সৈয়দ মুস্তাফা
সিরাজ
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ১৪ অক্টোবর মুর্শিদাবাদ জেলায় খোশবাস পুর গ্রামে এক অভিজাত ও মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেখানে শিক্ষা এবং সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার একটি সুন্দর পরিবেশ ছিল। শুধু তাই নয় আরবি-ফারসি সংস্কৃতি প্রভৃতি ভাষাযর চর্চাও হতো তাঁর পরিবারে। লেখক এর মা আনোয়ারা বেগম ছিলেন একজন খ্যাতনামা কবি। সে কারণেই শৈশব থেকেই সিরাজ হৃদয় দিয়ে সাহিত্য রস আস্বাদন করতে শিখেছিলেন।
ছাত্রজীবন: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান জেলার 'গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয়' থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক হন। স্কুল জীবন থেকেই বাইরের বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর।
কর্মজীবন: যৌবনের শুরুতেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। সেই সূত্রেই তিনি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে লোকনাট্যদল 'আলকাপ' এর সঙ্গে যুক্ত হন। সেই দলে তিনি বাঁশি বাজাতেন এবং লোকনাট্য ও লোকনৃত্যের প্রশিক্ষণ দিতেন। এই দলের সূত্রে তিনি গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং সেই সব স্থানে সমাজ ও অর্থনীতির সঙ্গে পরিচিত হন। এই কাজের সূত্রে বঙ্গ দেশের বিভিন্ন জেলা যেমন মুর্শিদাবাদ, মালদা, বর্ধমান, বীরভূম এমনকি কলকাতাতেও তিনি ঘুরে বেড়াতেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিরাজ আলকাপ এর দলের হয়ে সারারাত্রিব্যাপি অনুষ্ঠান করতেন। তার পরবর্তী জীবনে লেখালেখিতে এই অভিজ্ঞতা প্রভাব ফেলেছিল। (ইংরেজিতে পড়ুন)
পরবর্তীকালে সিরাজের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। তিনি অনুভব করেন যে তার চারিদিকে আরো বড় পৃথিবী পড়ে রয়েছে। অবশ্য তিনি আগেই কবিতা এবং ছোট গল্প লেখা শুরু করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ইবলিশ ছদ্মনামে লেখা তার প্রথম গল্প 'কাচি' বহরমপুরের 'সুপ্রভাত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই একই বছরে ' পত্রিকায়' তাঁর 'শেষ অভিসার' নামক কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প 'ভালোবাসা ও ডাউন ট্রেন' প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভান্ডার পত্রিকায় যোগদান। এর পাশাপাশি তাঁর গল্প লেখাও চলতে থাকে। এরপর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম উপন্যাস "নীল ঘরের নটী" প্রকাশিত হলে তিনি ক্রমে ক্রমে উপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি "আনন্দবাজার" পত্রিকায় যোগদান।
সাহিত্যকর্ম: সারা জীবন ধরে তিনি ১৫০ টির মতো উপন্যাস এবং ৩০০ টির মত ছোটগল্প লিখেছেন। এগুলির মধ্যে 'ইন্তিপিসি ও ঘাটবাবু', 'ভালোবাসা ও ডাউন ট্রেন,' 'হিজল বিলের রাখালেরা', 'তরঙ্গিনীর চোখ', 'মানুষের জন্ম', 'রণভূমি', 'রক্তের প্রত্যাশা', '- প্রভৃতি ছোট গল্প এবং 'অলীক মানুষ', 'অমর্ত্য প্রেমকথা', 'নিশি মৃগয়া', 'কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি ' , 'তৃণভূমি' 'কিংবদন্তির নায়ক' 'উত্তর জাহানবী' প্রগতি উপন্যাস উল্লেখযোগ্য। দেশের প্রত্যেকটি অষ্টম তপশীল ভুক্ত ভাষায় এবং ইংরেজিতে তার বহু উপন্যাস এবং ছোটগল্প অনূদিত হয়েছে। তাঁর বহু উপন্যাস এবং বেশ কিছু ছোট গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ডিটেকটিভ চরিত্র 'গোয়েন্দা কর্নেল' এর স্রষ্টা। এই চরিত্রটি নিয়ে তিনি শিশু ও কিশোর কিশোরীদের জন্য যেসব গোয়েন্দা কাহিনী রচনা করেছেন তা তাঁকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে যায়।
সম্মান ও স্বীকৃতি: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'আনন্দ পুরস্কার' লাভ করেন। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস 'অলীক মানুষ' এর জন্য তিনি 'বঙ্কিম পুরস্কার' এবং সাহিত্য 'একাডেমী পুরস্কার'(১৯৯৪) লাভ করেন। তার 'অমর্ত্য প্রেমকথা' (১৯৮৮) উপন্যাসের জন্য তিনি 'নরসিংহ দাস স্মৃতি পুরস্কার' পান। ২০১০ সালে তিনি 'বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার' পান।
জীবনাবসান: ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর ৮২ বছর বয়সে এই পণ্ডিত সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ স্বতন্ত্র ধারার কথা সাহিত্যিক হিসেবে এবং গোয়েন্দা কর্নেল চরিত্রের স্রষ্টা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
No comments:
Post a Comment