কবি পরিচিতি জন্ম : ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার অন্তর্গত সাগরদাঁড়ি গ্রামে মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত , মা জাহ্নবী দেবী ।
ছাত্রজীবন : ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন কলকাতার হিন্দু কলেজের জুনিয়র স্কুল বিভাগে ভরতি হন । পরের বছর ওই স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় শেকসপিয়রের কবিতা থেকে আবৃত্তির জন্য তিনি পুরস্কার পান । ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি জুনিয়র বৃত্তি নিয়ে হিন্দু কলেজের সিনিয়র বিভাগে ভরতি হন এবং ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখে স্বর্ণপদক লাভ করেন । পরিবারের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি মধুসূদন কলকাতার ওল্ড মিশন গির্জায় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন । ১৮৪৪ - এর নভেম্বরে তিনি বিশস কলেজে গ্রিক , লাতিন ও সংস্কৃত াষায় শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভরতি হন ।
কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন : ১৮৪৮ - এ মধুসূদন চলে যান মাদ্রাজে এবং ব্ল্যাক টাউনের অ্যাসাইলাম স্কুলে ইংরেজির শিক্ষকরূপে যোগ দেন । বিয়ে করেন মেরি রেবেকা ম্যাকটাভিসকে । Timothy Penpoem ছদ্মনামে Madras Circular and General Chronicle , Athenaeum এবং Spectator পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগেও তিনি কাজ করতে থাকেন । পরবর্তী সময়ে Athenaeum পত্রিকা সম্পাদনা করেন । ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য The Captive Ladie । ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি Hindu Chronicle নামক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন । ১৮৫২ - তে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হাই স্কুলের শিক্ষক নিযুক্ত হন । ১৮৫৪ - তে তিনি দৈনিক Spectator পত্রিকার সহ - সম্পাদকের দায়িত্ব পান । ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বাবার মৃত্যু হয় । চার সন্তানের জননী রেবেকার সঙ্গেও এই সময়েই তাঁর আট বছর বাদে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে । পরের বছর তিনি এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়াকে বিয়ে করেন । অর্থকষ্ট ও স্থায়ী চাকরির অভাবের মধ্যেও তিনি সাহিত্যচর্চা বন্ধ করেননি । ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে তাঁর শর্মিষ্ঠা নাটক প্রকাশিত হয় । সেপ্টেম্বরে নাটকটি বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চে অভিনীতও প্রশংসিত হলে তিনি নাটক রচনায় আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন । ১৮৬০ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয় পদ্মাবতী নাটক , মে মাসে প্রকাশ পায় তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য । ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় মেঘনাদবধ কাব্য - এর প্রথম খণ্ড । এ বছর ১২ ফেব্রুয়ারি ' অমিত্রাক্ষর ছন্দ ' প্রবর্তনের জন্য তিনি কালীপ্রসন্ন সিংহের বাড়িতে সংবর্ধিত হন । মার্চ মাসে পাদরি লঙ - এর ভূমিকা - সহ By a Native ছদ্মনামে নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন । জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্য , মেঘনাদবধ কাব্য ( দ্বিতীয় খণ্ড ) এবং আত্মবিলাপ । আগস্টে প্রকাশিত হয় কৃয়কুমারী নাটক । ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকাশিত হয় । এ সময়ে তিনি কিছুদিনের জন্য হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদনাও করেন । ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে আইন পড়ার জন্য মধুসূদন ইংল্যান্ড যান । কিন্তু আবহাওয়া ও বর্ণবিদ্বেষ সহ্য করতে না পেরে জুন মাসে কবি ফ্রান্সের ভার্সাই - তে চলে যান । সেখানে তিনি চরম আর্থিক সংকটে পড়েন যা থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁকে মুক্ত করেন । এখানে বসেই মধুসূদন তাঁর বিখ্যাত সনেটগুলি রচনা করেন । ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাবলী প্রকাশিত হয় । এ বছরের ১৭ নভেম্বর তিনি ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন । ১৮৭০ - এ তিনি প্র্যাকটিস ছেড়ে প্রিভি কাউন্সিলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের পদ গ্রহণ করেন । ১৮৭১ - এর সেপ্টেম্বরে তাঁর হেক্টর বধ কাব্য প্রকাশিত হয় । এ সময় হাইকোর্টের চাকরি ছেড়ে দেন মধুসূদন এবং ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চকোট রাজার আইন উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন । আবার সেপ্টেম্বরে তিনি আইনব্যাবসায় ফিরে আসেন । সে বছরের ডিসেম্বরে বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য অর্থের বিনিময়ে মায়াকানন রচনা করেন । একই সাথে লেখা শুরু করেন তাঁর অসমাপ্ত রচনা বিষ না ধনুগুণ ।
জীবনাবসান : ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মধুসূদন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন । সে বছরই ২৯ জুন রবিবার বিকেলে মধুসূদন প্রয়াত হন ।
উৎস
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য - র প্রথম সর্গ ‘ অভিষেক ’ থেকে পাঠ্য অংশটি নির্বাচিত হয়েছে ।
সারসংক্ষেপ: পাঠ্য কবিতার সূচনাতেই দেখা যায় , সোনার আসন ছেড়ে উঠে ইন্দ্ৰজিৎ ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে প্রণাম করে তাঁর সেখানে আসার কারণ জানতে চাইছেন । ধাত্রী প্রভাষার ছদ্মবেশে আসা দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রজিৎকে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ এবং লঙ্কার দুর্দশা বিষয়ে জানান । রাবণ যে প্রতিশোধের জন্য যুদ্ধসজ্জার প্রস্তুতি নিচ্ছেন , সে - কথাও বলেন । রাতের যুদ্ধেই তিনি যাঁকে হত্যা করেছেন , সেই রামচন্দ্র কীভাবে তাঁর প্রিয় অনুজকে বধ করল , তা ভেবে ইন্দ্রজিৎ অত্যন্ত অবাক হন । দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রজিৎকে রাক্ষসদের কুল ও মান রক্ষার জন্য তাড়াতাড়ি লঙ্কায় যেতে
অনুরোধ করেন । ক্রুদ্ধ ইন্দ্রজিৎ আকস্মিক এই দুর্ঘটনার কথা শুনে নিজেকে তীব্র ধিক্কার দেন । শত্রুদল যখন লঙ্কাকে ঘিরে ধরেছে , তখন তিনি প্রমোদবিলাসে মত্ত -- এটাই ছিল তাঁর আত্মধিকারের কারণ । শত্রুবধ করে সব অপবাদ ঘোচাতে এবং লঙ্কাকে সুরক্ষিত করতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন । যুদ্ধের সাজে নিজেকে সাজিয়ে তোলেন ইন্দ্ৰজিৎ , এমন সময় স্ত্রী প্রমীলা এসে তাঁর গতি রোধ করে দাঁড়ান । ইন্দ্রজিৎকে প্রমীলা আবার যুদ্ধে যেতে দিতে চান না । আশঙ্কা প্রকাশ করেন ভবিষ্যৎ নিয়ে ৷ প্রমীলাকে আশ্বস্ত করেন ইন্দ্রজিৎ । রামচন্দ্রকে হত্যা করে শীঘ্র ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইন্দ্রজিৎ রথে করে পৌঁছে যান রাবণের কাছে । রাবণও তখন পুত্রের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ৷ সৈন্যদল ইন্দ্রজিৎকে দেখে জয়ধ্বনি করে ওঠে । বাবার কাছে রামচন্দ্রকে বধ করার কিংবা তাঁকে বন্দি করে নিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন ইন্দ্রজিৎ । কিন্তু রাবণ সেই মহাযুদ্ধে ইন্দ্রজিৎকে পাঠানোর বিষয়ে নিজের দ্বিধার কথা বলেন । ভাগ্যের বিপর্যয় এবং পুত্রের মৃত্যুর ফলে তিনি যে চিন্তিত , সে - কথাও বলেন । মৃত মানুষের পুনর্জীবন লাভ যে তাঁর বুদ্ধির অতীত এবং নিয়তিরই খেলা , তা - ও স্পষ্ট করতে চান । কিন্তু ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে যাবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । লঙ্কার কলঙ্ক দূর করাই তাঁর লক্ষ্য । কুম্ভকর্ণকে অকালে জাগিয়ে যুদ্ধে পাঠানোর ফল কী হয়েছিল তা মনে রেখেও শেষ অবধি রাবণ ইন্দ্রজিতের ইচ্ছাকে মর্যাদা দেন । শুধু তাঁকে ইষ্টদেব অগ্নির উপাসনা করে এবং নিকুম্ভিলা যজ্ঞ শেষ করে পরদিন সকালে যুদ্ধে যেতে বলেন । এরপরে গঙ্গাজল দিয়ে তিনি সেনাপতি পদে ইন্দ্রজিতের অভিষেক সম্পূর্ণ করেন ৷
নামকরণ:
কোনো সাহিত্যের অন্দরমহলে প্রবেশের চাবিকাঠি হল নামকরণ । নামকরণের মাধ্যমেই লেখক তাঁর বক্তব্যকে প্রাথমিক প্রতিষ্ঠা দেন ।
পাঠকদের ক্ষেত্রেও বিষয়বস্তু বুঝবার জন্য নামকরণ অত্যন্ত জরুরি ও সহায়ক বিষয় ৷ সাহিত্যে নামকরণ বিভিন্ন দিক থেকে হয়ে থাকে । চরিত্রধর্মী , বিষয়ধর্মী অথবা ব্যঞ্জনধর্মী – যে - কোনো বিষয় থেকেই সাহিত্যের নামকরণ সম্ভব ।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যর প্রথম সর্গের নাম ‘ অভিষেক ’ । পাঠ্য অংশটি প্রথম সর্গ থেকে গৃহীত হয়েছে , তাই প্রথম সর্গের নাম অনুসরণে এই কাব্যাংশের নাম হয়েছে অভিষেক । লঙ্কার প্রমোদকাননে ইন্দ্রজিৎ ছিলেন বিলাসে মত্ত । এমন সময় ছদ্মবেশী লক্ষ্মী তাঁকে দিলেন বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ । ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদের আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে যান ইন্দ্রজিৎ । ক্রোধে , আত্মধিক্কারে নিজের পরে থাকা কুসুমদাম , কনক বলয় , কুণ্ডল ছুড়ে ফেলেন ৷ তারপর মহাতেজে জ্বলে ওঠেন বীরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজিৎ । প্রতিজ্ঞা করেন— “ ঘুচাব এ অপবাদ , বধি রিপুকুলে । ” যুদ্ধসাজে সজ্জিত হন তিনি , দেখতে পাওয়া তাঁর মেঘবর্ণ রথ , তার চাকায় বিজলির ছটা । আকাশে উড়ন্ত ইন্দ্রধনুর মতো রাক্ষস - পতাকা । অন্যদিকে , তখন পুত্রশোকে বিহ্বল লঙ্কারাজ রাবণও যুদ্ধোন্মত্ত । মেঘনাদ উপস্থিত হলেন সেখানে এবং পিতার কাছে রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করলেন । কিন্তু রাবণ একমাত্র জীবিত পুত্রকে যুদ্ধে পাঠাতে দ্বিধাগ্রস্ত হন । মায়াবী রামের ছলনা তিনি জানেন । মরেও যে রামচন্দ্র বেঁচে উঠতে পারে তার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের আসন্ন যুদ্ধ কতদূর ফলপ্রসূ হবে — এই চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়েন লঙ্কেশ্বর রাবণ । কিন্তু ইন্দ্রজিৎ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ— “ দেখিব এবার বীর বাঁচে কি ঔষধে । ” অবশেষে রাবণ পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে “ অভিষেক করিলা কুমারে । ” অর্থাৎ কাব্যের বিষয়বস্তু যে অভিমুখে পরিচালিত হয়েছে বা যে পরিণতি লাভ করেছে তা হল ইন্দ্রজিতের সেনাপতি - পদে অভিষেক । সুতরাং বিষয়বস্তুর নিরিখে নামকরণটি সার্থক ও যথাযথ ।
অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর
প্রতিটি প্রশ্নের মান-১
১. মেঘনাদবধ কাব্য - র প্রথম সর্গের নাম কী ?
