বিদ্যাসাগর জীবন কাহিনী/Life Story/Biography Of Biddashagor in Bangla - Psycho Principal

Fresh Topics

Wednesday, 29 September 2021

বিদ্যাসাগর জীবন কাহিনী/Life Story/Biography Of Biddashagor in Bangla

 

উনিশ শতকে একদিকে যখন ইংরেজের অনুগ্রহভাজন হয়ে ছদ্ম - আধুনিকতার পাঠ নিচ্ছে বাঙালি , অন্যদিকে মনের ভিতরে মধ্যযুগীয় অন্ধকার — সেই সময় আত্মমর্যাদা ও শিক্ষায় জাতিকে আত্মদীপ্ত করে তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর ।
প্রাথমিক পরিচিতিঃ ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগরের জন্ম । পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় , মা ভগবতী দেবী । ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভরতি হন । সংস্কৃত কলেজে তিনি বারাে বছর পড়াশােনা করেন । ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন । তার প্রশংসাপত্রেই প্রথম ‘ বিদ্যাসাগর ’ উপাধিটি ব্যবহার করা হয় । 
কর্মজীবনঃ ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদে বিদ্যাসাগর যােগদান করেন । ১৮৪৬ - এসংস্কৃত কলেজে সহসম্পাদক হিসেবে যােগ দিলেও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে তিনি পদত্যাগ করে ফিরে যান ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে । তবে ১৮৫১ - তে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি সংস্কৃত কলেজের দরজা অব্রাত্মণ ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন । সংস্কৃতের পাশাপাশি বাংলা এবং ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি , শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন তিনি ।
নারীশিক্ষার প্রসারঃ বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জেলায় পঁয়তিরিশটি স্কুল স্থাপন করেন । মেয়েদের শিক্ষায় সাহায্য করার জন্য গড়ে তােলেন নারীশিক্ষা ভাণ্ডার । তবে বিদ্যাসাগরের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বিধবাবিবাহ প্রচলন করা । তার উদ্যোগেই ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার বিধবাবিবাহ আইন প্রচলন করে ।
সাহিত্যসৃষ্টিঃ বর্ণপরিচয় বিদ্যাসাগরের অবিস্মরণীয় কীর্তি । এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু স্মরণীয় অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন , যেমন — সীতার বনবাস , ভ্রান্তিবিলাস , কথামালা , বােধােদয় , বেতাল পঞবিংশতি ইত্যাদি । মার্শম্যানের History of Bengg / অবলম্বনে রচনা করেন বাঙ্গালার ইতিহাস ।
বর্তমান প্রাসঙ্গিকতাঃ জন্মের দুশাে বছর অতিক্রান্তেও বিদ্যাসাগর আজও প্রাসঙ্গিক । সেকথা মনে রেখে রাজ্যসরকার যথােচিত মর্যাদার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে । বিদ্যালয় স্তরে প্রাথমিক এবং প্রথম শ্রেণিতে বিনামূল্যে বর্ণপরিচয় - কে ঐতিহ্যপূর্ণ বই হিসেবে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে । সেপ্টেম্বরের ২১ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত স্কুলগুলিতে বিতর্ক , আলােচনা প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে বিদ্যাসাগর চর্চা হয়েছে ।
উপসংহারঃ  বিদ্যাসাগর কোনাে নাম নয় , এক জীবনচর্চা । উদারতা ও সংস্কারহীনতার সমন্বয়ে তার যে জীবনাদর্শ তা বাঙালিকে মেরুদণ্ড ঋজু রাখার শিক্ষা দেয় । জাতিকে তার কাছেই নতজানু থাকতে হবে ।

