৮৫৭ সালে রমেশ মিত্র বালিকা বিদ্যালয়ে একবছর শিক্ষকতা করেন । যদিও ‘ ঝাঁসির রাণি ’ রচনার পর থেকে বই লিখে অর্থোপার্জন শুরু হয়েছিল । বই লেখার পাশাপাশি শিক্ষকতার কাজ চলেছিল । সমান্তরালভাবে । ১৯৬৪ সালে বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে যােগ দেন এবং দীর্ঘ ২০ বছর অধ্যাপনার কাজ করে ১৯৮৪ তে স্বেচ্ছাবসর নেন । পেশাগত জীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর মহাশ্বেতা সাহিত্যকর্মে পুরােপুরি মনােনিবেশ করেন । একের পর এক প্রকাশ হতে থাকে তার অবিস্মরণীয় সব লেখাগুলি । মহাশ্বেতার লেখালেখির সূচনা পঞ্চাশের দশকে । যদিও লেখালেখির যাত্রা শুরু এর অনেক আগে থেকেই । খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত রংমশাল ’ পত্রিকার হাত ধরে সাহিত্য ক্ষেত্রে মহাশ্বেতার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে । এই আত্মপ্রকাশের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথ কেন্দ্রিক আলােচনা ‘ ছেলেবেলা ' । এরপরেও বেশ কিছুদিন লেখালেখির সূত্র ধরে তিনি যুক্ত ছিলেন পত্রিকাটির সঙ্গে । সাহিত্য জীবনের প্রথম পর্বে তিনি ‘ সুমিত্রা দেবী ’ ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেছিলেন । রংমশাল পত্রিকার পর ১৯৪৮-৪৯ এ সুমিত্রা দেবী ছদ্মনামেই ‘ সচিত্র ভারত ’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন । ছােটদের জন্য এ সময় মৌচাকে লিখেছেন ‘ আলাে হাতে । এর প্রায় বেশ কিছুদিন পরে ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় মহাশ্বেতার প্রথম গ্রন্থ ‘ ঝাঁসির রানি ’ । ঝাসির রানি ’ উপন্যাস নয় , বরং এক সংগ্রামী এক নারীর জীবন ইতিহাস । সে ইতিহাস সংগ্রহের সূচনা হয়েছিল মামা শচীন চৌধুরীর লাইব্রেরী থেকে । পরে তা মহারাষ্ট্র , আমেদাবাদ , গােয়ালিয়র , ঝাসি , বুন্দেলখণ্ড প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে সে সংগ্রহ শেষ হয় । ইতিহাস সংগ্রহের এই প্রচেষ্টার কারণ হিসেবে লেখিকার মত “ কোন ব্যাপারের যথার্থ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত পেতে হলে , কাগজ ও নথিপত্রগত গবেষণা যথেষ্ট নয় । লােকগাথা - গীত - কবিতায় , অর্থাৎ লােকবৃত্তে সে ব্যাপারটির যতটা পরিচয় মেলে , তাকেও মর্যাদা দিতে হবে । এ ব্যাপারটির বিষয়েও আমাকে নিজেই উপলব্ধি করতে , উপাদান সংকলন করতে ও ব্যবহার করতে শিখতে হয়েছিল । একেবারে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় শুধুমাত্র মানচিত্রে ‘ ঝাসি ’ নামটি দেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন । এবং সংগ্রহ করেছিলেন গণবৃত্তের ইতিহাস , কিন্তু উপাদান সংগ্রহের ইতিহাস বা পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল নদী যেমন চলার পথে বিভিন্ন বাঁক পরিবর্তন করে মানুষের জীবনেও আসে একরকম বাঁক পরিবর্তন । দীর্ঘদিন একই খাতে জীবন চলে না । জীবনের নিয়মই হল বিভিন্ন বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা । তা সে সাধারণ ব্যক্তিমানুষই হােক বা প্রথিতযশা লেখিকারাই হােক । মহাশ্বেতা ঘটক প্রথাগত শিক্ষার মাঝেই প্রবেশ করেছিলেন লেখক জীবনে । এবার ব্যক্তি জীবনেও মােড় ঘুরল । গণনাট্য সংঘের অন্যতম পুরােধা পুরুষ নট - নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন— ১৯৪৭ সালে । বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর বিবাহ স্থির হলে তিনি ছােটবেলাকার বান্ধবী রাজলক্ষ্মী দেবীকে একটি চিঠিতে জানিয়ে ছিলেন— “ বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে ।.. আমি বিয়ে করছিনা , আমার বিয়ে হচ্ছে । ” পরবর্তীকালে বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে যে বিচ্ছেদ ঘটে তার বীজও হয়তাে নিহিত ছিল এই চিঠির বক্তব্যের মধ্যে । বিয়ের পরে মহাশ্বেতা এলেন শ্বশুরবাড়ির বারাে ফুট বাই বারাে ফুটের তিনখানা ঘরে । যেখানে একসঙ্গে বাস করেন প্রায় একডজন মানুষ । সেখানে যাবতীয় কাজের ফাঁকে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে জীবিকার সন্ধানে । স্বামী বিজন ভট্টাচার্যের সমর্থন ও সহযােগিতা মহাশ্বেতা পেয়েছেন অকুণ্ঠ চিত্তে । তাই অকপটে স্বীকার করেন— " Bijan has shaped my talent and given it a permanent form . He has made me into what I am today . " অর্থাৎ ‘ মহাশ্বেতা ঘটক ’ থেকে আজকের সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী ’ হয়ে ওঠার পেছনে ঘটক বাড়ির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি স্বামী বিজন ভট্টাচার্যের ভূমিকাও অনস্বীকার্য । বিজন ভট্টাচার্যের সক্রিয় সহযােগিতা না পেলে ‘ ঝাসির রানি’র উপাদান সংগ্রহ হত না । এবং এরকম একটা জীবন- ইতিহাস পাওয়া থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম । মহাশ্বেতার অদম্য লড়াকু মানসিকতা এবং কিছু করে দেখানাের জেদ এ দুয়ের সমন্বয়েও গ্রন্থটি রচনা সম্ভব হয়েছে । গ্রন্থটি প্রথমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে দেশ পত্রিকায় । এর দু'বছর পর ১৯৫৬ সালে ঝাসির রাণি ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । গ্রন্থটি রচনার ক্ষেত্রে তিনি ড . প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের যে সাহায্য পেয়েছিলেন অকুণ্ঠ চিত্তে সে ঋণ স্বীকার করেছেন । গ্রন্থটি পড়ে প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন এবং তার স্ত্রী বিশেষ সমাদরও করেছিলেন । ‘ ঝাসির রানি ’ প্রকাশের একবছর পরে ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় মহাশ্বেতার প্রথম উপন্যাস ‘ নটী ' । সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত হলেও নটী’আসলে মােতি - খুদাবক্সের প্রেমের কাহিনী । নটী’উপন্যাসে যে শিল্পের প্রসঙ্গ এসেছিল সেই শিল্পের প্রসঙ্গের সূত্র ধরেই লেখা হয় পরবর্তী দুটি উপন্যাস যমুনা - কি - তীর ’ এবং‘মধুরে মধুর দুটি উপন্যাসেরই প্রকাশকাল ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ । সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের গতানুগতিক পথ ছেড়ে শিল্পের মাধ্যমেও বৈচিত্র্য আনলেন ‘ প্রেমতারা’এবং ‘ এতটুকু আশা’তে । ১৯৫৯ - এ প্রকাশিত ‘ প্রেমতারা ’ উপন্যাসের বিষয় সার্কাসের কুশীলবরা । নিম্নবিত্তের স্বপ্ন ও মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত চেতনার দ্বন্দু ‘ এতটুকু আশা ' উপন্যাসে বিধৃত হয় । তিমির লগন উপন্যাসে উঠে আসে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র । অর্থাৎ শিল্প কেন্দ্রিক যে