পলাশি যুদ্ধের কারণ ও ফলা ফল বর্ণনা কর দ্বাদশ শ্রেণি | The Causes and Consequences of The Battle of Plassey in Bangla (WBCHSE) - Psycho Principal

Fresh Topics

Friday, 7 April 2023

পলাশি যুদ্ধের কারণ ও ফলা ফল বর্ণনা কর দ্বাদশ শ্রেণি | The Causes and Consequences of The Battle of Plassey in Bangla (WBCHSE)

 

পলাশির যুদ্ধের কারণগুলি হল নিম্ন রূপ 

ভূমিকাঃ
প্রথমে সিরাজ - উদ্‌দৌলার সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক ছিল সুমধুর । কারণ নবাব আলিবর্দি খাঁ সিরাজকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করার পর সিরাজ হুগলি পরিভ্রমণে গেলে ইংরেজ বণিকরা অন্যান্য ইউরোপীয়দের তুলনায় তাঁকে বেশি সম্মান প্রদর্শন করে । কিন্তু সিংহাসনে বসার পর কয়েকটি কারণে ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং বিরোধের সূত্রপাত হয় ।
এই কারণগুলি হল — 


আনুগত্য প্রদর্শন না করাঃ
সিরাজ - উদ্‌দৌলা সিংহাসনে বসার পর অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ভারতীয় প্রথা অনুযায়ী আনুগত্য জানিয়ে নজরানা পাঠালেও ইংরেজরা আনুগত্য দেখিয়ে কোনো নজরানা পাঠায়নি । এই ঘটনায় সিরাজ অপমানিত বোধ করেন এবং ইংরেজদের প্রতি রুষ্ট হন । পরে অবশ্য সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি কাটিয়ে ইংরেজরা সিরাজকে উপঢৌকন পাঠিয়েছিল ।


ষড়যন্ত্রের সংবাদঃ
এ সময়ে সিরাজের কাছে খবর আসে যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগম ও পূর্ণিয়ার নবাব শওকৎ জঙ্গকে সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । এই সংবাদে সিরাজ আরও ক্রুদ্ধ হন ।


কৃষন্দাসকে আশ্রয়ঃ
ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ রাজকোশে অর্থ জমা দেওয়ার ব্যাপারে গরমিল করলে সিরাজ তাকে মুর্শিদাবাদে এসে সমস্ত হিসেব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন । কিন্তু রাজবল্লভের নির্দেশে তাঁর পুত্র কৃথ্বদাস প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে যান । কলকাতার ইংরেজ গভর্নর ড্রেক কৃষ্বদাসকে আশ্রয় দেন । সিরাজ বারংবার নির্দেশ দিলেও ইংরেজরা কৃক্মদাসকে নবাবের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে । ইংরেজদের এই উদ্ধত মনোভাব সিরাজকে ইংরেজদের প্রতি ক্রুদ্ধ করে তোলে ।


দূর্গ নির্মাণঃ
দক্ষিণ ভারতে ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাতে ইংরেজ ও ফরাসি উভয় কোম্পানিই দুর্গ নির্মাণ শুরু করে । সিরাজ উভয়পক্ষকেই দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করার নির্দেশ দেন । ফরাসিরা দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করলেও ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণ চালিয়ে যায় এবং নবাবের দূত নারায়ণ দাসকে তারা অপমান করে । এতে নবাবের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় ।


দস্তকের অপব্যবহারঃ
মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ারের 1717 খ্রিস্টাব্দের ফরমান অনুসারে ‘ দস্তক ’ ছিল কোম্পানির বাংলাদেশে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার ছাড়পত্র । কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে দস্তকের ব্যবহার করত । এর ফলে বাংলার নবাব রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতেন । সিরাজ দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিলে কোম্পানি নীরব থাকে ।