উঃ মাইকেল মধুসুদন দত্ত রচিত মেঘনাদবধ কাব্য - এর প্রথম সর্গের নাম ‘ অভিষেক ’ ।
২.“ প্রণমিয়া , ধাত্রীর চরণে , / কহিলা , ” – ইন্দ্রজিৎ কী বলেছিলেন ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে নেওয়া আলোচ্য উদ্ধৃতাংশে ইন্দ্ৰজিৎ লঙ্কার সুসংবাদ জিজ্ঞাসা করেছিলেন এবং ধাত্রীমাতা প্রভাষার প্রমোদকাননে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন ।
৩. “ ছদ্মবেশী অম্বুরাশি - সুতা উত্তরিলা ; ” –‘অম্বুরাশি - সুতা ' কে এবং কেন তার এমন নাম ?
উঃ অম্বুরাশি ” শব্দের অর্থ জলরাশি , ‘ সুতা ’ শব্দের অর্থ কন্যা । সমুদ্রমন্থনের সময় জল থেকে লক্ষ্মীর উত্থান হয়েছিল বলে তাঁকে ‘ অম্বুরাশি - সুতা ’ বা সমুদ্রের কন্যা বলা হয়েছে ।
৪. “ ছদ্মবেশী অম্বুরাশি - সুতা ” — ‘ অম্বুরাশি - সুতা ' কার ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে নেওয়া । ‘ অম্বুরাশি - সুতা ’ বা লক্ষ্মী ইন্দ্রজিতের ধাইমা প্রভাষার ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন ।
৫. “ ছদ্মবেশী অম্বুরাশি - সুতা ” কেন ইন্দ্রজিতের কাছে এসেছিলেন ?
উঃ অম্বুরাশি - সুতা ’ অর্থাৎ লক্ষ্মী ইন্দ্রজিতের কাছে এসেছিলেন তাঁকে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ দিয়ে যুদ্ধযাত্রায় উৎসাহ দিতে ।
৬. “ সসৈন্যে সাজেন আজি যুঝিতে আপনি । ” — কে সসৈন্যে সাজেন ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত হয়েছে । প্রিয়পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুতে শোকার্ত রাবণ সৈন্যদল - সহ যুদ্ধসাজে সেজে উঠছেন ।
৭ . “ জিজ্ঞাসিলা মহাবাহু বিস্ময় মানিয়া , ” এই বিস্ময়ের কারণ কী ছিল ?
উঃ রামচন্দ্রকে বধ করে ও খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলার পরেও কে বীরবাহুকে হত্যা করল — তা ভেবেই ইন্দ্রজিৎ অবাক হয়েছেন ।
৮. “ কি কহিলা ভগবতি ” — “ ভগবতি কে ?
উঃ আলোচ্য অংশে ' ভগবতি ’ হলেন ইন্দ্রজিতের ধাইমা প্রভাষার ছদ্মবেশে আসা দেবী লক্ষ্মী ।
৯. “ কে বধিল কবে / প্রিয়ানুজে ? ” – ‘ প্রিয়ানুজ ’ কাকে বলা হয়েছে ?
উঃ প্রিয়ানুজ ’ বলতে এখানে ইন্দ্রজিতের ছোটো ভাই অর্থাৎ বীরবাহুকে বোঝানো হয়েছে ।
১০. ছদ্মবেশী দেবী লক্ষ্মী কোন্ সংবাদ নিয়ে এসেছিলেন ?
উঃ ছদ্মবেশী লক্ষ্মী রাবণপুত্র বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ এবং তাতে রাবণের শোকগ্রস্ত হওয়ার খবর নিয়ে এসেছিলেন ।
১১. “ এ অদ্ভুত বারতা , ” — কোন্ ‘ বারতা ’ - র কথা বলা হয়েছে ?
উঃ যে রামচন্দ্রকে ইন্দ্রজিৎ নিশা - রণে হত্যা করেছেন , তাঁর দ্বারাই বীরবাহু নিহত হয়েছেন । এখানে ইন্দ্ৰজিৎকে দেবী লক্ষ্মীর দেওয়া এই সংবাদের কথাই বলা হয়েছে ।
১২. “ শীঘ্ৰ কহ দাসে । ” — শীঘ্র কী বলতে বলা হয়েছে ?
উঃ ছদ্মবেশী দেবী লক্ষ্মী বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ দিতে এসেছেন মেঘনাদকে । লক্ষ্মী কোথা থেকে সেই মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন তা ইন্দ্রজিৎ শীঘ্র জানাতে অনুরোধ করেছেন ।
১৩. “ রত্নাকর রত্নোত্তমা ইন্দিরা সুন্দরী / উত্তরিলা ” — ‘ ইন্দিরা সুন্দরী ’ । কে ?
উঃ ইন্দিরা ’ কথাটি এসেছে ‘ ইন্দ ’ ধাতু থেকে যার অর্থ ঐশ্বর্য । ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীকেই তাই ‘ ইন্দিরা সুন্দরী ’ বলা হয়েছে ।
১৪. “ যাও তুমি ত্বরা করি ” —এই শীঘ্র যাওয়ার প্রয়োজন কী ?
উঃ বীরবাহুর মৃত্যুর পরে লঙ্কাকে রক্ষা করতে ও রাক্ষসকুলের মান বজায় রাখতে ইন্দ্রজিৎকে শীঘ্র যুদ্ধে যেতে বলেছেন দেবী লক্ষ্মী ।
১৫. “ ... রোষে মহাবলী / মেঘনাদ ; ” – মেঘনাদ রুষ্ট হয়ে কী করেছিলেন ?
উঃ লঙ্কার এই ভীষণ বিপদের মধ্যে নিজের ভূমিকায় রুষ্ট মেঘনাদ ফুলের মালা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন , সোনার বালা খুলে দূরে ফেলে দিয়েছিলেন । তার কুণ্ডল পায়ের কাছে পড়েছিল ।
১৬. “ পদতলে পড়ি শোভিল কুণ্ডল , ” – ‘ কুণ্ডল ’ শব্দের অর্থ কী ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত । ‘ কুণ্ডল ’ শব্দের অর্থ কর্ণভূষণ অর্থাৎ কানের অলংকার ।
১৭. “ হা ধিক্ মোরে ! ” —– বক্তা কেন নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিলেন ?
উঃ শত্রুপক্ষের সৈন্য যখন লঙ্কাকে ঘিরে ফেলেছে তখন তিনি নারীদের সঙ্গে প্রমোদকাননে বিলাসে সময় কাটাচ্ছেন — এই ভেবেই ইন্দ্রজিৎ নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিলেন ।
১৮. “ বৈরিদল বেড়ে / স্বর্ণলঙ্কা , ” – কাদের বৈরিদল বলা হয়েছে ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত । এখানে রামচন্দ্র ও তাঁর সৈন্যবাহিনীকে লঙ্কাপুরী তথা রাক্ষসকুলের বৈরিদল বলা হয়েছে ৷
১৯ . “ হেথা আমি বামাদল মাঝে ? ” — ‘ হেথা ’ বলতে কোন্ স্থানের কথা বলা হয়েছে ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত । ‘ হেথা ’ বলতে স্বর্ণলঙ্কার প্রমোদ উদ্যানকেই বোঝানো হয়েছে ।
২০. “ এই কি সাজে আমারে , ” — কী সাজে না বলে বক্কার মনে হয়েছে ?
