লেখক পরিচিতিঃ
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে । তিনি জমিদার ও অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন । তাঁর পিতা ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও মাতা জাহ্নবী দেবী । লেখক মধুসূদনের শিক্ষা শুরু হয় সাগরদাঁড়ি গ্রামেরই পাঠশালাতে । ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন । সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায় , রাজনারায়ণ বসু , গৌরদাস বসাক প্রমুখ । বিলেত যাওয়ার জন্য তিনি ধর্মান্তরিত হন । গ্রিক , লাতিন , ইংরেজি ও হিব্রু ভাষায় তিনি পান্ডিত্য অর্জন করেন । পরবর্তীকালে তিনি বাংলা ভাষায় দক্ষতা লাভ করেন । তিনি দুটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন “ The Captive Lady ' এবং ' vrsions of the post ' | ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিলাতে যান , সেখানে ভীষণ আর্থিক কষ্টে পড়েন এবং ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ফিরে আসেন । তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক ও কাব্য ছিল রত্নাবলী , শর্মিষ্ঠা , একেই কি বলে সভ্যতা , পদ্মাবতী ইত্যাদি নাটক , এবং মেঘনাদবধ কাব্য , তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য , চতুর্দশপদী কবিতা ইত্যাদি তাঁর অসামান্য সৃষ্টি । পদ্মাবতী নাটকে তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন । ১৮৭৩ সালে কবির জীবনাবসান হয় ।
সারসংক্ষেপঃ
মাইকেল মধুসূদনের লেখা অজস্র চিঠির মধ্যে থেকে তিনটি চিঠি পাঠ্য রচনাটিতে সংকলিত হয়েছে । এখানে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর , প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাক এবং রাজনারায়ণ বসুকে ইউরোপ থেকে চিঠি লিখেছেন ।
প্রথম পত্রঃ মধুসূদন ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৩ নভেম্বর ১২ ব্লু - দ্য শ্যাতিরিয়াস , ভার্সাই ফ্রান্স থেকে বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখেছেন । ঈশ্বরচন্দ্রকে লেখা চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি শরৎকালে এবং শীতকালে ইউরোপের জলবায়ু কেমন থাকে , শরৎকাল হলেও ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে ঘরে আগুন জ্বালাতে হয় বাংলায় যে ঠান্ডা পড়ে , ইউরোপে তার ছয় গুণ বেশি ঠান্ডা পড়ে । কবি জানান তিনি ওখানে গিয়ে ফ্লেঞ ও ইটালিয়ান ভাষা রপ্ত করেছেন এবং কোনো শিক্ষকের সহায়তা ছাড়াই জার্মান ভাষাচর্চা করেছেন । মধুসূদন যে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতি আস্থাশীল তাই এই পত্রে উপলব্ধি করা যায় ।
দ্বিতীয় পত্রঃ প্রিয় সহপাঠী গৌরদাস বসাককে এই পত্রটি কবি লেখেন । গৌরকে লেখা চিঠিতে জানা যায় লেখক ‘ সীলোন ’ নামক জাহাজে চড়ে চলেছেন । জাহাজটি একেবারে সুদৃশ্যভাবে সাজানো গোছানো । ইন্ডিয়ান ফিল্ড - এর জন্য ভ্রমণ সম্পর্কে লেখার জন্যই তিনি বের হয়েছেন । তিনি লিখেছেন নিজেদের দেশের যদি আধা - ডজন লোক থাকত তবে তাদের নিয়ে তিনি একটি গোষ্ঠী গড়ে তুলতেন । তাঁর লেখা থেকে আরো জানা যায় যে জীবিকা নির্বাহের জন্য যে পেশা শিখতে এসেছেন তাতেই তিনি মনোনিবেশ করেন এবং সম্মান অর্জন করবার জন্য দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন । চিঠির অংশবিশেষ যে পরে লেখা তার উল্লেখ আমরা পত্রটিতে পাই । স্পেনের উপকূল ছাড়িয়ে এক রবিবারে তিনি লিখেছেন — এখানের সমুদ্র অনেক শাস্ত , একেবারে কবির নিজের দেশের মতো আবহাওয়া , খুব ঠান্ডা না থাকায় সকলে খুব আনন্দে আছেন । তবে আটলান্টিক ও বিসকে উপসাগরে পৌঁছালে আবহাওয়া পরিবর্তন হতে পারে । শৈশব থেকে যে দেশটি সম্পর্কে লেখকের এতো মোহ ছিল সেই দেশটির কাছাকাছি এসে যাওয়ায় ত্রি লেখক যে রোমাঙ্কিত হয়ে উঠেছেন তা পত্রের শেষছত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন ।
তৃতীয় পত্রঃ এই চিঠিটি লেখক তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছেন । রাজনারায়ণকে লেখা চিঠি থেকে জানতে পারি ‘ মেঘনাদবধ কাব্য ’ সম্পর্কে মতামত জানার জন্য লেখক খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন । এটি রচনা করতে গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হলেও শেষ পর্যন্ত ৭৫০ লাইনে সেটি তিনি সমাপ্ত করেন । অনেকে এটিকে মিলটনের থেকে উৎকৃষ্ট কাব্য বলেছেন । এটা কবি বিশ্বাস করেন না । মিলটনের চেয়ে ভালো কিছু রচনা করা কবি অসম্ভব বলে মনে করেন । তিনি নিজেকে মিলটনের সমতুল্য বলে প্রশংসা পেতে রাজি ছিলেন না । কাব্যটি সমালোচনার ভালোমন্দের দায়িত্ব তিনি বন্ধু রাজনারায়ণের ওপর দিয়েছেন । লেখক ছিলেন আন্তরিকভাবে রাজনারায়ণের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুরাগী এবং তাঁর বিশ্বাস ছিল যে তার কাব্য সম্পর্কে রাজনারায়ণের মূল্যায়ন অনেক বেশি সার্থক ও যথাযথ হবে ।
নামকরণঃ
নামকরণ সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । মধুসুদনের লেখায় তা অন্য মাত্রা যোগ করে , তবে নামকরণটি করা হয়েছে একেবারে সরলভাবে । লেখক তাঁর তিন বন্ধুকে চিঠি লিখেছেন , তার মধ্যে দুজনকে শুনিয়েছেন ভ্রমণপথের কথা , ওদেশের সাথে আমাদের দেশের জলবায়ুর কিরকম পার্থক্য তা সুন্দরভাবে গুছিয়ে লিখেছেন । ভ্রমণপথের অভিজ্ঞতা যেমন বন্ধুদের লিখছেন , তেমনি জানিয়েছেন কেন তিনি লন্ডনে যেতে চান । গৌরদাস বসাককে লেখা চিঠি থেকে জানা যায় যে তিনি যে পেশা গ্রহণের জন্য ইউরোপ ভ্রমণ করছেন তাতে মনোনিবেশ করে যথেষ্ট সম্মান তিনি অর্জন করতে চান । তিনি আরো বলেছেন বাইরে বের হলে যে অভিজ্ঞতা হয় তা কল্পকাহিনিকেও হার মানায় । রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠি থেকে জানা যায় প্রচণ্ড অসুস্থতার মধ্যে ৭৫০ লাইনে মেঘনাদবধ কাব্য লেখক শেষ করেছেন । পাঠকরা এই কাব্য নিয়ে কতটা উৎসাহিত তা তিনি জানতে চেয়েছেন । হাজার হাজার মানুষের মতামতের পাশে তিনি রাজনারায়ণের মত সবার আগে রেখেছেন কারণ , লেখকের কাছে রাজনারায়ণের মত হলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য । তিনি নিজেকে কালিদাসের পাশে বসাতে রাজি আছেন কিন্তু মিলটনের সাথে নিজেকে তুলনা করতে রাজি নন । এখানে রচনাটির নামকরণ রচনার বিষয়বস্তু অনুসারে হয়েছে , চিঠির সব বৈশিষ্ট্যই এর মধ্যে রয়েছে তাই ‘ চিঠি ’ নামকরণটি যথার্থ হয়েছে ।
অষ্টম শ্রেণীর ভূগোল প্রশ্ন উত্তর পড়তে ক্লিক করো
অতি - সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর
১. ' চিঠি ' রচনায় পাঠ্য তিনটি চিঠি কে রচনা করেছেন ? কে এগুলির বাংলা তরজমা করেছেন ?
