জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়ঃ জীবনানন্দ - পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক কবি ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ নভেম্বর দক্ষিণ চবিবশ পরগনার বহড়ুতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয় । তার পিতা বামনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা কমলাদেবী । কবির শৈশবের কিছুটা অংশ কেটেছে তার মামার বাড়িতে । চল্লিশের দশকে তিনি কলকাতার বাগবাজারে মামার বাড়িতে থাকতেন ।
যাত্রজীবনঃ হাতের কাজের প্রতি আগ্রহ থাকায় ছােটোবেলায় কবি ভরতি হন কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে । ছাত্রজীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন তিনি । অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় হরিপদ কুশারীর প্রভাবে কবি কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন । তিনি রূপচাদ পক্ষী ' ছদ্মনামে কবিতা লেখা শুরু করেন । স্কুলে পড়াকালীনই শক্তি চট্টোপাধ্যায় নবােদয় নামের একটি হাতে - লেখা পত্রিকা বের করেন । স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি বাংলা সাহিত্যে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন । কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাত্ররাজনীতির কারণেই ডিসকলেজিয়েট হন । ফলে কলেজের পাঠ তার শেষ করা হয়নি । পরবর্তীকালে কবি বুদ্ধদেব বসুর প্রেরণায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যে ভরতি হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই সেখানকার পড়াতেও তিনি ইতি টানেন ।
কাৰ্জিীবনঃ কবির প্রথম চাকরি ছিল ‘ ক্ল্যারিয়ন ’ নামক একটি বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে । সেখানে তিনি কপিরাইটারের কাজ করতেন । পরবর্তীকালে তিনি ভারবি ' প্রকাশনা সংস্থায় যােগ দেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরিকল্পনাতেই এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতা সিরিজটি প্রকাশিত হতে শুরু করে । এই সময়ে বন্ধু পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযােগিতায় একটি টিউটোরিয়াল হােম খােলেন তিনি । পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীতে তিনি অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ।
সাহিত্যকঃ বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘ যম ’ কবিতাটি । এটিই তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর কৃত্তিবাস পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন এবং এই পত্রিকার অন্যতম প্রধান কবি হয়ে ওঠেন । ধীরে ধীরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পঞ্চাশের দশকের একজন শক্তিশালী জনপ্রিয় কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন । কবিতা রচনাই ছিল তাঁর একমাত্র আশ্রয় । তিনি কবিতাকে ‘ পদ্য ' বলতেন । স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ' নামে তিনি গদ্যচর্চাও করেছেন । ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কুয়ােতলা নামে তার প্রথম উপন্যাসটি লেখেন । প্রকৃতির পাশাপাশি প্রেম , নারী এবং মানুষকে নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন । তার জীবন ছিল বেপরােয়া এবং বন্ধনহীন । যুগের যন্ত্রণাকে গায়ে মেখে তিনি অস্থিরতায় ছটফট করেছেন । কবির উল্লেখযােগ্য কাব্যগুলি হল — হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য , ধর্মে আছাে জিরাফেও আছে , ঈশ্বর থাকেন জলে , সােনার মাছি খুন করেছি , প্রভু নষ্ট হয়ে যাই ইত্যাদি । তাঁর লেখা উল্লেখযােগ্য ছােটোগল্প নিরুপমের দুঃখ । এ ছাড়াও তিনি কালিদাসের মেঘদূত , ওমর খৈয়াম , গালিব প্রমুখের কবিতা অনুবাদ করেছেন ।
সম্মান ও স্বীকৃতিঃ যেতে পারি কিন্তু কেন যাবাে কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন ।
জীবনাবসানঃ ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ শান্তিনিকেতনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘটে ।
দাড়াও
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
মানুষ বড়াে কঁদছে , তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাড়াও
মানুষই ফঁদ পাতছে , তুমি পাখির মতাে পাশে দাড়াও
মানুষ বড়াে একলা , তুমি তাহার পাশে এসে দাড়াও ।
তােমাকে সেই সকাল থেকে তােমার মতাে মনে পড়ছে
সন্ধে হলে মনে পড়ছে , রাতের বেলা মনে পড়ছে
মানুষ বড়াে একলা , তুমি তাহার পাশে এসে দাড়াও ।
এসে দাড়াও , ভেসে দাড়াও এবং ভালবেসে দাড়াও
মানুষ বড়াে কঁদছে , তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাড়াও
মানুষ বড়াে একলা , তুমি তাহার পাশে এসে দাড়াও ।
আসলে কেউ বড়াে হয় না
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
আসলে কেউ বড়াে হয় না , বড়াের মত দেখায় ,
নকলে আর আমলে তাকে বড়াের মত দেখায় ।
গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াও , দেখবে কত ছােটো ,
সােনার তাল তাংড়ে ধরে পেয়েছে ধূলিমুঠো ।
ভালবাসার দীঘিতে কত করেছাে অবগাহন
পেয়েছ সুখ দু : খ আর ছলে ভােলানাে দাহ
পুড়েছাে বনে মালার মতাে , যাওনি তবু ছেড়ে
যতক্ষণ স্মৃতি আড়াল নিয়েছে তাকে কেড়ে ।
আসলে তুমি ক্ষুদ্র ছােটো , ফুলের মতাে বাগানে ফোটো
বিরহে যদি দাঁড়িয়ে ওঠো , ভুতের মতাে দেখায় !
গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াও , দেখবে কত ছােটো ।
এই ঘরে
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
অবাস্তব জোনাকিরা আস্ফালন করে এই ঘরে , ছােট ঘর , বিদায়ে তৎপর-
তবু আস্ফালন করে , জোনাকিরা এই ছােট ঘরে ।
শহর কলকাতা ছিল বাসস্থান কিছুকাল আগে ,
সেখানে নিয়নবাতি ছিল আর ক্লিন্ন গ্যাসলাইট , ট্রপ
ছিল আর ছিল তর্জনী হেলালে ট্যাক্সি - স্টপ , আজ এই প্রায় গ্রামে নির্বাসনে আছি ।
বস্তুত এ - নির্বাসনে ভাল আছি সুখের বাগানে -
চেনা নেই জানা নেই , দেখামাত্র করে না কুর্নিশ :
কেমন আছেন আপনি , ভাল ত , শরীর ভাল আছে ?
কে অত শরীরে ছিল যত্নবান । অধিকন্তু , রাতে-
যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেতুম হাঁকিয়ে সহসা ,
ট্যাক্সি , ট্রাম , মিনিবাস , হিচহাইক করতুম গাড়িতে ।
এখানে সমস্ত শেষ , ঘরে ঢুকলে বেরুতে সংকোচ উপরন্তু , ধু ধু রাস্তা জনহীন শকটবিহীনও !
No comments:
Post a Comment