উঃ সহোদর বীরবাহুর মৃত্যু ঘটেছে এবং রামচন্দ্রের সৈন্যবাহিনী স্বর্ণলঙ্কাকে ঘিরে ফেলেছে । এরকম সময়ে তাঁর প্রমোদকাননে থাকা সাজে না বলে ইন্দ্রজিৎ মনে করেছেন ।
২১. হৈমবতীসুত কে ?
উঃ ‘ হৈমবতীসুত ’ বলতে পার্বতীর পুত্র কার্তিককে বোঝানো হয়েছে ।
২২. “ হৈমবতীসুত যথা ... ” —কীসের কথা এখানে বলা হয়েছে ?
উঃ আলোচ্য অংশে দেবসেনাপতি কার্তিকের তারকাসুর বধের কথা বলা হয়েছে ।
২৩.. “ কিম্বা যথা বৃহন্নলারূপী / কিরীটী ” — ' বৃহন্নলারূপী কিরীটী ' কাকে বলা হয়েছে ?
উঃ অভিষেক ’ পদ্যাংশে উল্লিখিত ' বৃহন্নলারূপী কিরীটি ’ হলেন মহাভারতের অন্যতম বীর যোদ্ধা অর্জুন ।
২৪. “ সাজিলা শূর শমীবৃক্ষমূলে । ” — শমিবৃক্ষ কোন্ গাছকে বলা হয় ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশে উল্লিখিত শমিবৃক্ষ হল বাকল - জাতীয় গাছ ।
২ ৫. “ বিরাটপুত্র সহ , উদ্ধারিতে / গোধন , ” – বিরাট কে এবং তার পুত্রগণের নাম লেখো ।
উঃ মহাভারতের কাহিনি অনুসারে মৎস্য দেশের রাজা ছিলেন বিরাট , তাঁর তিন পুত্রের নাম শঙ্খ , শ্বেত এবং ভূমিঞ্জয় বা উত্তর ।
২৬. “ উদ্ধারিতে / গোধন , ” -কে গোধন উদ্ধার করেছিলেন ?
উঃ অর্জুন বিরাটপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গোধন উদ্ধার করেছিলেন ।
২৭. অর্জুন কোথায় যুদ্ধসজ্জা করেছিলেন ?
উঃ মহাভারতের বিরাট পর্বে অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন অর্জুন বিরাটরাজের গোধন উদ্ধারের জন্য শমিবৃক্ষের মূলে দাঁড়িয়ে যুদ্ধসজ্জা করেছিলেন ।
২ ৮. “ ধ্বজ ইন্দ্রচাপরূপী ; ” — ইন্দ্রচাপ ’ কথার অর্থ কী ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত ৷ ‘ ইন্দ্ৰচাপ ’ কথার অর্থ হল দেবরাজ ইন্দ্রের ধনু ।
২৯.. “ হেন কালে প্রমীলা সুন্দরী , / ধরি পতি - কর - যুগ ” —প্রমীলার এই আচরণকে কবি কীসের সঙ্গে তুলনা করেছেন ?
উঃ স্বর্ণলতা যেভাবে বিশাল বনস্পতিকে জড়িয়ে রাখে , প্রমীলাও সেভাবেই স্বামী মেঘনাদের হাত জড়িয়ে ধরেছিলেন ।
৩০. “ হেন কালে প্রমীলা সুন্দরী , ” — ‘ হেন কালে ’ বলতে কোন্ সময়কে বলা হয়েছে ?
উঃ বীরবাহুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য ইন্দ্রজিৎ যখন রথে চড়ে বসেছেন , সেই সময়কে বোঝাতেই ‘ হেনকাল ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ।
৩১. “ তবু তারে রাখে পদাশ্রয়ে / যূথনাথ । ” — যূথনাথ ’ শব্দের অর্থ কী ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত অংশে উল্লিখিত ‘ যূথনাথ ’ শব্দের অর্থ হল হাতির দলের প্রধান ।
৩২. “ ব্রততী বাঁধিলে সাধে করি - পদ , ”- ‘ করি - পদ ’ শব্দটির অর্থ কী ?
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত । উল্লিখিত ‘ করি - পদ ’ শব্দটির অর্থ হল হাতির পা ।
৩৩. “ কে পারে খুলিতে / সে বাঁধে ? ” – এখানে কোন্ বন্ধনের কথা বলা হয়েছে ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশটিতে প্রমীলার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের সম্পর্কের অর্থাৎ স্বামী - স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনের কথা বলা হয়েছে ।
৩৪. “ ত্বরায় আমি আসিব ফিরিয়া ... কোথা থেকে ফিরে আসার কথা’ বলা হয়েছে ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে রামচন্দ্রকে হত্যা করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার কথা বলা বলেছেন ।
৩৫. “ বিদায় এবে দেহ বিধুমুখী ” — “ বিধুমুখী ’ কে ?
উঃ উল্লিখিত অংশে ‘ বিধুমুখী ’ বলতে ইন্দ্রজিৎ তাঁর স্ত্রী প্রমীলাকে বুঝিয়েছেন । ইন্দ্রজিতের কাছে প্রমীলার মুখ চাঁদের মতো সুন্দর বলেই এই নামকরণ ।
৩৬. “ উঠিল পবন - পথে ” —পবন - পথে কী ওঠার কথা বলা হয়েছে ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত । এখানে পবন - পথে অর্থাৎ আকাশে মেঘনাদের রথ ওঠার কথা বলা হয়েছে ।
৩৭. আকাশে ইন্দ্রজিতের রথের উড়ে চলাকে কবি কীসের সঙ্গে তুলনা করেছেন ?
উঃ আকাশে ইন্দ্রজিতের রথের উড়ে চলাকে কবি সোনার পাখা মেলে মৈনাক পর্বতের উড়ে চলার সঙ্গে তুলনা করেছেন ।
৩৮. “ পক্ষীন্দ্ৰ যথা নাদে মেঘ মাঝে / ভৈরবে । ” — পক্ষীন্দ্র কে ?
উঃ ‘ পক্ষীন্দ্র ’ শব্দের অর্থ পক্ষীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ , ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশ থেকে গৃহীত ‘ পক্ষীন্দ্র ’ শব্দটির মধ্য দিয়ে গরুড় পাখি - কে বোঝানো হচ্ছে ।
৩৯. “ উঠিছে আকাশে / কাঞ্চন - কথক - বিভা । ” — কাকে ‘ কান - কৰ্ণক বিভা ’ বলা হয়েছে ?
উঃ বীরবাহুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে লঙ্কেশ্বর রাবণ যুদ্ধসাজে সেজেছেন । রাক্ষসর্বাহিনীর রেশমি পতাকার ঔজ্জ্বল্যকে এখানে ‘ কাঞ্চন কক - বিভা ’ বলা হয়েছে ।
৪০. “ নাদিলা কর্বুরদল ... ” — কেন ‘ কর্বুরদল ’ আওয়াজ করেছিল ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে সংগৃহীত উদ্ধৃতাংশে মেঘনাদকে দেখে উল্লসিত হয়ে মহাগর্বে সৈন্যদল আওয়াজ করেছিল ।
৪১. “ নমি পুত্র পিতার চরণে , ” – পিতা ও পুত্র কে ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে নেওয়া আলোচ্য অংশে পিতা হলেন লঙ্কার রাজা রাবণ এবং পুত্র হলেন রাজপুত্র মেঘনাদ ।
৪২. “ এ মায়া , পিতঃ , বুঝিতে না পারি ! ” — কোন্ মায়া বক্তা বুঝতে পারছেন না ?
উঃ মৃত্যুর পরেও রামচন্দ্র আবার কীভাবে বেঁচে উঠলেন — সেই মায়ার ছলনা বক্তা মেঘনাদ বুঝতে পারছেন না ।
৪৩. “ সমূলে নির্মূল / করিব পামরে আজি ! ” — কাকে ‘ পামর ’ বলা হয়েছে ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত । এখানে রামচন্দ্রকে ‘ পামর ’ অর্থাৎ পাপী বলা হয়েছে ।
৪৪. “ নতুবা বাঁধিয়া আনি দিব রাজপদে । ” — কে , কাকে রাজপদে এনে দিতে চেয়েছেন ?
উঃ উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ' অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত । মেঘনাদ রামচন্দ্রকে হয় বধ করে , নইলে বেঁধে এনে রাজপদে অর্থাৎ রাবণের পায়ের কাছে দিতে চেয়েছেন ।
৪৫. “ নাহি চাহে প্ৰাণ মম ” —বক্তার প্রাণ কী চায় না ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশে আমরা দেখি , প্রাণঘাতী যুদ্ধে বারবার মেঘনাদকে পাঠাতে লঙ্কেশ্বর রাবণের প্রাণ চায় না ।
৪৫. “ বিধি বাম মম প্রতি । ” — বিধি কার প্রতি বাম ?
উঃ ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশে রাবণের কথানুযায়ী বিধি তাঁর প্রতি বিরূপ ।
ব্যাখ্যাভিত্তিক প্রশ্ন উত্তর
প্রতিটি প্রশ্নের মান-৩
১.“ কনক - আসন ত্যজি , বীরেন্দ্রকেশরী / ইন্দ্রজিৎ , ” – ইন্দ্রজিৎ কোথায় ছিলেন ? তিনি কেন কনক আসন ত্যাগ করলেন ?