দ্বিতীয় দাতা কর্ণ এবং দয়ার সাগর অনাথ - বান্ধব বঙ্গের দ্বিতীয় “ বিদ্যাসাগর ' , ১৮৯১ খৃঃ অব্দে ২৯ শে জুলাই বা ১২৯৮ সালে ১ ই শ্রাবণ , মঙ্গলবার রাত্রি ২ টা ১৮ মিনিটে ইহলােক ত্যাগ করিয়াছেন । বলা বাহুল্য , — “ বিদ্যাসাগর ” বলিলে , ৬ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগরকেই বুঝায় । সেই বিশ্ব - বিশ্রুত “ বিদ্যাসাগর ত্রিংশৎ বৎসর হইল , আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন । এ কর্মক্ষেত্রে সেই কৰ্ম্ম - শূর আপন কর্ম সাধন করিয়া , অপেক্ষা কত অল্পতর ভাগ্যহীন ক্যক্তিবর্গকে কর্মের শিক্ষা - দীক্ষা দিয়া , স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন । জীৰমাত্রের এই অবস্থা । সেই আদ্যা শক্তি মূলা প্রকৃতির এই ব্যবস্থা । অবােধ মায়াময় জীব আমরা , মায়া - মুগ্ধ হইয়া , এ সব তত্ব বুঝিয়াও , বুঝিতে পারি । এ অনিত্য সংসারে কেবল বিয়ােগবিলাপে অধীর হইয়া পড়ি । তাই বিদ্যাসাগরের স্মৃতিতে এখনও ৰিয়ােগ - বাড়বা নল প্রজ্জলিত হইয়া উঠে । যে যায় , সে ত আর আসে না । যায় , কিন্তু স্মৃতি যে জাগে ! স্মৃতি ত নয় , সে যে জালাময়ী জ্বালা । ‘ লে জালা জুড়াইব কিসে ?

যাহার করুণায় শত শত নিরন্ন নিরাশ্রম , অন্নায় পাইত ; বাহার আশ্রয়ে থাকিয়া , অগণিত অনাথ আতুর দীন হীন দুই দরিদ্র অসহায় আত্মীয় - নির্বিশেষে প্রতিপালিত হইত ; যাহার অপার দয়া - দাক্ষিণ্যে কপর্দকহীন অধমর্ণ , উত্তমর্ণের নিদারুণ নিপীড়ন হইতে রক্ষা পাইত ; যাহার সহৃদয়তাগুণে মল - মূত্রপুরিত পরিত্যক্ত রুগ্ন পথিক , গৃহে আনীত হইয়া যথাযােগ্য ঔষধ - পথ্য পাইত ; যাহার জ্বলন্ত জীবন্ত দৃষ্টান্তে অতিবড় কু - পুত্রও অতুল মাতৃভক্তি শিক্ষা পাইত ; যাহার অসাধারণ অধ্যবসায় , অদম্য উদ্যম - উৎসাহ , অকুণ্ঠিত নির্ভীকতা , অলৌকিক শ্ৰমাকুন্ঠিতা , অসীম কৰ্ত্তৰ - পরায়ণত , অমানুষিক সরলতা দেখিয়া বিদেশী প্রবাসী লােকেও সবিস্ময়ে সহস্র বার মস্তক অবনত করিত , সেই ক্ষণজন্মা ভাগ্যবান্ পুরুষ লােকান্তরিত ! বল দেখি , তাহার স্মৃতি পাসরি কিসে ? এখনও চারি দিকে কত কাঙালের পর্ণ - কুটীরে পূর্ণ হাহাকার ! এখনও কত অনাথাশ্রমে আকুল প্রাণের মর্মভেদী গভীর চীৎকার ! সে সব কথা ভাবিলে চকু ফাটিয়া রক্ত বাহির হয় । সেই করুণপ্রতিম অনুপম করুণাময়ের কথা স্মরণ হইপে হৃদয়ের শােক - সাগর উথলিয়া উঠে । বিদ্যা - বুদ্ধিতে “ বিদ্যাসাগর ” অপেক্ষা বড় অনেক থাকিতে পারেন ; কিন্তু দয়া - দাক্ষিণ্যে তঁাহা : অপেক্ষা বড় অতি অল্প লােক দেখিতে পাই । এমন নিরন্নের অন্নদাতা , ভয়ার্কের ভয়ত্ৰাতা , বিপন্নের উারকর্তা এবং দীন - হীনের দয়াল পালক পিতা , একলিযুগে , এ সংসারে ঝড় বিরল । তিনি যে দয়ার অপূর্ব অবতার ।