উঃ চিঠি তিনটি লিখেছিলেন লেখক মাইকেল মধুসুদন দত্ত । চিঠিগুলির বাংলায় তরজমা করেছেন সুশীল রায় ।
২. ফেব্রায়ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন ?
উঃ মাইকেল মধুসুদনের অন্তরঙ্গ বন্ধু রাজনারায়ণ বসু ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন ।
৩. এ লেখক নিজেকে কাদের সমতুল্য ভাবতে পারেন ?
উঃ লেখক ভার্জিল , কালিদাস ও তোসা'র সমকক্ষ বলে নিজেকে ভাবতে পারেন ।
৪. লেখক জার্মান ভাষা সম্পর্কে কী বলেছেন ?
উঃ লেখক বলেছেন জার্মান এক অদ্ভুত ভাষা । এর বর্ণমালাও রোমান নয় ।
৫. আমি তোমাকে অনুনয় জানাচ্ছি । ' কে কাকে কীসের জন্য অনুনয় জানাচ্ছেন ?
উঃ লেখক মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনুনয় জানাচ্ছেন তাঁর প্রিয়বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে , যাতে লেখকের রচিত মেঘনাদবধ কাব্যটিকে পড়ে তিনি উপযুক্ত মতামত জানাতে পারেন ।
৬. শুনেছি অনেক হিন্দু মহিলারা ক্রন্দন করেছেন ' ।- কে শুনেছেন ? কী কারণে তাঁরা ক্রদন করছেন ?
উঃ লেখক মাইকেল মধুসূদন দত্ত শুনেছেন । তিনি শুনেছেন মেঘনাদবধ কাব্য পাঠ করে হিন্দু মহিলারা ক্রন্দন করছেন ।
৭. এদেশের শীত ও ইউরোপের শীতের মধ্যে কী পার্থক্য আছে ?
উঃ এদেশে যা ঠান্ডা পড়ে শীতকালে , ইউরোপে তা এদেশের থেকে ছয় গুণ বেশি পড়ে । শরৎকালেই যা ঠান্ডা তাতে লেখককে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে রেখে জামাজোব্বা পরে থাকতে হয়েছে ।
৮. লেখকের জাহাজের নাম কী ? তাতে চড়ে তিনি কোথায় চলেছেন ?
উঃ লেখকের জাহাজের নাম সীলোন । এতে চড়ে তিনি ইংল্যান্ডে চলেছেন ।
৯. লেখক ইউরোপের শীতের তুলনা দিতে কোন্ লেখকের কাব্যের লাইন উদ্ধৃত করেছিলেন ?
উঃ লেখক কবি ভারতচন্দ্রের কাব্যের ' বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী ' লাইনটি উদ্ধৃত করেছিলেন ।
১০. কোন পত্রিকার জন্য লেখক ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে পাঠাবেন ?
উঃ ' ইন্ডিয়ান ফিল্ড ’ পত্রিকার জন্য লেখক ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে পাঠাবেন ।
১১. মেঘনাদবধ কাব্যে কতগুলি সর্গ আছে এবং কত লাইনে লেখক কারাটিকে শেষ করেছিলেন ?
উঃ মেঘনাদবধ কাব্যে ছয়টি সর্গ আছে এবং লেখক ৭৫০ লাইনে কাব্যটিকে শেষ করেছিলেন ।
১২. এই চিঠি তিনটিতে কোন্ কোন্ বিখ্যাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে ?
উঃ চিঠি তিনটিতে , কালিদাস , ভারতচন্দ্র , ভার্জিল , তাসো ও মিলটনের নাম উল্লেখ করা আছে ।
১৩. লেখক চিঠি লেখার কতদিন আগে কলকাতার ছিলেন ?