উপন্যাসগুলি লেখা হচ্ছিল তার বিপরীত কোটিতে অবস্থান করলেন তিমির লগন ' - এ ; এখানেই উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে বাসবীর প্রেম , প্রেমে প্রতারিত হওয়া এবং শেষে প্রতিশােধ গ্রহণ— উপন্যাসের কথাবস্তু ‘ তারার আধার ’ উপন্যাসে নিজের প্রতিভার প্রতি অন্ধ মােহ এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে না পেরে শুধুমাত্র আত্মম্ভরিতায় ভর করে ব্যক্তি - মানুষের ট্র্যাজেডি উপন্যাসের বিষয় । এরপর থেকে মহাশ্বেতা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করলেন । সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্বে যে ইতিহাসের প্রতিমহাশ্বেতার আগ্রহ ছিল সেই ইতিহাস ক্রমশ বদলে যেতে লাগল । তার বিষয়ের উপস্থাপনাও তাই পরবর্তিত হল । যদিও এরই মাঝে ব্যক্তিজীবনে চরম টানাপােড়েনের মধ্যে পড়তে হয় । পনেরাে বছরের দাম্পত্য জীবনে ছেদ পড়ে । ১৯৬২ সালে ঘটে বিজন - মহাশ্বেতার বিবাহ বিচ্ছেদ । ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন অসিত গুপ্তকে । সেই বিয়েও ভেঙে যায় ১৯৭৬ সালে । বিজন ভট্টাচার্যকে যখন মহাশ্বেতা বিয়ে করলেন তখন ২৩ বছরের মহাশ্বেতার মধ্যে এক ধরনের ইডিওলজি কাজ করেছিল । কিন্তু পরে অসিত গুপ্তকে যখন বিয়ে করেন তখন তিনি একটা ইকোনমিক সাপাের্ট চাইছিলেন । অসিত গুপ্তকে ছেড়ে আসার কারণ যে ইকোনমিক সাপাের্ট না পাওয়া এবং যে স্বাধীনতা মহাশ্বেতা চাইতেন সেই স্বাধীনতা না পাওয়া , তার উল্লেখ মহাশ্বেতা নিজেই করেছেন কল্যাণ মৈত্রের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ‘ আমার সময় পত্রিকায় “ অসিতকে বিয়ে করে দেখলাম ইট ইস নট ওয়ার্কিং । আমি ইকোনমিক সাপাের্ট পাচ্ছিনা । আমি যে স্বাধীনতা চাই তাও পাচ্ছিনা । আমার জীবন আমারই জীবন । বিজন ভট্টাচার্যকে বিয়ে করার পরে মহাশ্বেতাকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে । লেখালেখির সূচনা পঞ্চাশের দশকে অর্থাৎ বিয়ের পর । তবে লেখার তাগিদ থেকে যে 
শুরু করেন নি সে কথাও জানিয়েছেন এই একান্ত সাক্ষাৎকারে “ আমি লিখতে আরম্ভ করেছিলাম আর্থিক চাপে পড়ে । লিখলে পয়সা পাওয়া যায় । প্রথম জীবনে টিউশনি করেছি টাকার জন্যই । লিখলে টাকা আসত খুব বেশি নয় , তবুও । আমার উল্টোদিকে আকাঙ্ক্ষাও খুব কম ছিল । চলে গেলেই হল এমন আর কি । পনেরাে টাকাও পেলে মনে হয়েছে দ্যাট ইজ আ ফরচুন ।... আমার লেখালেখির পেছনে সাহিত্য প্রেরণা বলতে যা বুঝি তেমন কিছু ছিল না । লেখক হব সেই ইচ্ছে নিয়ে এগিয়ে আসিনি । আমি ও বিজন সেই সময় খুব লড়াই করছি আই ওয়াজ ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম আদারস । যা করেছি তা তাে লিখেই করেছি । বাবা ( মনীশ ঘটক ) লিখতেন । একটা সময় দেখলাম— এটাই একমাত্র জিনিস যা আমি পারি । দিস ইজ দ্য ওনলি থিং আই কুড ডু , -১০ আর্থিক প্রয়ােজনে লিখতে শুরু করলেও অর্থই তাঁর জীবনে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়নি । ব্যক্তিগত জীবনে বাবা - কাকাদের তিনি কখনাে টাকার পেছনে ছুটতে দেখেননি । ফলে মহাশ্বেতার আর্থিক প্রয়ােজন নিবৃত্ত হলেই চলে যেত।প্রয়ােজনের অতিরিক্ত অর্থের মােহ মহাশ্বেতার ছিল না । তাই ‘ ম্যাগসেসে ’ বা সাহিত্য একাডেমী ’ পেলেও তার অর্থ দান করে দিতে পারেন অনায়াসেই । লােভ বা চাহিদা কোনটাই মহাশ্বেতার ছিল না । বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিচ্ছেদ এবং অসিত গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সন্ধিক