তিনি যে মুক্তিমতী দয়ার পূর্ণ পুরুষকার ! হৃদয় - বলে “ বিদ্যাসাগৰ ” বঙ্গের বিরাট পুরুষ । এক জন বড় লােক হইলে , সমগ্র দেশ বা জাতি ৰড় বলিয়া সম্মানিত হয় । মার্কিণ গ্রন্থকার দার্শনিক এমারসন্ বড় লােকদের কথায় বলিয়াছেন , “ The race goes with us on their credit . " , • এ কলুষময় কলিকালে , দানে পূর্ণ “ সাত্বিকতা ” সুদুল বিদ্যাসাগরের দানে কিন্তু সাবিকতার পূর্ণ বিকাশ । তাঁহার “ বিধবা - বিবাহ ” প্রচলন - প্রক্রিয়া সম্বন্ধে হিন্দু - সাধারণে একমত হইতে পারে নাই সত্য , কিন্তু তাহার দয়া - প্রণােদিত দানের সাত্ত্বিকতা কেহ অস্বীকার করিতে পারিবেন না । দানে বিদ্যাসাগর শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করিয়াছেন । শাস্ত্রে আছে , দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেপকারিণে । দেশে কালে চ পাত্রে তদ্দানং সাৰিকং খৃতম্ ॥ ” -গীতা ১৭। ২০ । দান করিতে হইবে , ইহা মনে করিয়া দেশ কাল পাত্র বিবেচনায় , অপকারীকেও যে দান করা যায় , তাহাকে সাত্ত্বিক দান কহে । এরূপ সাব্দিকভাবাপন্ন দানের পরিচয় বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্তে পুনঃ পুনঃ পাইবেন । বিদ্যাসাগর দান করিতে , জানিতেন কেবল দাগ ও গ্রহী । দানের পৌষ - প্রকাশে তাহার প্রবৃত্তি ছিল না । তিনি দান করিতেন , নামের জন্য নহে , দরিদ্রের সেবা এবং গ্নের শুশ্রুষা কেবলমাত্র তাহার অকাম - কল্পিত নিত্য ক্রিয়া ছিল । দেনার দাযে ঋন জেলে যাইতে যাইতে পথে .বিদ্যাসাগকে দেখি , বাষ্পকুললোচনে কাতরভাবে তাঁহার পানে : একবার তাকাইলে , চক্ষের জলে তাহার বুক ভাসিয যাইত । কপর্দক হস্তে না থাকিলেও , তদণ্ডে তিনি ঋণ করিয়া রুণীর ঋণ পরিশােধ করিতেন । এরূপ দান অবশ্য সংসারের পক্ষে সকল সময় সর্বথা অনু : করণীয় ও প্রবর্তনীয় নয় । ইহাতে অনেক সময় বিপদগ্রস্ত হইতে হয় । বিলাতী কবি গােল্ডস্মিথ , কতকটা এইরূপ দানশীলতায় মধ্যে মধ্যে বিপগ্রস্ত হইয়াছিলেন । বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অবশ্য কখন , সেরূপ হইতে হয় নাই । হইলেও ইহা যে স্বাভাবিকী সহৃদয়তার পরিচায়ক , তাহাতে সন্দেহ কি ? প্রাসাদ - বিহারী কোটিপতি হইতে “ কৰ্ম্মটাড়ের পর্ণকুটির - বাসী অশিক্ষিত দীন হীন সাঁওতাল পর্যন্ত জানিত , — “ বিদ্যাসাগর দয়ার অবতার । " এই জন্য তিনি হিন্দু , বৌদ্ধ , খৃষ্টান , মুসান , শিখ , পারসিক , সর্ব দেশের সর্ল জাতির সমান বরণীয় এবং মাননীয় । তাঁহার বিধবা - বিবাহ - প্রচলনের কাৰ্যানুষ্ঠান সম্বন্ধে যাহারা বিরুদ্ধ বাণী ছিলেন , তাঁহারাও ঐ কাৰ্য্য অতিমাত্র দয়া - প্রবণতার ফল বুঝিতে পারি তাহার প্রতি ভক্তিহীন হন দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর কোথায় । সে দানৰী সৰ্বজনসমাদৃত বিদ্যাসাগর কোথায় ! যখন শশাকের দারুণ শক্তিশেল বুকের উপব , যখন যাতনা অগ্নিস্তুপ মৰ্ম্মের ভিতব , তখন “ জন্মভূমি ” পত্রিকায় এ অধম লেখকের উপর বিদ্যাসাগরের জীবনী লিখিবার ভাব পড়িছিল । মনে করিযাছিলাম , জালা জুড়াইলে , সম্পূর্ণ উপকরণ সংগ্রহ করিয়া , জীবনী লিখিতে প্রবৃত্ত হইব । জালা জুড়াইল না ;