কলকাতা আক্রমণঃ
পরে ইংরেজরা এই বলে যুক্তি দেখায় যে , তারা ভেবেছিল বাংলার সিংহাসনে যেহেতু নবাবরা দীর্ঘস্থায়ী হন না , সেইহেতু সিরাজ - এর ক্ষেত্রেও অনুরূপ কিছু ঘটবে এবং এই কারণেই তারা উপটৌকন পাঠাতে বিলম্ব করে ৷ এই পরিস্থিতিতে সিরাজ ইংরেজদের সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাশিমবাজার কুঠি দখল করে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং 1756 খ্রিস্টাব্দে 20 জুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সমেত কলকাতা দখল করেন । ইংরেজরা পরাজিত হয়ে r ফলতায় আশ্রয় গ্রহণ করে । সম্ভবত সিরাজের নির্দেশে 146 জন বন্দি - ইংরেজকে 18 ফুট লম্বা ও 10 ফুট 10 ইঞি একটি ঘরে আটক রাখা হয় । এর ফলে 123 জন বন্দি 1 শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় । এই ঘটনাটি ইতিহাসে ‘ অন্ধকূপ হত্যা ' নামে পরিচিত । কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকরা এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন । কারণ , প্রথমত , ওই আয়তনের ঘরে 146 জন বন্দি রাখা সম্ভব নয় । দ্বিতীয়ত , যদিও অধিকাংশ ইংরেজ ফলতায় আশ্রয় নেয় , তাহলে অতজন ইংরেজের ওই ঘরে থাকা সম্ভব নয় । এইভাবে ঘটনাগুলি পরপর ঘটতে থাকলে সিরাজের মনে সন্দেহ হয় । সিরাজ কলকাতা দখলের পর মাতামহ আলিবর্দির নাম অনুসারে কলকাতার নতুন নামকরণ করেন ‘ আলিনগর ’ । মানিকচঁাদকে কলকাতার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে যান । অ্যানি বেসান্ত বলেছেন , এ ক্ষেত্রে জ্যামিতি আঙ্কিক সংখ্যাগুলিকে অপ্রমাণিত করে ।


আলিনগরের সন্ধিঃ
কলকাতার পতনের সংবাদ মাদ্রাজে পৌছালে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি নৌবহর নিয়ে কলকাতায় আসেন । তাঁরা মানিকচঁাদকে ঘুষ দিয়ে 1757 খ্রিস্টাব্দের 2 ফেব্রুয়ারি একরকম বিনা বাধাতেই কলকাতা পুনর্দখল করেন । এই সংবাদে সিরাজ আবার সসৈন্যে কলকাতায় পৌঁছান । কিন্তু কয়েকদিন যুদ্ধ করার পর 1757 খ্রিস্টাব্দের 9 ফেব্রুয়ারি সিরাজ ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি স্বাক্ষর করেন । এই সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণের অধিকার ফিরে পায় এবং বিনা শুল্কে বাণিজ্য ও নিজ নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করার অধিকার লাভ করে । এই সন্ধি ইংরেজদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রভাব - প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে ।


চন্দননগর দখলঃ
সিরাজ গোপনে ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ বাংলাদেশে ফরাসিদের বাণিজ্যকুঠি চন্দননগর দখল করেন এবং সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।


সিরাজ - উদ্‌দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রঃ
মুর্শিদাবাদের রাজদরবারে জগৎ শেঠ , রাজবল্লভ , রায়দুর্লভ , উমিচঁাদ , ইয়ার লতিফ , মিরজাফর প্রমুখ সিরাজের উদ্ধত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন । ক্লাইভ এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেন । এভাবে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে মিরজাফরকে বাংলার নবাব করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় ।


পলাশির যুদ্ধঃ
পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়ণের জন্য আলিনগরের সন্ধির শর্তভঙ্গের অজুহাতে রবার্ট ক্লাইভ সিরাজ - উদদৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । 1757 খ্রিস্টাব্দের 23 জুন পলাশির প্রাস্তরে মিরজাফরের চরম বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ - উদ্‌দৌলা পরাজিত হন । মিরজাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে ও চক্রান্তে সিরাজ নিহত হন ।


মূল্যায়নঃ
পলাশির যুদ্ধের প্রকৃত কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । ইংরেজ ঐতিহাসিক এস সি হিলের মতে — নবাবের অহমিকা ও লোেভ ( Vanity and avarice ) পলাশির যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিল । তিনি বলেন সিরাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির অর্থ ও সম্পদ লুঠ করা । দুর্গ নির্মাণ ও অন্যান্য কারণ অজুহাত হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন । পি জে মার্শাল ও ক্রিস বেইলি হিলের মতকেই সমর্থন করেন । অপরদিকে রবার্ট ওরম ও পার্সিভ্যাল স্পিয়ার হিলকে সমর্থন না করে অন্য কথা বলেছেন । ওরম বলেন — ইংরেজরা আর্কটের মতো বাংলার সিংহাসনে নিজেদের পছন্দমতো লোককে বসাবার জন্য সিরাজের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন । পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেন — বাংলার সম্পদ কোম্পানির বার্ষিক লগ্নিতে বিনিয়োগ করে বিপুল মুনাফা অর্জন করার লোভে ক্লাইভ ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা নেন । ব্রিজিন গুপ্ত বলেন — ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ইংরেজরা সাম্রাজ্যবাদী কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে । তার ফলেই পলাশি যুদ্ধের সৃষ্টি হয় ।