উঃ লেখক চিঠি লেখার ২২ দিন আগে কলকাতায় ছিলেন ।
১৪. মধুসূদনের বিখ্যাত রচনাগুলি কী কী ?
উঃ মধুসূদনের বিখ্যাত রচনাগুলি হলা মেঘনাদবধ কাব্য , তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য , চতুর্দশপদী কবিতা পদ্মাবতী । বিখ্যাত নাটকগুলি হলো রত্নাবলি , শর্মিষ্ঠা , একেই কি বলে সভ্যতা ?
১৫. পত্র তিনটিতে কোন্ কোন্ সাগরের উল্লেখ আছে ?
উঃ পত্র তিনটিতে ভূমধ্যসাগর , আটলান্টিক সাগর , বিসকে উপসাগরের উল্লেখ আছে । ১৬. কোন জায়গায় জাহাজ পৌঁছালে সব অন্যরকম হবে বলে কবি বলেছেন ? উঃ । জাহাজ আটলান্টিক ও বিসুকে উপসাগরে ঢুকলে সব অন্যরকম হবে বলে কবি বলেছেন ।
১৬.মধুসূদন দত্ত কোন্ কলেজের ছাত্র ছিলেন ?
উঃ মধুসূদন দত্ত হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন ।
১৭.পদ্মাবতী নাটকে তিনি কোন্ ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন ?
উঃ পদ্মাবতী নাটকে তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন ।
২. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখোঃ
২.১. মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর প্রিয় ও পুরাতন বন্ধু গৌরদাস বসাককে কোথা থেকে পাঠ্য চিঠিটি লিখেছিলেন ? তাঁর যাত্রাপথের বিবরণ কীভাবে ধরা পড়েছে আলোচনা করো ।
উঃ সীলোন নামক জাহাজে বসে এই পাঠ্য চিঠিটি লেখেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । সেই সময় জাহাজটি লন্ডন যাবার উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে উত্তর আফ্রিকার উপকূল দিয়ে চলছিল । পত্রলেখকের ভাষায় সীলোন নামক জাহাজটি একেবারে রূপকথার রাজ্যের ভাসমান প্রাসাদের ন্যায় , এর সেলুনগুলো একেবারে রাজপ্রাসাদের মতো এবং কেবিনগুলো রাজকুমাদের বসবাসের উপযোগী । এখানে সবরকম সুবিধা রয়েছে । জাহাজটি লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে উত্তর আফ্রিকার পর্বতাকীর্ণ উপকূলের নিকট দিয়ে চলেছে । আগের দিন জাহাজটি মলটায় ছিল গত রবিবার ছিল আলেকজান্দ্রিয়ায় । লেখক জানিয়েছেন , যে পেশা শিখতে তিনি এসেছেন তাতে সাফল্য অর্জন করতে এবং খ্যাতিলাভ করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । আগামীকাল সকালে তারা জিব্রেলটারে পৌঁছোতে পারবেন । পরিশেষে লেখক জানিয়েছেন সমুদ্র খুবই শান্ত অনেকটা যেন আমাদের দেশের হুগলি নদীর মতো । আবহাওয়া না গরম না ঠান্ডা , তবে জাহাজ আটলান্টিক ও বিস্কে উপসাগরে ঢুকলে সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাবে ।
২.২ মধুসূদনের জীবনের উচ্চাশার স্বপ্ন কীভাবে পত্রটিতে প্রতিভাসিত হয়ে উঠেছে ?
উঃ সীলোন নামক জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ড যাত্রাপথে লেখক চিঠিতে জানিয়েছিলেন কেন তিনি বিদেশে যেতে চান ‘ ইন্ডিয়ান ফিল্ড ’ পত্রিকায় এই ভ্রমনের একটি সুদীর্ঘ বিবরণ লেখার ইচ্ছা তিনি প্রকাশ করেছেন । লেখক আরও জানিয়েছেন যে তিনি বিদেশে যাচ্ছেন নাম , অর্থ , যশ ও প্রতিপত্তি অর্জন করতে । তিনি যে পেশায় যাচ্ছেন তাতে সফল হতে মনোনিবেশ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । এর মধ্য দিয়ে লেখকের জীবনের উচ্চাশার স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটেছে ।
২.৩ বিদেশে পাড়ি জমানোর সময়েও তাঁর নিজের দেশের কথা কীভাবে পত্রলেখকের মনে এসেছে ?