উত্তরঃ ইন্দ্রজিতের অবস্থান ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশে উল্লিখিত লঙ্কার প্রমোদ উদ্যানে বিলাসব্যসনে মত্ত ছিলেন ইন্দ্রজিৎ ।
কনক - আসন ত্যাগের কারণ : লঙ্কার প্রমোদ উদ্যানে প্রমীলার সঙ্গে বিলাসব্যসনে মত্ত ছিলেন ইন্দ্ৰজিৎ । এখানেই হঠাৎ ধাত্রী প্রভাষার ছদ্মবেশে লক্ষ্মী উপস্থিত হলেন । বীরচূড়ামণি বীরবাহু যুদ্ধে নিহত হয়েছেন — এই খবরটি দিতেই ছদ্মবেশী লক্ষ্মীর প্রমোদকাননে আসা । এমন জায়গায় লক্ষ্মীর হঠাৎ আগমন ইন্দ্ৰজিৎকে অপ্রস্তুত করে তোলে । তিনি তৎক্ষণাৎ ধাত্রীর চরণে প্রণাম জানাবার উদ্দেশ্যে সোনার আসন ত্যাগ করেন ।
২. কহ দাসে লঙ্কার কুশল । ” বক্তা কে ? বক্তার এমন জিজ্ঞাসার কারণ কী ?
উত্তরঃ ’ বক্কা : ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশটির বক্তা।
আলোচ্য উক্তির কারণ : ইন্দ্রজিৎ যখন প্রমোদকাননে অবসর কাটাচ্ছিলেন , তখন হঠাৎই তাঁর সামনে ছদ্মবেশী লক্ষ্মী উপস্থিত হন । সেই সময় ওই জায়গায় ধাত্রীর আগমন ইন্দ্রজিতের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল । সেই কারণেই মেঘনাদের মনে আশঙ্কা জাগে যে , হয়তো স্বর্ণলঙ্কায় কোনো বিপদ হয়েছে । তা না হলে এভাবে আচমকা ধাত্রীমাতার আগমন ঘটত না । কৌতূহলী ও উদ্বিগ্ন ইন্দ্রজিৎ তাই ধাত্রীর চরণে প্রণাম জানিয়ে লঙ্কার কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন ।
৩.“ হায় ! পুত্র , কি আর কহিব / কনক - লঙ্কার দশা ! ” — বক্তা কে ? বক্তার এই আক্ষেপের কারণ কী ?
উত্তরঃ বক্তা : উল্লিখিত অংশের বক্তা ইন্দ্রজিতের ধাত্রীমাতা প্রভাষার ছদ্মবেশে আসা লক্ষ্মী ।
বক্তার আক্ষেপের কারণ : প্রভাষার ছদ্মবেশে এসে দেবী লক্ষ্মী শুনিয়েছিলেন স্বর্ণলঙ্কার করুণ পরিণতির কথা । রামচন্দ্রের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধে মারা গেছেন মেঘনাদের ছোটো ভাই বীরবাহু । পুত্রশোকে আকুল হয়ে রাজা রাবণ স্বয়ং যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । লঙ্কার এমনই দুর্ভাগ্য যে , স্বয়ং রাজাকে যুদ্ধযাত্রা করতে হচ্ছে । লঙ্কার এই দুরবস্থায় দেবী লক্ষ্মী বিচলিত । তাই তার কণ্ঠস্বরে আক্ষেপের সুর ফুটে উঠেছে ।
৪. “ জিজ্ঞাসিলা মহাবাহু বিস্ময় মানিয়া : ” কাকে ' মহাবাহু ’ বলা হয়েছে ? তার বিস্ময়ের কারণ কী ?
উত্তরঃ ' মহাবাহু ’ - র পরিচয় । আলোচ্য অংশে রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎকে ‘ মহাবাহু ’ বলা হয়েছে । P
বিস্ময়ের কারণ প্রমোদকাননে এসে দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্ৰজিৎকে বীরবাহুর মৃত্যসংবাদ জানান । কিন্তু ইন্দ্রজিতের কাছে রামের হাতে বীরবাহুর এই মৃত্যুর ঘটনা ছিল চূড়ান্ত অবিশ্বাস্য , কারণ এর আগেই রাত্রিকালীন যুদ্ধে ইন্দ্রজিৎ রামচন্দ্রকে বধ করেছেন । তাই রামচন্দ্রের দ্বারা বীরবাহুর নিহত হওয়ার সংবাদ তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত এবং অবিশ্বাস্য । সেকারণেই লক্ষ্মীর কথা তাঁর ‘ অদ্ভুত ’ লেগেছে এবং তিনি বিস্মিত হয়েছেন ।
৫. “ এ অদ্ভুত বারতা , জননী / কোথায় পাইলে তুমি , শীঘ্র কহ দাসে । ” — কোন্ বাতার কথা বলা হয়েছে ? বক্তার কাছে সেই বার্তা অদ্ভুত মনে হয়েছে কেন ?
উত্তরঃ বক্তা : ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশ থেকে গৃহীত আলোচ্য অংশে বীরচূড়ামণি বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদের কথা বলা হয়েছে ।
বার্তা কেন অদ্ভুত : ইতিপূর্বেই ইন্দ্রজিৎ রাত্রিকালীন যুদ্ধে রামচন্দ্রকে হত্যা করেছেন ৷ শত্রুশিবিরে প্রচণ্ড শরনিক্ষেপ করে তিনি রামচন্দ্রকে টুকরো টুকরো করেছিলেন ৷ অথচ তারপরে , ধাত্রীরূপী লক্ষ্মী সেই রামচন্দ্রের হাতে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ শুনিয়েছেন ইন্দ্রজিতকে । মৃত রামচন্দ্রের পক্ষে পুনর্জীবিত হয়ে বীরবাহুকে হত্যা করা কোেনামতেই সম্ভব নয় । এই কারণেই বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ ইন্দ্রজিতের কাছে ‘ অদ্ভুত ’ মনে হয়েছে ।
৬. “ ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী ” —‘মহাবলী ’ কে ? এই ‘ রোষ ’ - এর প্রকাশ কীভাবে ঘটেছিল লেখো ।
উত্তরঃ মহাবলীর পরিচয় এখানে ‘ মহাবলী ’ বলতে বীর ইন্দ্ৰজিৎকে বোঝানো হয়েছে ।
মহাবলীর রোষের প্রকাশ : রামচন্দ্র পুনর্জীবন লাভ করে ইন্দ্রজিতের ভাই বীরবাহুকে বধ করেছেন , ফলে পিতা রাবণের এরূপ শোকাকুল অবস্থার সময় তিনি প্রমোদবিলাসে মত্ত — এই কথা মনে করে মেঘনাদ নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন । হাতের ফুলরাশি ছিঁড়ে ফেলেছেন , সোনার বালা দূরে ফেলে দিয়েছেন , পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে কুণ্ডল । এভাবে ক্রোধের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রজিৎ রাক্ষসকুলের অপবাদ দূর করার জন্য শপথ গ্রহণ করেন ।
৭. “ “ ধিক্ মোরে ’ , কহিলা গম্ভীরে / কুমার , ” – ‘ কুমার ’ কে ? তার এই আত্মধিক্কারের কারণ কী ?
উত্তরঃ ‘ কুমার ’ - এর পরিচয় । আলোচ্য পঙ্ক্তিটিতে ‘ কুমার ’ বলতে ইন্দ্ৰজিৎকে বোঝানো হয়েছে
কুমার ’ - এর আত্মধিক্কারের কারণ : বীরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজিৎ লঙ্কার প্রমোদকাননে বিলাসব্যসনে মত্ত হয়েছিলেন । এই অবসরে রামচন্দ্র বীরবাহুকে যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করেন । শত্রুসৈন্য যখন লঙ্কাকে ঘিরে ফেলেছে তখন তিনি বিলাসিতায় সময় কাটাচ্ছেন — এই কথা ভেবেই ইন্দ্রজিৎ নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন । তীব্র অনুশোচনা থেকে লঙ্কার এই দুর্দিনের জন্য নিজেকে দায়ী করে ইন্দ্রজিৎ আত্মধিক্কার করেন ।
৮. “ সাজিলা রথীন্দ্রভ বীর আভরণে , ” — ‘ রথীন্দ্রভ ’ কথাটির অর্থ কী ? এই সেজে ওঠার বর্ণনা দাও ।
উত্তরঃ ‘ রথীন্দ্রর্ষভ ’ কথাটির অর্থ : ‘ রথীন্দ্রভ ’ কথাটিকে ভাঙলে পাওয়া যায় , রথীন্দ্র ঋষভের ন্যায় , এককথায় যার অর্থ বীরশ্রেষ্ঠ । ।
ইন্দ্রজিতের যুদ্ধসাজের বর্ণনা : ইন্দ্রজিতের যুদ্ধসজ্জার প্রস্তুতিকে কবি তুলনা করেছেন দেবসেনাপতি কার্তিকের তারকাসুর বধকালের কিংবা বৃহন্নলারূপী অর্জুনের গোধন উদ্ধারের জন্য কৌরবদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতির সঙ্গে । ইন্দ্রজিতের রথ ছিল মেঘবর্ণ , চক্রে ছিল বিজলির ছটা , ধ্বজ ইন্দ্রধনুর মতো আর অশ্বেরা ছিল দ্রুতগতি । সেই রথের উড়ে চলা যেন মৈনাক পর্বতের মতো । ইন্দ্রজিতের ধনুকের টংকারে সারা পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল ।
৯. “ কহিলা কাঁদিয়া ধনি ” – ‘ ধনি ’ কে ? সে কেঁদে কী বলেছিল ? ১ + ২
উত্তরঃ ‘ ধনি’র পরিচয় : উল্লিখিত অংশে ‘ ধনি ’ বলতে ইন্দ্রজিতের স্ত্রী প্রমীলাকে বোঝানো হয়েছে ।
‘ ধনি ’ - র বক্তব্য : যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত স্বামী ইন্দ্রজিতের কাছে প্রমীলা জানতে চেয়েছিল যে তাকে ফেলে রেখে ইন্দ্রজিৎ কোথায় চলেছেন । ইন্দ্রজিতের বিরহে তার পক্ষে প্রাণ ধারণ করা যে সম্ভব নয় তাও প্রমীলা জানায় । হাতির উপমা ব্যবহার করে প্রমীলা বলে যে , গভীর অরণ্যে কোনো লতা যদি হাতির পা - কে বেষ্টন করে , তবে তার প্রতি মনোযোগী না হলেও হাতি সেই লতাকে ফেলে দেয় না । তাহলে কীভাবে দাসী প্রমীলাকে ইন্দ্ৰজিৎ ত্যাগ করে যাচ্ছেন— এই প্রশ্নই প্রমীলা ইন্দ্ৰজিৎ - কে করে ।
১০. “ কেমনে ধরিবে প্রাণ তোমার বিরহে / এ অভাগী ? ” — বক্তা কে ? কোন্ প্রসঙ্গে বক্তা এ কথা বলেছেন ? ১ + ২
উত্তরঃ বক্তা : ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত আলোচ্য উদ্ধৃতিটির বক্তা হলেন ইন্দ্রজিতের পত্নী প্রমীলা ।
প্রসঙ্গ : বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদে ইন্দ্রজিৎ ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । প্রতিশোধ নিতে তিনি যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত হন । এই সময় প্রমীলা তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়ান । স্বামীকে ছেড়ে লঙ্কার এই দুর্দশার দিনে তাঁর পক্ষে একলা বেঁচে থাকা যে সম্ভব নয় , এই প্রসঙ্গে প্রমীলা সে - কথাই জানিয়ে দিয়েছেন ।
১১. “ হাসি উত্তরিলা / মেঘনাদ , " – মেঘনাদকী দিয়েছিলেন ? তার হাসির কারণ কী ?