পালাসি যুদ্ধের ফলা ফল বা গুরুত্ব


পলাশির যুদ্ধের ফল ফল/গুরুত্বঃ
ঘটনা হিসেবে তুচ্ছ হলেও বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে পলাশির যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা , ব্যাপকতা ও স্থায়িত্বের দিক থেকে বিচার করলে পলাশির যুদ্ধ সামান্য একটি খণ্ডযুদ্ধ হলেও ভারতের ইতিহাসের ওপর এর প্রভাব ছিল সুগভীর । ঐতিহাসিক ম্যালে সনের মতে , “ পলাশির যুদ্ধের মতো আর কোনো যুদ্ধের ফলাফল এত প্রত্যক্ষ , এত বিশাল এবং এত স্থায়ী হয়নি । ” ( There never was a battle in which the consequences was so vast , so immediate and so permament . ) । ড . পি জে মার্শাল পলাশির যুদ্ধকে বহুমুখী গুরুত্বের জন্য ‘ পলাশি বিপ্লব ' ( Plassey Revolution ) বলে অভিহিত করেছেন ।


মিরজাফরের সিংহাসন লাভঃ 
পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজদের সমর্থনে মিরজাফর বাংলার নবাব হন । তাঁকে বাংলার মসনদে বসিয়ে ইংরেজরা বাংলার প্রকৃত শাসকে পরিণত হয় । মিরজাফর ইংরেজদের ‘ হাতের পুতুলে ’ পরিণত হন ।



ইংরেজদের মর্যাদা ও প্রভাব বৃদ্ধিঃ
পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের মর্যাদা ও প্রভাব - প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় । পলাশির যুদ্ধের সাফল্যের পর ইংরেজ কোম্পানি ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের শক্তিশালী দাবিদার হিসেবে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করে ।


ইংরেজদের একচেটিয়া বাণিজ্যঃ 
পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা বাংলা থেকে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের বিতাড়িত করে এবং বাংলার বাণিজ্যক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন করে ।


পলাশির লুণ্ঠনঃ
মিরজাফর বাংলার মসনদে বসে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ক্লাইভকে প্রচুর অর্থ পুরস্কার দেন । এর ফলে বাংলার রাজকোশ শূন্য হয়ে যায় । এ ছাড়াও ইংরেজরা নানাভাবে বাংলার সম্পদ শোষণ করে নিজেদের দেশে নিয়ে যায় । ইতিহাসে এই ঘটনা ‘ পলাশির লুণ্ঠন ’ নামে পরিচিত ।


ফরাসিদের বিরুদ্ধে জয়লাভঃ 
বাংলার অর্থসম্পদ দিয়ে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী ইংরেজরা গঠন করে । এই বাহিনীর সাহায্যে দক্ষিণ ভারতে ফরাসিদের পরাজিত করে । পলাশির যুদ্ধের পর ভারতে ফরাসিদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায় ।


স্বাধীনতার সূর্যাস্তঃ 
কবি নবীনচন্দ্র সেনের মতে পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় । কিন্তু এই মত সঠিক নয় ।


আধুনিক যুগের সূচনাঃ 
বিখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেন পলাশির যুদ্ধের ফলে মধ্যযুগের অবসান ঘটে এবং আধুনিক যুগের শুভ সূচনা হয় । পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষা - সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতের সামাজিক , অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নবচেতনার উন্মেষ ঘটে ।


মূল্যায়নঃ 
পলাশির যুদ্ধ বাংলা তথা ভারতে ইংরেজদের আধিপত্যের পথ সুগম করে । এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংরেজদের মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শক্তিবৃদ্ধিও ঘটে । তার ফলে ইংরেজরা ভারতে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ফরাসিদের পরাজিত করে ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করে তোলে ।

1 comment: