উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস, ঔপনিবেশিক শাসনকালে 'অবশিল্পায়নের' বর্ণনা দাও | কোম্পানির শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করো। - Psycho Principal

Fresh Topics

Friday, 18 August 2023

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস, ঔপনিবেশিক শাসনকালে 'অবশিল্পায়নের' বর্ণনা দাও | কোম্পানির শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করো।

 

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস



উনিশ শতকে সমাজসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা 

ইয়ং বেঙ্গল কাদের বলা হয়? উনিশ শতকে বাংলার জাগরণে তাঁদের ভূমিকা লেখো।



মার্কেন্টাইলিজম কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।


প্রশ্ন: ঔপনিবেশিক শাসনকালে 'অবশিল্পায়নের' বর্ণনা দাও।

অথবা, কোম্পানির শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করো।


উত্তর:

» ভূমিকা : অবশিল্পায়ন হল শিল্পায়নের বিপরীত ঘটনা। তাই শিল্পায়ন মানে শিল্প গড়ে ওঠা হলে অবশিল্পায়ন হল শিল্পের ধ্বংসসাধন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচার, দাদন প্রথা, কমিশন প্রথা, একচেটিয়া বাণিজ্য, অসম শুল্ক নীতি প্রভৃতি কারণে বাংলা তথা ভারতের গৌরবমণ্ডিত কুটিরশিল্পের পতন ঘটে, এই ঘটনাকে অবশিল্পায়ন বলা হয়। রমেশচন্দ্র দত্ত, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, অমিয় বাগচি, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ অবশিল্পায়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন। অপরদিকে মরিস ডি মরিস ও অন্যান্য ইংরেজ যেমন রাসব্রুক উইলিয়াম হ্যামিলটন অবশিল্পায়নকে ‘অলীক’ বলেছেন ।


অবশিল্পায়নের কারণ: কোম্পানির আমলে ভারতের কুটিরশিল্পের ধ্বংসের কারণগুলি হল—


i. বিদেশে ভারতীয় পণ্যের ওপর আঘাত : ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে ভারতীয় পণ্যের অত্যধিক জনপ্রিয়তার জন্য দেশীয় বস্ত্রশিল্পে মন্দার সৃষ্টি হয়, শুরু হয় শ্রমিক ছাঁটাই। ইংল্যান্ডের কারিগর ও কারখানার মালিক শ্রেণি শিল্প সংরক্ষণের দাবি করে। এর ফলে 1720 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারত, পারস্য ও চিনের সুতিবস্ত্র ইংল্যান্ডে আমদানি নিষিদ্ধ করে। এরপর অন্যান্য ইউরোপীয় দেশও এই নীতি। অনুসরণ করে। ফলে বিদেশি সুতিবস্ত্রের চাহিদা হ্রাস পায়। 


ii. একচেটিয়া বাণিজ্য : পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা ভারতের অন্যান্য স্থানে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভারত থেকে অন্যান্য । ইউরোপীয় পাইকারি ক্রেতাদের বিতাড়িত করে বাংলার  বাণিজ্যক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন করে। ফলে অন্যান্য বণিক না থাকার ফলে ইংরেজরা তাদের ঠিক করে দেওয়া দামে তাঁতিদের পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করত।


iii. শিল্পবিপ্লব: ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হলে শিল্পজাত সস্তা পণ্য ভারতের বাজারগুলিতেও ছেয়ে যায়। ইংল্যান্ডের শিল্পজাত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতীয় পণ্য হেরে যায়। ফলে দেশের অভ্যন্তরেও ভারতীয় পণ্য তার বাজার হারায়। ইংরেজদের দাদন প্রথা, কমিশন প্রথা ও অসম শুল্কনীতি দেশীয় বস্ত্রশিল্পীদের সর্বনাশ ডেকে আনে।


iv.অবাধ বাণিজ্য নীতি: 1813 খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার লোপ পায়। এর ফলে বন্যার জলোচ্ছ্বাসের মতো ব্রিটিশ পণ্য ভারতে প্রবেশ করে। ভারতের সুতিবস্ত্রের রপ্তানি আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবার দেশি পণ্য বিদেশি পণ্যের কাছে বাজার হারায়। ফলে দেশীয় বস্ত্রশিল্প সর্বনাশের চূড়ান্তে পৌঁছায়।


v. প্রাকৃতিক বিপর্যয় : ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ভারতের কারিগরি শ্রেণির প্রচুর মানুষ মারা যায়। বিপুল পরিমাণ দক্ষ শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ার পর তাঁতশিল্পের আর পুনরুজ্জীবন সম্ভব হয়নি।


vi. দেশীয় রাজ্যগুলির পতন: ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে ভারতের দেশীয় রাজন্যবর্গ ও তাদের রাজকর্মচারীদের পতন ঘটে। এর ফলে ভারতীয় শিল্প ও বাণিজ্য পৃষ্ঠপোষক ও ক্রেতা হারিয়ে মুমূর্ষু হয়ে পড়ে।


vii. অন্যান্য কারণ: ইংরেজ বণিকদের তুলনার একচেটিয়া বাণিজ্য, দেশীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিদেশি পণ্য ব্যবহারে ঝোঁক, কারিগরি উন্নয়ন না হওয়া ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের অন্যতম কারণ ছিল।


ফলাফল: দেশীয় শিল্পের ধ্বংসসাধন ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার ঘটায়। 

i. বেকারত্ব বৃদ্ধি: দেশীয় শিল্পের ধ্বংস হওয়ার ফলে ওই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বহু মানুষ কাজ হারায়। এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।


ii. দারিদ্র্য বৃদ্ধি : বিপুল পরিমাণ মানুষের বেকারত্বের ফলে ভারতীয় সমাজে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়।


iii. কৃষির ওপর চাপ বৃদ্ধি : কুটিরশিল্পের ধ্বংসের ফলে মানুষ জমির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে জমির ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়।


iv.  বাণিজ্যের রূপান্তর : কুটিরশিল্পের ধ্বংসের আগে ভারত বাণিজ্যক্ষেত্রে রপ্তানি বেশি করত, আমদানি ছিল কম। কিন্তু দেশীয় শিল্পগুলি ধ্বংসের ফলে আমদানি বৃদ্ধি পায়, রপ্তানি কমে যায়। ফলে বাণিজ্যের সূচক ভারতের বিপক্ষে চলে যায়।


v. শহরের অবনতি: দেশীয় শিল্পের পতনের ফলে শিল্পের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা বহু শহর ধ্বংস হয়। ঢাকা, মুর্শিদাবাদের মতো বিখ্যাত শহরগুলিরও জনসংখ্যা ব্যাপক হারে হ্রাস পায়। 1830 খ্রিস্টাব্দে ঢাকা শ্রীহীন নগরী এবং 1840 খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদাবাদ জনবিরল গ্রামে পরিণত হয়। 


vi. শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব: বস্ত্র বা অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষ ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকে পরিণত হয়। এভাবে ভারতে ‘প্রলেটারিয়েত' শ্রেণির উদ্ভব হয়।


মূল্যায়ন : দেশীয় বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্পের ধ্বংসের ফলে ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সমাজের পতন হয়। ভারতবর্ষ উৎপাদনের বদলে ইংল্যান্ডের কারখানার কাঁচামালের জোগানদার ও কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়।

No comments:

Post a Comment