উঃ লেখক মধুসূদন দত্ত বিদেশে পাড়ি জমালেও স্বদেশকে মুহূর্তের জন্য ভোলেননি । জাহাজে চলাকালীন বিভিন্ন পরিবেশ প্রসঙ্গে তিনি দেশের কথা বলেছেন । ইংল্যান্ডের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেও লেখকের মনে হয়েছে ২২ দিন আগেও তিনি কলকাতায় ছিলেন । বন্ধু গৌরদাসকে পত্রে তিনি জানিয়েছেন দেশের মানুষের স্পর্শ পেতে তিনি ব্যাঘ্র । তিনি আরও লিখেছেন , এই জাহাজে যদি পাঁচ - ছয়জন ও দেশের মানুষ পাওয়া যেত তাহলেই তিনি একটি গোষ্ঠী তৈরি করে নিতে পারতেন । এপ্রসঙ্গে তিনি জনৈক বন্ধু ‘ হরি ' কোথায় আছে জানতে চেয়েছেন । জিলেটারে পৌঁছে লেখকের মনে হয়েছিল এটি হুগলি নদীর মতো । এখানকার আবহাওয়া আমাদের দেশের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের মতো , খুব গরমও না খুব ঠান্ডাও না । শরৎকালে ইউরোপের ঠান্ডা আমাদের দেশের ঠান্ডার চেয়ে অনেক বেশি । আর শীতকালে তো কথাই নেই তখন ইউরোপের ঠান্ডা বাংলার ঠান্ডার চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি । এই জলবায়ুর কথাও তিনি চিঠিতে জানিয়েছেন । কবি ভেবেছিলেন যে স্থানটি বোধহয় খুব ঠান্ডা হবে কিন্তু তা দেশের সঙ্গে সামস্যপূর্ণ দেখে তিনি মনে শান্তি অনুভব করেছেন ।
২.৪ একথা যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ।'— কোন্ কথা ? সে - কথাকে বক্তার অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে কেন ?
উঃ শিশুকাল থেকে লেখক মধুসূদন বিলেতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন । যে দেশ সম্বন্ধে এমনভাবে চিন্তা করে এসেছেন প্রতিটি মিনিটে তিনি যে তার নিকটবর্তী হতে চলেছেন এই কথাটিই তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না । লেখক পথে যে দেশ সম্বন্ধে মনে মনে চিন্তা করে আসছেন আজ সে দেশে থেকে তিনি স্বয়ং দেখছেন যে সবকিছু হুবহু মিলে যাচ্ছে । বাস্তব ব্যাপার কল্পিত কাহিনির থেকে বিচিত্র তাই তাঁর অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে । জীবনে একটা সময় কবি বিদেশের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন । তাই সেই কাঙ্খিত স্থানে পুনরায় তিনি পৌঁছতে চলেছেন — এই ভাবনা তাঁর যেন অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে।
২.৫ প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে হৃদ্যতার ছবি পত্রটিতে কীভাবে ফুটে উঠেছে তা প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিসহ আলোচনা করো ।
উঃ প্রিয় বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ও উচ্ছ্বাস লেখক মধুসূদনের প্রতিটি চিঠিতেই ধরা পড়েছে । বিভিন্ন উক্তি দেখে তা বোঝা যায় । যেমন , বিদ্যাসাগরকে লেখা পত্রটিতে তিনি বলছেন আমার বিষয়আশয় তত্ত্বাবধান করবেন , যে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জলরাশি থেকে আপনি আমাদের উদ্ধার করেছেন , আবার গিয়ে না সেই বিপদে পড়ি । আরো বলেছেন , হে প্রিয় বন্ধু আপনি মনে করবেন না আমি অলসভাবে দিন কাটাচ্ছি , ফ্রেঞ্চ , ইটালিয়ান শিখেছি , জার্মানিও শিখছি । আবার তাঁর প্রিয় রচনা মেঘনাদবধ কাব্য কতটা ভালো হয়েছে তার জন্য রাজনারায়ণের অভিমতের উপর তিনি কতটা নির্ভরশীল তাও পত্রে তিনি আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন । বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা চিঠিটি লেখক মধুসূদনের বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতার এক অনন্য নজির । তিনি চিঠিতে বলেছেন যে ইংল্যান্ড গিয়ে তিনি চিঠি না দেওয়া অবধি গৌরদাস যেন চিঠি না দেন । সেখানে পৌঁছেই লেখক তাঁকে পত্রে ঠিকানা জানাবেন । তখন যেন গৌরদাস প্রাণ উজাড় করে লেখককে পত্রাঘাত করেন ।
২.৬ রাজনারায়ণ বসুকে লেখা পত্রে লেখক তাঁর এই প্রিয় বন্ধুটির কাছে কোন্ আবেদন জানিয়েছেন ?