পাঠকগণ কিন্তু অধীর ; কাজেই জীবনীর অসম্পূর্ণ উপকরণ লইয়া “ জন্মভূমিতে জীবনী লিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম । যে কারণে জন্মভূমিতে জীবনী লিখিতে বাধ্য হইয়াছিলাম , সেই কারণে জীবনী পুস্তকাকারে প্রকাশ করি । পুস্তকের উপকরণ সম্পূর্ণ না হউক , অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী । সে বিরাট পুরুষের জীবনীর সম্পূর্ণ উপকরণ সংগ্রহ একরূপ সাধ্যাতীত । তবে ইহাতে যথাজ্ঞাতব্য বিষয়ের অভাৰ যাহাতে হয় , তাহার জন্য সাধ্যানুসারে প্রয়াস পাইয়াছি । জীবনী লেখা হইযাছে বটে ; কিন্তু একেবারে নির্দোষ হইবার সম্ভাবনা কম । কাহারও জীবনী লিখিতে হইলে , গুণাধিক্যের সঙ্গে দোষেরও সম্যক্ সমালোচনায় সমদর্শিতার সম্মান সংরক্ষিত হয় । মৃত ব্যক্তির গুণ ভালবাসার জিনিষ ; দোষ নিন্দাহ । কবি সাদে বলিয়াছেন “ Their virtues love , their faults condemn . " বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুগুণান্বিত হইলেও কেহ কেহ তাহার কোনও কোনও কাৰ্য্যে দোষারােপ করিতেন এবং অনেকেরই বিশ্বাস যে , সেই দোষ তঁাহার ভ্রান্তবিশ্বাস - মূলক । কিন্তু তাহা সত্য হইলেও বহুগুণের সমাবেশে তাঁহার গুণের গরিমাই উজ্জ্বল হইয়া উঠে । যাহাই হউক এ সময়ে দোষের সম্যক্ সমালােচনা করা নানা কারণে অনুচিত । ডাক্তার জনসন্ বলিয়াছেন যে , “ যাহার জীবনী লিখিতে হয় , কেবল তঁাহার চরিত্রের উজ্জল ভাগই সমালােচনা করা উচিত নহে ; তাহা হইলে তাহার অনু করণ অসম্ভব হইয়া উঠে । ” তঁাহারও কিন্তু সে সাহসে কুলায় নাই । ঠগবসময়ে যে সব কবি ছিলেন , তাহাদের

অনেকের অনেক কথা বলিতে তিনি কুষ্ঠিত হইয়াছিলেন । ভার কথা এই ছিল , " Walking .upon ashes under which the fire was not extinguished . " “ অনলাভ্যন্তর ভস্মন্তুপে বিচরণ করিতেছি । ” সকল দোষত্রুটির সমালােচনা করা অসম্ভব হইলেও , আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোন কোন কার্যের জনমত কিরূপ ছিল , তাহা প্রকাশ করিতে সাহসী হইয়াছি । যাহার অনুকরণে সম্প্রদায় বিশেষের মহতী ক্ষতি হইয়াছে বলিয়া অনেকে : দৃঢ় , মত - পোষণ করেন , তাহা প্রদর্শন না করিলে প্রত্যবায়ভাগী হইতে ইহবে । গুণরাশির সমালােচনা ত অবশ্য কর্তব্য ; যেহেতু তাহা একান্ত অনুকরণীয় । বিদ্যাসাগর মহাশয় দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান হইয়াও , কি গুণে সম্রাট - মুকুট - লান কীর্তির অপূর্ব জ্যোতিষশন্ শিরস্ত্রাণ মস্তকে ধারণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন , তাহা বর্তমান কালে অনেকে অবগত নহেন । বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী সমালােচ নায় তাহা উদঘাটিত হইৰে । সেই হেতু এ জীবনী বােধ হয় বর্তমান ও ভবিষ্যৎ লােকসমূহের কথঞ্চিৎ উপকারক ও উপাদেয় হইতে পারিবে । যে গুণংঘাত জন্য লােকের জীবনী লেখা আবশ্যক হয় , সাগর মহাশয়ের সে গুণ অনেক ছিল । যে গুণ থাকিলে , মাষ মানুষকে ভালবাশিতে চাহে এবং যে গুণ থাকিলে , মানুষ ৰা জগৎ ভুলিয়া , সেই গুণবানের সম্পূর্ণ সত্তায় হৃদয় পূর্ণ করিয়া লে , সে গুণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক ছিল । যিনি এক উম্ভাবনায় চিন্তারাজ্যের সহস্র পথ উন্মুক্ত করিষা দেন , তঁাহারজীবনী লেখা আবশ্যক হয় । পাঠক ! বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উত্তাবনা শক্তির পরিচয় , পাইবেন । যিনি প্রতিভাবলে প্রকৃতির উচ্চ শুরে দণ্ডায়মান হইয়া ইঙ্গিতে উন্নতির সহ পথের যে কোন পথ দেখাইয়া থাকেন , আর নিম্ন স্তরের লােসমূহ তাহাকে ধরিবার জন্য স্তর বাহিয়া উঠিতে চেষ্টা করে , তাহার জীবনীর প্রয়ােজন আছে । বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনীপাঠে এ কথার সার্থকতা সম্যকরূপে প্রতিপন্ন হইবে । প্রকৃত প্রতিভায় “ চৌধক ” আকর্ষণের অসীম শক্তি । মানুষ যেখানে যত দূরেই থাকুক , আকর্ষণ এড়াইবার যাে নাই । যেখানে এরূপ একটি চুক ” থাকিবে , সেইখানে কেট জীব আকৃষ্ট হইবে । প্রতিভা স্বর্গের দেবতা । প্রতিভা - পূজক সৰ্ব দিয়া প্রতিভার পূজা করিয়া থাকেন । চিন্তাশীল এমারস বলিয়াছেন , - “ তুমি বল , ইংরা কাজের লােক জর্মাণ সন্ধ্যায় অতিথি - সেবক ভালেসিয়ার জলবায়ু অতি মনােরম , -সক্রেমেন্টো পাহাড়ে প্রচুর সােণা পাওয়া যায় ; কথা ঠিক বটে ; কিন্তু আমি এ সব সুখশালী , ধনী এবং অতিথি সেবক লােকদিগকে দেখিতে বা নির্মল জলবায়ুর সেবন করিতে অথবা বহুব্যয়ে স্বর্ণ সংগ্রহ করিতে চাহি । তবে প্রকৃত জ্ঞানশালী ও শক্তিমান্ ব্যক্তিবর্গের আবাস ভূমি দেখাইয়া দিতে পারে , এমন যদি কোন চুলক - প্রস্তর প্রাপ্ত হই , তাহা হইলে সর্বস্ব বিক্রয় করিয়া তাহা ক্রয় করি এবং অল্পই পথে বাহির হইয়া পড়ি । ” প্রকৃত শক্তিশালী এবং গৌরবান্বিত প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি সর্বত্রই পূজনীয় । তাঁহারা মানুষের আদর্শ । তাঁরা প্রকৃতির ।