উত্তরঃ মেঘনাদের উত্তর : বীরবাহুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ইন্দ্ৰজিং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলে প্রমীলা ইন্দ্ৰজিৎ - কে তাঁকে ত্যাগ করে যেতে নিষেধ করেন । কারণ , যুদ্ধক্ষেত্রে গেলে ফেরার সম্ভাবনা খুব কম । এর উত্তরে ইন্দ্ৰজিৎ বলেন যে , ভালোবাসার যে দৃঢ় বন্ধনে প্রমীলা তাঁকে বেঁধেছেন , তা কেউ খুলতে পারবে না । প্রমীলার কল্যাণেই ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধে জয় লাভ করে অক্ষত শরীরে আবার ফিরে আসবেন ।
মেঘনাদের হাসির কারণ : হাসির মাধ্যমে ইন্দ্রজিং বোঝাতে চেয়েছেন যে , প্রমীলার আশঙ্কা ভিত্তিহীন । তিনি ত্রিভুবনবিজয়ী বীর , তাই সামান্য মানব রামচক্রের সঙ্গে যুদ্ধ করাটা তাঁর পক্ষে কঠিন নয় ।
১২. “ বিদায় এবে দেহ , বিধুমুখী । ” — বিধুমুখী ’ কে ? তার কাছে কেন বিদায় চাওয়া হয়েছে ?
উত্তরঃ ‘ বিধুমুখী’র পরিচয় : চাঁদের মতো সুন্দরী স্ত্রীকে ইন্দ্রজিৎ ‘ বিধুমুখী ’ বলে সম্বোধন করেছেন ।
বিদায় চাওয়ার কারণ : ছোটো ভাই বীরবাহু রামচন্দ্রের হাতে যুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং তার শোকে পিতা রাবণ যুদ্ধসজ্জা করছেন । এ কথা শুনে ইন্দ্রজিং যুদ্ধযাত্রার উদ্যোগ নেন । এই সময় প্রমীলা তাঁকে যুদ্ধে যেতে বাধা দিলে ইন্দ্রজিং তাঁকে বলেন যে রামচন্দ্রকে বধ করে তিনি লঙ্কায় দ্রুত ফিরে আসবেন । এর জন্যই তিনি প্রমীলার কাছে বিদায়ের অনুমতি প্রার্থনা করেন ।
১৩. “ কাপিলা লঙ্কা , কাপিলা জলধি ! ” — এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট আলোচনা করো ।
উত্তরঃ উদ্ধৃত উক্কির প্রেক্ষাপট : অনুজ বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ শুনে মেঘনাদ যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন । তাঁর রথের চলা যেন সোনার পাখা বিস্তার করা মৈনাক পর্বতের মতো , আকাশকে উজ্জ্বল করে , বায়ুপথে প্রবল শব্দে চলতে থাকে । ধনুকের ছিলায় টান দিতেই টংকারধ্বনি ওঠে , অনেকটা মেঘের মধ্যে পক্ষীন্দ্র গরুড়ের চিৎকারের মতোই আওয়াজ হয় । আর ধনুকের সেই টংকারে লঙ্কা এবং সমুদ্রে কম্পন সৃষ্টি হয় ।
১৪. “ সাজিছে রাবণ রাজা , ” – রাবণের এই যম্প্রসজ্জার বর্ণনা দাও ।
উত্তর রাবণের যুদ্ধসজ্জা : পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শোক কাটিয়ে রাবণ যুদ্ধসজ্জার প্রস্তুতি এবং প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নেন । যুদ্ধের সূচনা বোঝাতে বাজনা বেজে ওঠে । সেই সঙ্গে হাতিরা গর্জন করে , অশ্বেরা হ্রেষাধ্বনি করে , পদাতিক , রথী ইত্যাদি রাবণের সেনাবাহিনীও যুদ্ধের উত্তেজনায় হুংকারধ্বনি করে । রেশমবস্ত্রের রাজপতাকা আকাশে উড়তে থাকে , তার সঙ্গে দীপ্তি ছড়ায় স্বর্ণবর্মের আভা । সব মিলিয়ে রাবণের যুদ্ধসজ্জার কারণে চারিদিকে এক বীরভাবের পরিবেশ তৈরি হয় ।
১৫. “ নাদিলা কর্বুরদল হেরি বীরবরে / মহাগবে । ” — কাদের ‘ কর্বুরদল ’ বলা হয়েছে ? বীরবরকে দেখে তাদের গর্বের কারণ কী ? ১ + ২
উত্তরঃ ‘ কর্বুরদল ’ - এর পরিচয় : লঙ্কার রাক্ষসবাহিনীকে ‘ কর্বুরদল ’ বলা হয়েছে । । কর্বুরদলের গর্বের কারণ : পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে লঙ্কেশ্বর রাবণ যুদ্ধের সাজে সেজেছেন । তাঁর সৈন্যবাহিনীও যুদ্ধের উন্মাদনায় মেতে উঠেছে । সেই সময় সহোদর বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ শুনে ইন্দ্রজিৎ সেখানে আসেন । ইন্দ্রজিৎকে দেখে সৈন্যরা উল্লসিত হয় । কারণ ইন্দ্রজিতের রণকৌশল এবং বীরত্ব সম্পর্কে তারা অবহিত । স্বয়ং দেবরাজ ইদ্রকে তিনি পরাজিত করেছেন । লঙ্কার শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধা তিনি । তাই তাঁকে পেয়ে রাক্ষসবাহিনী ভরসা পেয়েছে এবং উৎসাহ ও গর্ববোধ করেছে ।
১৬. “ এ মায়া , পিতঃ , বুঝিতে না পারি ! ” –বক্তা কে ? কোন্ মায়া সে বুঝতে পারছে না ? ১ + ২
উত্তরঃ বক্তার : আলোচ্য উদ্ধৃতিটির বক্তা হলেন রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ । ‘ মায়া’র স্বরূপ : রামচন্দ্রের হাতে বীরবাহুর মৃত্যু — এই সংবাদ ইন্দ্রজিতের কাছে ছিল অবিশ্বাস্য । কারণ এর আগেই রাত্রিকালীন যুদ্ধে তিনি রামচন্দ্রকে বধ করেছেন । মৃত্যুর পরে রামচন্দ্রের এই পুনর্জীবন লাভ ইন্দ্রজিতের কাছে ছিল স্বাভাবিক বুদ্ধির অতীত । তিনি বুঝতে পেরেছেন , দৈব সাহায্য ছাড়া এই অসম্ভব ঘটনা সম্ভব নয় । এর মধ্যে সম্ভবত রামচন্দ্রের প্রতি মায়াদেবীর যে আশীর্বাদ রয়েছে , সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে ।
১৭. “ এ কাল সমরে , / নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা / বারম্বার । ” — ‘ কাল সমরে ' বলতে বক্তা কী বুঝিয়েছেন ? সেখানে ইন্দ্রজিৎকে পাঠাতে বক্তা দ্বিধাগ্রস্ত কেন ? ১ + ২
উত্তরঃ ' কাল সমরে'র অর্থ : ' কাল সমরে ’ বলতে প্রাণঘাতী ভয়ংকর যুদ্ধকে বোঝানো হয়েছে , যে যুদ্ধে ইন্দ্রজিতের প্রতিপক্ষ রামচন্দ্র ।
বক্তার দ্বিধার কারণ : বীরবাহুর মৃত্যুর পরে ইন্দ্রজিৎই ছিলেন ‘ রাক্ষস - কুল - ভরসা ’ । তাঁকে বাদ দিলে লঙ্কা একেবারেই বীরশূন্য । তা ছাড়া বিধিও রাবণের প্রতি বিরূপ । তা না হলে মৃত্যুর পরেও রামচন্দ্র পুনর্জীবন লাভ করতে পারেন না । তাই লঙ্কেশ্বর রাবণ চারদিকের এই প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁর একমাত্র জীবিত পুত্র ইন্দ্রজিৎকে যুদ্ধে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করছিলেন ।
১৮. “ হায় , বিধি বাম মম প্রতি । ” –বক্তা কে ? তিনি এমন কথা বলেছেন কেন ?