 উপন্যাসটিতে । কবি বন্দ্যঘটী গাঞি যেমন নিজের এক পরিচিত জগৎ ছেড়ে অন্য জগৎ বা ভুবন খুঁজে নিতে চেয়েছিল , ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবীও এ সময় এক স্বাধীন জীবনের কথা ভেবেছিলেন— ‘ আই নিডেড আ ফ্রিডম ’ । কিন্তু অসিত গুপ্তকে ছেড়ে আসার পরে মহাশ্বেতা দেবীর জীবন যেন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়াল । এ সময়ে থেকেই আদিবাসীদের সমাজ - জীবন তাঁর জনস্মৃতিতে মিশে যেতে শুরু করেন । এ সময় মহাশ্বেতা দেবীর জীবনে ভয়ংকর ডেসট্রাকটিভ প্রতিক্রিয়া শুরু হয় । যার ফলে একদিকে তিনি কোয়ালিটি রাইটিং - এর দিকে জোর দিলেন এবং আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করতে শুরু করলেন । আদিবাসী জীবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় মহাশ্বেতা দেবীর লেখাকে সমৃদ্ধ করেছিল । “ একটা না দেখা ওয়ার্ল্ড , কেউ জানে না , বােঝে না । তার সমস্ত অনুভূতিগুলি ক্ষোভ - দুঃখগুলি আমার লেখার কালির সঙ্গে খুব মিশে যাচ্ছিল । ” যদিও আদিবাসী জীবনের সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয় এর অনেক আগে থেকেই । ১৯৬৫ সাল থেকেই তিনি পালামৌ যেতে শুরু করেন । বিহারের এই জেলাটিকে তিনি ভারতবর্ষের অন্যতম এক দরিদ্রতম জেলা বলে মনে করতেন । এই জেলাগুলিতে ব্রিটিশদের আনা বণ্ডেডলেবার বা ভূমিদাসপ্রথা বেঁচে থাকে । তারা নতুন শ্রেণী গঠন করে , যা আদিবাসী সহ শােষিত শ্রেণীর জমি ছিনিয়ে নেয় এবং এদের ঋণবদ্ধ দাসমজুরে পরিণত করে । ১৯৭৬ সালে ভারত সরকার বণ্ডেড লেবার প্রথা নিষিদ্ধ করতে আইন পাশ করে । যদিও অনেক রাজ্যে বণ্ডেড লেবার জেলা বলে চিহ্নিত জেলা রয়েছে । মহাশ্বেতা দেবী অনেক গল্পে এই পালামৌর কথা বলেছেন । গায়ত্রী চক্রবর্তীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবী জানিয়েছেন— “ যখন বুঝলাম আদিবাসীদের কথা অনুভব করা , লেখালেখি করা যথেষ্ট নয় , ওদের সঙ্গে বসবাসও করি । ওদের নারীর / পুরুষের অবস্থান থেকে সবটা দেখে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা’করি । এভাবেই বীরসামুণ্ডাকে নিয়ে লিখি‘অরণ্যের অধিকার । ” এভাবে আদিবাসী সমাজ ও জীবন নিয়ে লেখা হতে থাকে একের পর এক উপন্যাস ‘ অরণ্যের অধিকার ’ ( ১৯৭৭ ) , বিদ্রোহ বা উলগুলানের উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে যায় পরবর্তী উপন্যাস ‘ চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তির ’ ( ১৯৮০ ) । লেখা হয় ‘ অক্লান্ত কৌরব ’ , ‘ বিবেক বিদায় পালা ’ , ‘ সুরজ গাগরাই ’ , ‘ বন্দোবস্তী ’ , ‘ টেরােড্যাকটিল পূরণ সহায় ও পিরথা’প্রভৃতি উপন্যাস । এ উপন্যাসগুলিতে একদিকে রয়েছে উচ্চবর্ণ , শাসক , জমিদার এবং জোতদার শ্রেণী অন্যদিকে রয়েছে নিম্নবর্ণ , নিরন্ন বুভুক্ষু মানুষ । যারা প্রতিনিয়ত শােষিত হয় , লাঞ্ছিত হয় , অপমানিত হয় । মহাশ্বেতা দেবী জীবনের ইতিবাচকতায় বিশ্বাসী সেই সংগে বিশ্বাস করেন সংগ্রামে । প্রথম জীবনে মহাশ্বেতা দেবীর সংগ্রাম


No comments:

Post a Comment