সূক্ষ্ম শক্তির পরিচায়ক । বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে তাহাদের শক্তি বিসর্পিত । তাহাদের সহবাসে মানুষ সন্তুষ্ট ও শক্তিসম্পন্ন হয় । ভাবে বা কার্যে মানুষ তাঁহাদের সঙ্গে থাকিতে চাহে । আমাদের সন্তানসন্ততি বা নগর গ্রামের , নামকরণ , তাহাদের নামে হইয়া থাকে । ভাষায় তাহাদের নামের ভূরি ভূরি প্রয়ােগ পাইবে । তাঁহাদেব প্রতিকৃতি বা গ্রন্থাদিরূপ কার্যাবলী আমাদের ঘরে ঘরে দেখিবে । আমাদের নৈতিক কার্যে তাহাদের প্রত্যেক কাৰ্য্য স্মৃতিপথে জাগিয়া উঠে । তাহাদের অন্বেষণ যুবার স্বপ্ন এবং বর্ষিয়ানের জাগরণ কাৰ্য । যতদূরে থাকি না , তঁাহাদিগের কার্যকলাপ এবং সম্ভবপর হইলে , তাহাদিগকে দেখিবার জন্য মন স্বতঃই বাকুল হইয়া উঠে । এইরূপ প্রতিভাশালী ব্যক্তির জীবনী প্রয়ােজনীয় । এই জন্য এমারস বলিয়াছেন , " The genius of humanity , is the real subject whose biography is written in our annals . প্রতিভা মানবের প্রকৃত পদার্থ । প্রতিভাশালীর জীবন ইতিহাসে লিখিত হইয়া থাকে । বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনে এমন প্রতিভার “ বহু পরিচয় পাইবেন । এক একটী প্রতিভাশালী ব্যক্তি যেমন এক একটা বিভাগ অধিকার করিয়া থাকেন , তেমনই বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রকৃতির এক বিশাল বিভাগ লইয়া ব্যাপৃত ছিলেন । মনোবৃত্তির উচ্চ ক্রিয়ানিবন্ধন প্রতি সম্পন্ন ব্যক্তি ধ্যানমাত্রে কল্পনায় অন্য সাধারণের অলক্ষ্যে প্রকৃতির সূক্ষ্ম তন্ত্র হৃদয়ঙ্গম করিয়া লন । এই অষ্ণ প্লেটো , সেক্সপিয়র , সুইনবর্ণ , গেটে প্রভৃতির এত প্রতিষ্ঠা ।

মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের কাৰ্যফল অব্যর্থ । জ্ঞান ৪ ভাবের শক্তি চিরন্তন ধ্রুব সুখদায়িনী । এ শক্তির তেজ পৰীক্ষা করিতে হইলে শক্তিশালী পুরুষের জীবনী পড়িতে হয় । বিদ্যাসাগব মহাশয়ের বহু কার্য্যে এ শক্তির প্রমাণ আছে । বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা স্তর ওয়ালটর ব্যালের সম্বন্ধে ইংলণ্ডেশ্বরী এলিজা বেথের সচিব লর্ড সিসিল বালে বলিয়াছিলেন , " I know he can toil terribly . " ওয়ালটর ভয়ানক পরিশ্রম করিতে পারেন । এ কথা শুনিলে যেন বৈদ্যুতিক প্রভাবে সৰ্বাঙ্গ আলােড়িত হইয়া উঠে । পাঠক । বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী পাঠ করিলে বুঝিতে পারিবেন , বালের এই কথা বিদ্যাসাগর মহাশয়ে খাটে কি না । হামডে সম্বন্ধে বিখ্যাত বিলাতী ইতিহাস - লেখক ক্লারেনড বলিয়াছেন , " Who was of an industry and vigilance not to be tired out or wcaried by the most laborious ; and of parts not to be imposed on by the most subtle and sharp , and of a personal courage equal to his best parts . " হামডেন্ অকাতরে পরিশ্রম করিতেন ; তঁাহার সংপ্রবুদ্ধা তীক্ষদর্শিতা বিলক্ষণ ছিল । তিনি অতি পরিশ্রমে কাতর ও ক্লান্ত হইতেন না । চতুর তীক্ষ্ণবুদ্ধি লােক তঁহাকে বিচলিত করিতে পারিতেন না । তঁাহার বুদ্ধিমত্তা ও উদ্যমশলা , শারীরিক সাহস ও মানসিক বল সমান ছিল । ইংলণ্ডের প্রথম চার্লসের ভক্ত অনুচর কল্যাণ্ড সম্বন্ধেও ক্লারেনড বলিয়াছেন , -