উত্তরঃ বক্কার পরিচয় : আলোচ্য উদ্ধৃতাংশটির বক্তা লঙ্কারাজ রাবণ ।
আলোচ্য বক্তব্যের কারণ : ভাই বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদে বিচলিত ইন্দ্রজিৎ রাবণের কাছে আসেন এবং রামচন্দ্রকে ‘ সমূলে নির্মূল ’ করার জন্য অনুমতি চান । পুত্রশোকে কাতর রাবণ নতুন করে পুত্রশোকের সামনে দাঁড়াতে চান না বলেই এ বিষয়ে নিজের অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।– “ কাল সমরে , / নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা / বারম্বার । ” ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত রামচন্দ্রের পুনর্জীবন লাভ তাঁকে হতাশ করে । সব কিছুর মধ্যে তিনি নিয়তির বিরূপতাকেই লক্ষ করেন ।
১৯. “ ... এ কলঙ্ক , পিতঃ , ঘুষিবে জগতে । ” –বক্তার এই মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো ।
উত্তরঃ লঙ্কার রাজপুরীতে রামচন্দ্রের আক্রমণ এবং বীরবাহুর মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনায় রাক্ষস রাজবংশের মর্যাদার হানি হয়েছে বলে ইন্দ্ৰজিৎ মনে করেছেন । তিনি নিজে রামচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব নিতে চান । আগে দু - বার যে রামচন্দ্রকে তিনি পরাজিত করেছেন , তাঁকে তৃতীয়বারের মতো পরাজিত করার জন্য ইন্দ্রজিৎ রাবণের অনুমতি চান । নিয়তির বিরূপতার কথা বলে রাবণ দ্বিধা দেখালে ইন্দ্রজিৎ বলেন যে তিনি জীবিত থাকতে পিতা রাবণ যদি যুদ্ধে যান তা লঙ্কার কলঙ্ক রচনা করবে এবং পৃথিবীতে তা প্রচারিত হবে ।
২০. “ হাসিবে মেঘবাহন । ” -মেঘবাহন কে ? সে হাসবে কেন ?
উত্তরঃ মেঘবাহনের পরিচয় : ‘ মেঘবাহন ’ হলেন দেবরাজ ইন্দ্র ।
মেঘবাহনের হাসির কারণ : ইন্দ্রজিৎ একবার যুদ্ধে ইন্দ্রকে পরাজিত করেছিলেন । সেই ইন্দ্রজিৎ বেঁচে থাকতে বীরবাহুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে রাবণ যদি যুদ্ধে যান তবে তা ইন্দ্রজিতের ভীরুতাকেই প্রতিষ্ঠিত করবে । রাবণ একের পর এক প্রিয়জনকে হারানোর কারণে ভীত হয়ে ইন্দ্রজিৎ - কে যুদ্ধে আর পাঠাতে চান না । অন্যদিকে ইন্দ্রজিৎ মনে করেন যে তিনি থাকা সত্ত্বেও পিতা রাবণ যুদ্ধে গেলে তার কাপুরুষতাই প্রতিষ্ঠা পাবে । আর সে জন্যই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দ্র ব্যঙ্গের হাসি হাসবে ।
বিশ্লেষণধর্মী ও রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর
প্রতিটি প্রশ্নের মান-৫
১.“ কি হেতু , মাতঃ , গতি তব আজি / এ ভবনে ? ” — কে , কাকে উদ্দেশ্য করে কখন মন্তব্যটি করেছিলেন ? এর কোন উত্তর তিনি পেয়েছিলেন ?
উত্তরঃ বক্তা এবং উদ্দিষ্ট ব্যক্মি : মেঘনাদবধ কাব্যর প্রথম সর্গ থেকে সংকলিত ' অভিষেক ' শীর্ষক কবিতায় রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ প্রভাষা রাক্ষসীর ছদ্মবেশে আসা দেবী লক্ষ্মীকে উদ্দেশ্য করে মন্তব্যটি করেছেন ।
• মন্তব্যকাল : বীরবাহু লঙ্কার প্রমোদ উদ্যানে যখন অবসর কাটাচ্ছিলেন সেই সময় রামচন্দ্র বীরবাহুকে হত্যা করেন । এই দুঃসংবাদ ইন্দ্রজিতের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্যই প্রভাষার ছদ্মবেশে ইন্দ্রজিতের কাছে আসেন দেবী লক্ষ্মী । এই সময়েই প্রমোদ উদ্যানে ধাত্রীমাতার আসার কারণ জানতে চেয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎ ।
• প্রত্যুত্তর : দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রজিৎকে লঙ্কার বর্তমান অবস্থার কথা জানান । ইন্দ্রজিতের অনুপস্থিতিতে লঙ্কার উপর ঘনিয়ে এসেছে ঘোর বিপদ ৷ রামচন্দ্রের সাথে ভয়ংকর যুদ্ধে নিহত হয়েছেন ইন্দ্রজিতের অনুজ বীরবাহু । রাক্ষসরাজ রাবণ প্রিয় পুত্রের মৃত্যতে গভীরভাবে শোকাহত । পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনি স্বয়ং যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । এ কথা শুনে বিস্মিত ইন্দ্ৰজিৎ জানতে চান রামচন্দ্র কীভাবে পুনর্জীবিত হয়ে উঠলেন ৷ ‘ মায়াবী মানব ’ রামের ছলনার কথা বলে লক্ষ্মী তাঁকে শীঘ্রই যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে অনুরোধ করেন ।
২.“ ... এ অদ্ভুত বারতা , জননি / কোথায় পাইলে তুমি , ” কোন্ বার্তাকে কেন অদ্ভুত বলা হয়েছে ? এই বার্তার পিছনে উদ্দেশ্য কী ছিল ? ৩ + ২
উত্তরঃ বার্তা : মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশে প্রভাষা রাক্ষসীর ছদ্মবেশ ধারণ করে দেবী লক্ষ্মী প্রমোদকাননে এসে ইন্দ্রজিতকে রামচন্দ্রের দ্বারা বীরবাহুর নিহত হওয়ার সংবাদ জানান । এই দুঃসংবাদকেই ইন্দ্ৰজিৎ ‘ অদ্ভুত ’ বলে অভিহিত করেছেন ৷
অদ্ভুত বলার কারণ : ইন্দ্রজিতের কাছে রামচন্দ্রের হাতে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ ছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা । কারণ , এর আগে দু - বার রামচন্দ্র তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছেন । কিছুক্ষণ আগেই রাত্রিকালীন যুদ্ধে তিনি রামচন্দ্রকে বধ করেছেন । তির ছুঁড়ে রামচন্দ্রকে হত্যার পরেও কীভাবে সেই রামচন্দ্রই বেঁচে উঠে বীরবাহুকে হত্যা করেছিলেন , তা ইন্দ্রজিতের কাছে খুবই বিস্ময়ের মনে হয়েছে । তাই এই ঘটনাকে তিনি ‘ অদ্ভুত ’ বলেছেন ।
• বার্তার পিছনে উদ্দেশ্য : লঙ্কার চরমতম দুর্দশার সময়ে লঙ্কার রাজলক্ষী ইন্দ্রজিৎকে লঙ্কায় ফেরত নিয়ে আসতে চান । নিয়তির বিধান কার্যকর করার জন্যই তাঁর এই উদ্যোগ । এই উদ্দেশ্য নিয়েই ধাত্রী প্রভাষার ছদ্মবেশে লক্ষ্মী প্রমোদ - উদ্যানে মেঘনাদের কাছে যান এবং তাঁকে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ দেন । তাঁর লক্ষ্য ছিল লঙ্কার দুর্দশা এবং ছোটো ভাই বীরবাহুর শোকে ইন্দ্রজিৎকে অস্থির করে তাঁকে লঙ্কার আসতে বাধ্য করা ।
৩. “ ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী ’ ’ –‘মহাবলী ’ কাকে বলা হয়েছে ? তিনি কী কারণে রুষ্ট হয়েছিলেন ? রোধে তিনি কী কী করলেন ?
উত্তরঃ ‘ মহাবলী’র পরিচয় : মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশের প্রশ্নোবৃত অংশে ‘ মহাবলী ’ বলতে রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎকে বোঝানো হয়েছে ।
মহাবলীর রোষের কারণ : প্রভাষা রাক্ষসীর ছদ্মবেশ ধারণ করে এসে দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রজিৎকে তাঁর ভাই বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছিলেন । একইসঙ্গে বলেছিলেন যে , লঙ্কার এই বিপদের সময় শোকগ্রস্ত রাজা রাবণ সৈন্য - সহ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন । প্রমোদকাননে বিলাসমত্ত ইন্দ্রজিতের পক্ষে এ কথা সহ্য করা সম্ভব ছিল না । নিজের বংশের এই দুর্দশা তাঁকে যতটা ক্ষুব্ধ করেছিল তার থেকে বেশি ক্ষোভ হয়েছিল তাঁর নিজের প্রতি । লঙ্কার বিপদের দিনে নিজের দায়িত্ব পালন না করতে পারাই ইন্দ্রজিতকে ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট করে তোলে ।
রুষ্ট ইন্দ্রজিতের আচরণ : নিজের ঔদাসীন্যে ক্রুদ্ধ হয়ে মেঘনাদ তাঁর ফুলের মালা ছিঁড়ে ফেলেন । হাতে থাকা সোনার বালা দূরে ছুঁড়ে দেন । তাঁর কুণ্ডল পায়ের কাছে পড়ে থাকে । নিজেকে ধিক্কার দিয়ে ইন্দ্ৰজিৎ বলেন যে , শত্রুসৈন্য যখন স্বর্ণলঙ্কা ঘিরে রেখেছে তখন তিনি রমণীসান্নিধ্যে রয়েছেন — এ দৃশ্য তাঁর মতো বীরকে মানায় না । তিনি রাবণের পুত্র । তাই শীঘ্র রথ আনার নির্দেশ দিয়ে ইন্দ্ৰজিৎ বলেন— “ ঘুচাব এ অপবাদ বধি রিপুকূলে । ” অর্থাৎ শত্রুকে বধ করেই ইন্দ্রজিৎ লঙ্কার তথা তাঁর নিজের কলঙ্ক দূর করার কথা বলেন ।
৪. “ এই কি সাজে আমারে , দশাননাত্মজ / আমি ইন্দ্ৰজিৎ ? ” কোন্ প্রসঙ্গে বক্তা কথাটি বলেছেন ? উদ্ধৃত কথায় বক্তার চারিত্রিক কোন্ গুণের পরিচয় পাওয়া যায় ?
উত্তরঃ প্রসঙ্গ : লঙ্কার প্রমোদ কাননে আগতা দেবী লক্ষ্মীর থেকে ইন্দ্রজিৎ জানতে পারেন যে রামচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁর ভাই বীরবাহুর মৃত্যু হয়েছে এবং শোকার্ত পিতা রাবণ যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । প্রমোদ - উদ্যানে বিলাসমত্ত ইন্দ্রজিতের মনে এই ঘটনা গভীর ক্ষোভ ও অনুশোচনা তৈরি করে । যখন শত্রুসৈন্য লঙ্কাপুরীকে ঘিরে ফেলেছে সেই সময়ে তিনি বিলাসে সময় কাটাচ্ছেন — এটাই ছিল ইন্দ্রজিতের অনুশোচনার কারণ । রাজা রাবণের পুত্র হিসেবে তাঁকে যে এটা মানায় না তা ইন্দ্ৰজিৎ উপলব্ধি করেছিলেন ।
বক্কার চারিত্রিক গুণাবলি : ইন্দ্রজিতের উপলব্ধি এবং আচরণের মধ্য দিয়ে তাঁর আদর্শবোধ এবং দায়বদ্ধতারই প্রকাশ ঘটে । নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইন্দ্রজিৎ দ্বিধা করেননি । আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে ইন্দ্রজিৎ চরিত্রটিই মহান হয়ে উঠেছে । শত্রুসৈন্যদের বধ করে সমস্ত ‘ অপবাদ ’ দূর করতে চেয়েছেন ইন্দ্রজিৎ । বীরধর্মের পথে তার এই যাত্রা । নিজেকে ‘ দশাননাত্মজ ’ অর্থাৎ রাবণের পুত্র বলার মধ্যে দিয়ে পিতার প্রতি এবং নিজের রাজবংশের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধারও প্রকাশ ঘটেছে ।
৫. “ ঘুচাব এ অপবাদ , বধি রিপুকুলে । ” — এখানে কোন্ অপবাদের কথা বলা হয়েছে ? এই অপবাদ ঘোচানোর জন্য বক্তা কী প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ? ৩ + ২
উত্তরঃ উল্লিখিত অপবাদ : মেঘনাদবধ কাব্য - র প্রথম সর্গ ‘ অভিষেক ’ - এ ইন্দ্ৰজিৎ যখন প্রমোদকাননে বিলাসে মত্ত তখনই লক্ষ্মী সেখানে আসেন এবং তাঁকে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ দেন । ইন্দ্রজিতের মনে হয় , রাক্ষসবংশের গৌরবকে বিনষ্ট করে রামচন্দ্রের সৈন্যরা যখন লঙ্কাকে ঘিরে রয়েছে , তখন তাঁর এই বিলাসে সময় কাটানোর ঘটনা ধিক্কারজনক । উপরন্তু , তিনি লক্ষ্মীর মুখ থেকে এ - ও জানতে পারেন যে , তিনি প্রমোদকাননে মত্ত থাকায় তাঁর পিতা নিজে যুদ্ধের সাজে সাজছেন । তাঁর মতো উপযুক্ত এবং বীর পুত্র বেঁচে থাকতেও রাজা রাবণকেই যদি যুদ্ধযাত্রা করতে হয় , তবে তা খুবই অপমানের । রাবণের পুত্র হিসেবে তাঁর নিজের এই আচরণ ইন্দ্রজিৎ মেনে নিতে পারেননি । একে তিনি লঙ্কার রাজবংশের ‘ অপবাদ ’ বলে চিহ্নিত করেছেন ।
অপবাদ ঘোচাতে বক্তার প্রস্তুতি : শত্রুসৈন্যদের বধ করে ইন্দ্রজিৎ এই অপবাদ দূর করতে উদ্যোগী হন । বীরের সাজে তিনি সেজে ওঠেন । মেঘবর্ণ রথ , চক্রে বিজলির দীপ্তি , ইন্দ্রধনুর ন্যায় উজ্জ্বল রথের পতাকা , দ্রুতগতির অশ্ববাহিনী — এইসব নিয়েই সেজে উঠেছিলেন ইন্দ্রজিৎ । তীব্র রাগে যখন ধনুকে টংকার দিয়েছিলেন , মনে হয়েছিল যেন মেঘের মধ্যে গরুড় পাখি চিৎকার করে উঠছে । বীরভাবের এই আদর্শ তুলে ধরার মধ্যেই ইন্দ্রজিতের অপবাদ ঘোচানোর চেষ্টা লক্ষ করা যায় ।
৬. “ সাজিলা রথীন্দ্রষভ বীর - আভরণে , ” – এই সজ্জার বর্ণনায় কবি যে দুটি পৌরাণিক প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন সেগুলির বর্ণনা দাও ।
উত্তরঃ প্রাক্কথন : মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ নামক কাব্যাংশে বীরবাহুর মৃত্যুর পরে লঙ্কার মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য ইন্দ্রজিৎ বীরের সাজে সেজে ওঠেন । ইন্দ্রজিতের যুদ্ধসজ্জার বর্ণনা দিতে গিয়ে দুটি পৌরাণিক প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন কবি—
পৌরাণিক প্রসঙ্গ ১ : কার্তিকেয় কর্তৃক তারকাসুর বধের প্রসঙ্গ । তারকাসুরের অত্যাচারে বিপন্ন দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে ব্রহ্লা বিধান দেন যে , শিবের ঔরসজাত সন্তানই তারকাসুরকে বধ করতে পারবে । ছ জন কৃত্তিকার গর্ভে শিবের ছয় সন্তানের জন্ম হলেও তাঁদের মিলিত করে এক পুত্র সৃজিত হয় , তাঁর নাম হয় কার্তিকেয় ৷ দেবী বসুন্ধরা তাঁকে পুত্র = হিসেবে গ্রহণ করেন এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তিনি দেবসেনাপতি পদে নিযুক্ত হন ও তারকাসুরকে নিহত করেন ।
পৌরাণিক প্রসঙ্গ ২ : অর্জুনের গোধন উদ্ধারের প্রসঙ্গ । পাণ্ডবেরা যখন বিরাট রাজার গৃহে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন , সেই সময় কৌরবরা বিরাটের গোধন হরণের জন্য তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেন । বিরাট যুদ্ধে পরাজিত এবং বন্দি হলে বৃহন্নলারূপী অর্জুন গোধন রক্ষা করতে যান । কুরুসৈন্যের সংখ্যা দেখে ভীত উত্তর পালাতে চাইলে অর্জুন ছদ্মবেশ নেওয়ার সময়ে যে শমিবৃক্ষে অস্ত্রাদি লুকিয়ে রেখেছিলেন সেখানে তাকে নিয়ে যান এবং সেগুলি গ্রহণ করে ক্লীববেশ ত্যাগ করে বীরবেশে সজ্জিত হয়ে কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যান ।
রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে মেঘনাদের যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি প্রসঙ্গে কবি এই দুটি প্রসঙ্গ এনেছেন ৷
৬.“ তবে কেন তুমি , গুণনিধি , / ত্যজ কিঙ্করীরে আজি ? ” কে কখন কথাটি বলেছেন ? তাঁকে কী সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছিল ? ৩ + ২
উত্তরঃ বক্তা এবং সময়কাল : ছদ্মবেশী লক্ষ্মীর কাছে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ শুনে ইন্দ্রজিৎ ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে লঙ্কার রাজসভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । ইন্দ্রজিৎ যখন রথে আরোহণ করছেন তখনই সেখানে তাঁর স্ত্রী প্রমীলার আবির্ভাব ঘটে ৷
তাঁকে ছেড়ে না যাওয়ার জন্য তিনি ইন্দ্রজিতকে অনুরোধ করেন । ইন্দ্রজিৎ - কে ছাড়া তাঁর পক্ষে বেঁচে থাকাই যে সম্ভব নয় , তাও বলেন । গভীর অরণ্যে হাতির পায়ে লতা জড়িয়ে গেলে তাতে হাতি মন না দিলেও লতাকে ত্যাগ করে না । তুচ্ছ হলেও হাতি তাকে পা থেকে সরিয়ে ফেলে না । তার পায়ে সেই লতার বন্ধন জড়িয়েই থাকে । অথচ ইন্দ্ৰজিৎ আপন স্ত্রীকে একা ফেলে রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে চলেছেন । ইন্দ্রজিতের তাকে ছেড়ে যাওয়াকে অনুচিত কর্ম বলে বোঝাতে চেয়েছিলেন প্রমীলা ।
প্রমীলাকে দেওয়া সান্ত্বনা: প্রমীলাকে সান্ত্বনা দিতে ইন্দ্রজিৎ বলেন যে , প্রমীলা তাঁকে প্রেমের যে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধেছেন তা খোলার ক্ষমতা কারও নেই । একইসঙ্গে ইন্দ্রজিৎ এও বলেন যে প্রমীলার কল্যাণের কারণেই তিনি অতি সহজে রাঘবকে হত্যা করতে পারবেন যুদ্ধ শেষ হলেই শীঘ্র প্রমীলার কাছে ফিরে আসবেন । এই বলে ইন্দ্রজিৎ প্রমীলার কাছে বিদায় প্রার্থনা করেন ।