উঃ লেখক মধুসূদন অসুস্থ থেকেও মেঘনাদবধ কাব্য শেষ করেছেন । লেখক তার বন্ধুর অভিমত চান কীভাবে এটা আরো ভালো করা যায় বা এটি কতটা ঠিকঠাক হয়েছে । তিনি রাজনারায়ণকে অনুরোধ করেছেন মেঘনাদবধ কাব্য সম্পর্কে জানাতে । সেই রায় জানার জন্য লেখক রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন । মানুষের কাছে এই কাব্য গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে , তারা মিলটনের সঙ্গে কবিকে তুলনা করেছেন , কিন্তু এসবের কোনো মূল্য লেখকের কাছে নেই । তাঁর মতে মিলটনের চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু হতে পারে না । তিনি রাজনারায়ণ বসু পুরোপুরি ভাবে বন্ধু রাজনারায়ণের উপর নির্ভরশীল । তাই তিনি বলেছেন হাজার মানুষের জয়ধ্বনির চেয়ে রাজনারায়ণের • মতামত লেখকের কাছে অনেক নির্ভরযোগ্য । লেখক যে অকপট ও আন্তরিকভাবে রাজনারায়ণের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুরাগী তাও তিনি জানিয়েছেন ।
২.৭ এই কাব্য অদ্ভূত রকম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । কোন কাব্যের কথা বলা হয়েছে ? সে কাব্যের জনপ্রিয়তা বলতে লেখক কোন কোন প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন ?
উঃ মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা মেঘনাদবধ কাব্যের কথা বলা হয়েছে । কবি মধুসূদনের জীবিতকালেই ' মেঘনাদ বধ ' কাব্যটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । এই প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন ' মেঘনাদ বধ ' কাব্যটিকে কেউ বলেন মিলটনের কাব্যের চেয়েও ভালো হয়েছে । অনেকে বলেছেন কাব্যটি কালিদাসের কাছাকাছি । কিন্তু ভার্জিল , তাসো বা কালিদাসের তুলনা তিনি মেনে নিতে রাজি কিন্তু মিলটনের তুলনা নয় । তার রোমান্টিকতার ধারে কাছে লেখক পৌঁছোতে পারবেন না বলে মনে করেন । তাঁর মতে মিলটন স্বর্গীয় কবি । আর লেখকের মতো নশ্বর কবিদের পক্ষে কোনোদিন তাঁর কাছে পৌঁছানো যাবে না বলেই লেখক মনে করেন ।
২.৮ প্রিয় বন্ধুর প্রতি , সর্বোপরি সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগের যে পরিচয় রাজনারায়ণ বসুকে লেখা পত্রটিতে পাওয়া যায় , তা বিশ্লেষণ করো ।
উঃ লেখক একজন কবি , অসুস্থ শরীরে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি মেঘনাধবধ কাব্য রচনা শেষ করেছেন । মেঘনাদ মারা গেছে , ষষ্ঠ সর্গ শেষ করেছেন ৭৫০ লাইনে । মেঘনাদকে কাব্যে মেরে ফেলতে লেখককে অনেক অশ্ৰু ফেলতে হয়েছে । কাব্য জনপ্রিয় হয়েছে , লেখক খুশি হলেও মিলটনের সঙ্গে তাঁর তুলনা মেনে নিতে পারেন নি । অনেকে বলেছেন এটি কালিদাসের কাছাকাছি সেটা মানতে লেখক অরাজী নন । কিন্তু তিনি মনে করেন মিলটনের রচনা স্বর্গীয় তার কাছে পৌঁছনো যায় না । কাব্য সম্বন্ধে তিনি বন্ধুর স্পষ্ট মতামত জানতে চেয়েছেন । তিনি শুনেছেন কাব্যটি পড়ে হিন্দু মহিলারাও কেঁদে ফেলেছেন । তাই বন্ধুর কাছে তাঁর অনুরোধ এই কাব্য যেন তিনি তার স্ত্রীকেও পড়ান । পরিশেষে বন্ধু রাজনারায়ণের প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস ও অনুরাগের কথা জানিয়ে লেখক লিখেছেন বহু মানুষের জয়ধ্বনি থেকেও তাঁর অভিমত কবির কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।
২.৯ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ৩ নভেম্বর ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা মধুসূদনের চিঠিটির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে আলোচনা করো ।
উঃ প্রিয় বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে লেখক অনেক যত্ন করে চিঠি লিখেছেন । লেখক তাঁকে । তাঁদের বিষয়আশয় তত্ত্বাবধান করতে বলেছেন । কেন তিনি লন্ডনে যেতে চান না আগের চিঠিতে তাঁকে জানিয়েছেন । এ থেকে বিদ্যাসাগরের প্রতি মধুসূদনের আস্থা ও শ্রদ্ধার দিকটি ফুটে উঠেছে । যে দুরবস্থা থেকে বন্ধু বিদ্যাসাগর মহাশয় তাকে উদ্ধার করেছেন আর যেন তাঁকে বিপদে পড়তে না হয় সেটা যেন বন্ধু দেখেন । শীতে ইউরোপে দারুণ ঠান্ডা শরৎকালেও ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হয়েছে , এমন সব জামাজোব্বা পরে থাকতে হচ্ছে যা আমাদের দেশের ছোটো খাটো মোট - এর সমান । শীতে দেশের চেয়ে এখানে ছয় গুণ বেশি শীত পড়ে । এ প্রসঙ্গে মধুসূদন ‘ বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী ’ ভারতচন্দ্রের কাব্যের এই লাইনটি স্মরণ করেছেন এবং বিস্ময়বোধ করেছেন ইউরোপের শীতকাল সম্পর্কে ভারতচন্দ্র কী লিখতেন । বন্ধু যেন না মনে করেন লেখক কেবল ফাঁকি দিচ্ছেন তিনি এখানে ফ্রেঞ্চ , ইটালিয়ান , জার্মান প্রভৃতি ভাষা শিখছেন । সেই সংবাদ জানিয়েই লেখক মধুসূদন চিঠিটি শেষ করেছেন ।
২.১০ বিদ্যাসাগরকে লেখা পত্রটিতে মধুসূদনের জীবনে তাঁর ভূমিকার যে আভাস মেলে তা বিশদভাবে আলোচনা করো ।
উঃ মধুসূদনের জীবনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অনেকটাই মধুসূদন তাই জানতেন । তাই তিনি সর্ব ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের উপর নির্ভর করতেন । তিনি বিদ্যাসাগরের স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত হতে চান না , তা তিনি বন্ধুকে জানিয়েছেন , তিনি অলস ভাবে দিন কাটাচ্ছেন না ফ্রেঞ্জ ইটালিয়ান শিখছেন । মন দিয়েছেন জার্মান ভাষা চর্চা করছেন । তিনি তার ভালো - মন্দ- আশা ভালোবাসা সবকিছুই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান । এই পত্র প্রমাণ করে মধুসুদনের জীবনে বিদ্যাসাগরের প্রভাব ছিল অনেকখানি ।
No comments:
Post a Comment