" Who was so severe an adorer of truth , that he can as easily have given himself leave to steal , as to dissemble . কল্যাণ্ড এমন সুদৃঢ় সত্যপরায়ণ ছিলেন যে , চুরি করা তাহার পক্ষে যেমন অসম্ভব , আত্মগােপন করাও তদ্রুপ অসম্ভব । চীন দার্শনিক লু সম্বন্ধে চীন দার্শনিক মেনসয়াস বলিয়া ছিলেন , “ লুর ব্যবহারের কথা শুনিলে অতি নির্বোধেরও বােধের সঞ্চার হয় এবং অস্থিরচিত্তেরও একাগ্ৰতা উপস্থিত হয় । ” বিদ্যাসাগর - জীবনে একাধারে এই হামডে , ফকল্যাণ্ড এবং লুর চরিত্র সমাবেশিত । বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী হইতে এই সকলের শিক্ষা হয় । ইহা জীবনীর নৈতিক সার । এই জন্যই কার্লাইল বলিয়াছেন , " Not only in the common speech of in all art too which is or should be concentrated and conserved essence of what men speak and show - Biography is almost the one thing needful . " কেবল যে মানুষের সাধারণ কথাবার্তার জন্য জীবনী আবশ্যক হয় , তাহা নহে ; মানুষ যাহা কথায় বলে এবং কার্য্যে দেখায় , সেই সকল বিষয়ের সার অংশটুকুর জন্য জীবনী অত্যন্ত আবশ্যক । এই জন্য বিদ্যাসাগরের জীবনী প্রয়ােজনীয় । অাধুনিক জীবনী - লিখন - প্রথা বিদেশীয় অনুকরণ । বিদেশীয় শক্তিশালী

বড়লােকমাত্র বিদ্যাসাগরের প্রতিপাত্র ছিলেন । অতএব বিদেশীয় শক্তিশালী ব্যক্তিদিগের সহিত তাহার তুলনা অযৌক্তিক নহে । কোন না কোন বিদেশীয় শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির কোন না কোন গুণ তাহাতে পরিলক্ষিত হইত । “ বিদ্যাসাগর চরিত ” নামে , বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্বরচিত অসম্পূর্ণ জীবনী তদীয় পুত্র শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কর্তৃক প্রকাশিত হয় । কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করিবার পূর্ববর্তী ঘটনাগুলি লইয়া ইহা রচিত । নারায়ণ বাবু লিখিয়াছেন , — “ যদি তাহার ছাত্রজীবনের ইতিহাস নিজে লিখিয়া যাইতে পারিতেন , তাহা হইলেও তাহার জীবন - চরিত সম্পূর্ণ করা সহজ হইত । ” নিজের জীবনী নিজে লিখিলে জীবনবিবরণ যৈ সম্পূর্ণ হয় , তাহাতে আর সন্দেহ কি ? এতদ্ব্যতীত জীবনীর বিষয়ী ভূত ব্যক্তি , ভাষা , মনােবৃত্তি , ধর্মপ্রবৃত্তি , রীতি , নীতিপ্রভৃতির অনেক আভাস পাইবার সুবিধা ও সুযােগ হয় । জনের জীবনী লিখিতে বসিয়া জীবনীলেখক বসওয়ে ? বলিয়াছেন , " Had Dr. Johnson written his own life in con formity ' with the opinion which he has given , that every man's life may be best written by himself ; had he employed in the preservation of his own history , that clearness of narration and elegance of language in which he has embalmed many eminent persons , the world would probably have had the most perfect example of biography that was ever exhibited . " so