৭. “ বিদায় এবে দেহ , বিধুমুখী । ” –‘বিধুমুখী ’ কাকে বলা হয়েছে ? তিনি বক্তাকে কী বলেছিলেন ? প্রত্যুত্তরে বক্তা কী বলেছিলেন ? ১ + ২ + ২
উত্তরঃ বিধুমুখীর পরিচয় : মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশের উল্লিখিত অংশে ‘ বিধুমুখী ’ বলতে ইন্দ্রজিতের পত্নী প্রমীলার কথা বলা হয়েছে ।
বক্তব্য বিষয় : সহোদর বীরবাহুর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ইন্দ্রজিৎ রথারোহণ করছিলেন । সেই মুহূর্তে প্রমীলা তাঁর কাছে আসেন এবং ইন্দ্রজিতের হাত ধরে তাঁকে ফেলে রেখে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন । ইন্দ্রজিৎকে ছাড়া তাঁর পক্ষে প্রাণ ধারণ করা যে সম্ভব নয় সে কথাও তিনি বলেন ৷ দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রমীলা বলেন যে , গভীর অরণ্যে লতা যদি হাতির পা - কে বেষ্টন করে তাহলে হাতি তার প্রতি মনোযোগ না দিলেও তাকে ফেলে দেয় না । ইন্দ্রজিৎ তাহলে তাঁকে কীভাবে ত্যাগ করে চলে যেতে পারেন এই প্রশ্ন তুলে প্রমীলা বিস্ময় প্রকাশ করেন ।
বক্তার প্রত্যুত্তর : প্রমীলার কথা শুনে ইন্দ্রজিৎ হেসে উত্তর দেন যে প্রমীলা তাঁকে ভালোবাসার যে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধেছেন তা ছিন্ন করা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয় । এরপরে ইন্দ্রজিৎ প্রমীলাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে রামচন্দ্রকে বধ করে তিনি অত্যন্ত দ্রুত ফিরে আসবেন । এই কথা বলে ইন্দ্রজিৎ প্রমীলার কাছে বিদায় প্রার্থনা করেন ।
৮. “ আলিঙ্গি কুমারে , চুম্বি শিরঃ , মৃদুম্বরে / উত্তর করিলা তবে স্বর্ণ - লঙ্কাপতি ; " — কে করেছে ? কাকে আলিঙ্গন আলিঙ্গন করে বক্তা যা বলেছেন তা নিজের ভাষায় লেখো । ২ + ৩
উত্তরঃ আলিঙ্গনরত ব্যক্তিষয় : মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশের উল্লিখিত অংশে রাবণ ইন্দ্রজিৎকে আলিঙ্গন করেছেন ।
বক্তব্য : অনুমতি গ্রহণ : সহোদর বীরবাহুর মৃত্যুর পরে রামচন্দ্রের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ইন্দ্রজিৎ এসেছিলেন পিতার অনুমতি নিতে । যুদ্ধ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রাবণ প্রিয় পুত্রকে আলিঙ্গন করেন ।
পিতার দ্বিধা : রাবণ পুত্র ইন্দ্রজিৎকে ‘ রাক্ষস - কুল - শেখর ’ ও ‘ রাক্ষস - কুল - ভরসা ’ বলে উল্লেখ করে বলেন যে , সেই ভয়ংকর যুদ্ধে প্রিয় পুত্রকে পাঠাতে তাঁর প্রাণ চায় না । কারণ , নিয়তি তাঁর প্রতি বিরূপ , “ হায় , বিধি বাম মম প্রতি ” । এই বিরূপতার দৃষ্টান্ত হিসেবে রাবণ বলেন যে , শিলা যেমন জলে ভাসা অসম্ভব সেরকমই মরে গিয়ে পুনর্জীবন লাভের ঘটনাও একটি অসম্ভব বিষয় ৷ এখানে রাবণ ইন্দ্রজিতের দ্বারা নিহত রামচন্দ্রের পুনর্জীবন লাভ করে বীরবাহুকে হত্যার ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন । নিয়তির ভূমিকা ছাড়া যে এরকম অসম্ভব বিষয় হওয়া সম্ভব নয় এটাই রাবণের বলার উদ্দেশ্য ছিল ৷ আর এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রিয় পুত্রকে যুদ্ধে পাঠাতে রাবণের ইচ্ছা ছিল না । পুত্র - স্নেহে আকুল একজন পিতার মানসিকতাই এখানে রাবণের মন্তব্যে প্রকাশিত হয়েছে ।
৯. “ হায় , বিধি বাম মম প্রতি । ” — কখন বক্তা এ কথা বলেছেন ? বক্তার এ কথা বলার কারণ কী ? 3 + 2
উত্তরঃ মন্তব্যকাল : মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যর প্রথম সর্গ থেকে সংকলিত ‘ অভিষেক ’ কাব্যাংশে রাক্ষসরাজ রাবণ আলোচ্য মন্তব্যটি করেছেন । বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ শুনে শোকে কাতর রাবণ রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতি নেন । সেজে ওঠে তাঁর চতুরঙ্গ বাহিনী । এই সময় সেখানে এসে উপস্থিত হন পুত্র ইন্দ্রজিৎ । রামচন্দ্রকে ‘ সমূলে নির্মূল ’ করার জন্য তিনি পিতা রাবণের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন— “ ঘোর শরানলে / করি ভস্ম , বায়ু - অস্ত্রে উড়াইব তারে ; / নতুবা বাঁধিয়া আনি দিব রাজপদে । ” পুত্রকে আলিঙ্গন করে রাবণ জানান যে , সেই ‘ কাল - সমরে ’ ইন্দ্রজিৎকে পাঠাতে তাঁর মন সায় দেয় না । এই সময়েই রাক্ষসরাজ তাঁর প্রতি নিয়তির নিষ্ঠুরতার প্রসঙ্গে আলোচ্য উক্তিটি করেন ।
বক্তার এ কথা বলার কারণ : নিয়তির নিষ্ঠুরতাকে রাবণ তাঁর জীবনে বারবার উপলব্ধি করেছেন । কুম্ভকর্ণের মৃত্যু ছিল একটি আঘাত । একইভাবে বীরবাহুর মৃত্যুতে রাবণের প্রতি নিয়তির বিরূপতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । মেঘনাদের হাতে যুদ্ধে নিহত হওয়ার পরেও যেভাবে রামচন্দ্র পুনর্জীবন লাভ করেছে ও বীরবাহুকে যুদ্ধে হত্যা করেছে তা রাবণকে বিস্মিত ও হতাশ করে তুলেছে ।— “ কে কবে শুনেছে , পুত্র , ভাসে শিলা জলে /কে কবে শুনেছে লোক মরি পুনঃ বাঁচে ? এ কথা বলার সময় মহাবীর রাবণকে যথেষ্ট হতাশ মনে হয়েছে।
১০. " তারে ডরাও আপনি , ” – কে , কাকে ভয় পান ? উদ্দিষ্ট ব্যক্তির ভয় পাওয়ার কারণ কী ? বক্তা কীভাবে সেই ভয় দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন ? ১ + ২ + ২
উত্তরঃ কর্তা ও কর্ম : মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ অভিষেক ’ পদ্যাংশ থেকে গৃহীত আলোচ্য পঙ্ক্তিটিতে লঙ্কেশ্বর রাবণের রামচন্দ্রকে ভয় পাওয়ার কথা বলা হয়েছে ।
ভয় পাওয়ার কারণ : রামচন্দ্র মায়াবী । দেবতারা তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করে চলেছেন । তাই নিশা - রণে মারা গিয়েও রামচন্দ্র পুনরায় বেঁচে উঠেছেন । স্বয়ং বিধাতাই রাবণের প্রতি বিরূপ । রামচন্দ্র সামান্য মানুষ হলেও তাই তাকে তিনি ভয় পান । রাক্ষসকুলের ভরসা প্রিয়পুত্র ইন্দ্রজিৎকে তাই যুদ্ধে পাঠাতে তাঁর মন শঙ্কিত হয়ে থাকে — ‘ এ কাল সমরে , / নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা / বারংবার । ’
• ভয় দূর করার প্রয়াস : পিতা রাবণের মনে উদ্ভূত ভয় দূর করতে ইন্দ্রজিৎ সচেষ্ট হয়েছেন । প্রথমেই তিনি বলেছেন রামচন্দ্র রাবণের পক্ষে ভয় করার মতো কোনো মানুষ নন । তা ছাড়া বীরপুত্র থাকতে পিতার যুদ্ধযাত্রা করা উচিত নয় । তাতে ইন্দ্রজিতের কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে জগতে । ইতিমধ্যেই দু - বার ইন্দ্রজিৎ রামচন্দ্রকে পরাজিত করেছেন । ইন্দ্রজিৎ নিজের এই সাফল্যের কথা বলে পিতার মনে তৈরি হওয়া ভয় দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন । অর্থাৎ একদিকে রামচন্দ্র সম্পর্কে তাচ্ছিল্য , অন্যদিকে তীব্র মানসিক জোর দিয়ে ইন্দ্রজিৎ রাবণের মনের যাবতীয় ভয় ও দ্বিধাকে দূর করতে চেয়েছেন ।
Antony kisku
ReplyDeleteইন্দ্রজিৎ এর রথের বর্ণনা
ReplyDelete