ডাক্তার জন্ বলিতেন , — “ নিজের জীবন - বৃত্তান্ত মানুষ নিজে উত্তম লিখিতে পারেন । ” তিনি যে বিশদ বর্ণনায় এবং সুন্দর রচনায় , বহু সংখ্যক , কীর্তিকুশল ব্যক্তির বিষয় লিপিবদ্ধ করিয়া তঁাহাদিগকে সঞ্জীবিত করিয়াছেন , তাহাতে তিনি যদি স্বয়ং নিজের ইতিহাস লিখিতেন , তাহা হইলে জগৎ তাঁহার নিকটে সর্বাব্যবসম্পন্ন জীবনীর উত্তম দৃষ্টান্ত লাভ করিতে পারিত । কথাটা ঠিক বটে ; কিন্তু আত্মকথার সূক্ষ্ম সমালােচনা হওয়া দুস্কর । সে ভার বাহিরের লােককে লইতে হয় । আত্মদোষের উদঘাটনে সাহস কয় জনের হইয়া থাকে ? রুসের “ কনফেশন্‌ ” অর্থাৎ টী - স্বীকার , দুরন্ত দুঃসাহসিকতার কাজ । ভলটয়ার ঠিকই বলিয়াছেন " There is no man , who has not something hateful in him - no man who has not some of the wild bcast in him . But there are few who will honestly tell us how they manage their wild beast . " জগতে এমন কোন মানুষ নাই , যাহা কিছু দোষ নাই , এমন মানুষ নাই , যাহাতে দৃণাহ কিছুই একেবারেই নাই বা যাহার পশিব - বৃত্তি নাই ; কিন্তু সেই প্রবল পাশববৃত্তি জীবনে কেমন করিয়া আয়ত্ত করিয়া রাখিয়াছে , কয়জন লোকে তাহা অকপটে বলিতে পারে ? মানুষের এমন দোস ও ঐটী থাকিতে পারে যে , তাহা বন্ধু । নিকট প্রকাশ করিতে দ্বিধা হয় । বিখ্যাত ফরাসী গ্রন্থকার শ্যামলে বলিয়াছেন ,

" It seems to me impossible , in the actual state of society , for any man to exhibit his secret heart , the details of his character as known to himself , and above all , his weaknesses and ' his vices , to even his best friend . * ইহার ভাব এই , সমাজের যে অবস্থা , তাহাতে আমার মনে হয় , মানুষ নিজের হৃদয়ের গূঢ় কথা , অথবা যা কেবল অন্তরাত্মাই জানেন , আপনার সেই প্রকৃত চরিত্রের গুপ্ত কথা , আপনার মানসিক দুর্বলতা এবং পাপের কথা তাহার অন্তরঙ্গ অভিন্নহৃদয় বন্ধুর নিকটে ও বলিতে পারে না । জন্ ষ্টুয়ার্ট মিলের আত্মজীবনীতে সকল সন্দেহ দূর হয় না । ফট , মু এবং সাদে আত্মজীবনী লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন । কিন্তু নানাবিধ সঙ্কোচ উপস্থিত হওয়ায় , তঁাহারা তাহা পরিত্যাগ করেন । তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় যেরূপ সত্যপরায়ণ ছিলেন , তাতে তিনি সত্যপ্রকাশে যে অকুণ্ঠিত হইতেন , তাহাতে সন্দেহ নাই । 


No comments:

Post a Comment