প্রশ্ন: 1. মার্কেন্টাইলিজম কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। অথবা, মার্কেন্টাইল অর্থনীতি কাকে বলে ? এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। 3+5
উত্তর :
মার্কেন্টাইল মতবাদের সংজ্ঞা: 1600 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপে এক সংরক্ষিত বাণিজ্যিক মনোবৃত্তির প্রসার ঘটে যা মার্কেন্টাইলিজম (Mercantilism) র নামে পরিচিত। মার্কেন্টাইলিজমের প্রধান উদ্দেশ্য হল স্ক ইউরোপীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা। এককভাবে এই মতবাদের সংজ্ঞা নির্দেশ করা যায় না। সংক্ষেপে, রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ই আরও সমৃদ্ধিশালী করতে এক গুচ্ছ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অ কর্মসূচিকেই মার্কেন্টাইলিজম বলা হয়। তবে এই একগুচ্ছ নীতির প্রত্যেকটি একই সময়ে কোনো ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
প্রবর্তক : সতেরো শতকে ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জাঁ ব্যাপ্তিস্ত কোলবের্ত এই নীতি ফ্রান্সে প্রবর্তন করেন। প্রথম এলিজাবেথের আমলে টমাস মান ইংল্যান্ডে এই ব্যবস্থার প্রয়োগ করেন।
মূলতত্ত্ব: ধনতন্ত্র বা Capitalism-এর চেয়ে প্রাচীন মার্কেন্টাইলিজমের মূল কথা হল — সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা থেকেই ধনের উৎপত্তি এবং এই ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্রাট বা রাষ্ট্রকেই বিত্তশালী করার জন্য ব্যবহার করা উচিত। সাম্রাজ্যের প্রসার ও নিরাপত্তার জন্য স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করে। এই সৈন্যবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর স্বর্ণমুদ্রার। যে রাষ্ট্রের কোশাগারে যত বেশি স্বর্ণমুদ্রা বা সোনা থাকবে সেই রাষ্ট্র তত বেশি সম্পদশালী হবে। এইজন্য কোলবের্ত ফ্রান্সে সোনা রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করে অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি হ্রাস করে রপ্তানি বৃদ্ধি করেন। ফলে রাজকোশে লভ্যাংশ বৃদ্ধি পায়। প্রথমে সোনাকে মানদণ্ড ধার্য করা হলেও পরবর্তী কালে রুপা, তামা, মশলা, তেল সব কিছুকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
➤ মার্কেন্টাইল অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য : মার্কেন্টাইল অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলি হল –
(i) বুলিয়ানকেন্দ্রিক অর্থনীতি: মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বুলিয়ানিজম। সোনা বা রুপার তালকে বুলিয়ান বলা হয়। মার্কেন্টাইল মতবাদে রাষ্ট্রের সোনার ভাণ্ডারকেই একমাত্র ধনের মানদণ্ড বলে বিবেচনা করা হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে বলা হয় সোনার রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি বৃদ্ধি করতে হবে। আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত স্বর্ণমুদ্রা বা বুলিয়ান এবং মুদ্রার সংগৃহীত রাজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সোনা-রুপার মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
(ii) বাণিজ্যের ভারসাম্য: বাণিজ্যের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা মার্কেন্টাইল অর্থনীতির অপর প্রধান বৈশিষ্ট্য। মার্কেন্টাইল মতবাদে পণ্য আমদানির পরিবর্তে রপ্তানি বেশি করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ফলে বাণিজ্যের সূচকটি রাষ্ট্রের অনুকূলে থাকে। যে রাষ্ট্র আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি করত সেই রাষ্ট্রটির ভাঙারে সোনা বৎসরান্তে বেশি জমা থাকত। পরবর্তীকালে রপ্তানি কর এবং বিমা বা পরিবহণের জন্য খরচও রপ্তানি মূল্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই স্বর্ণমুদ্রা বা বুলিয়ান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
(iii) সম্রাটের স্বার্থের প্রাধান্য: সম্রাট রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তাই দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও তাঁরই সুখ-সুবিধার্থে পরিচালিত হওয়া উচিত বলে মনে করা হত। এর ফলে মার্কেন্টাইল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রধান পরিচালক হয়ে ওঠেন রাজা বা সম্রাট। তাই তিনি এই নীতির মুনাফা ভোগ করে থাকেন। এর ফলে রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়।
(iv) শিল্প ও বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ : প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই উদ্দেশ্য থাকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা। তাই যে-কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শিল্প স্থাপন বা বাণিজ্যের প্রসারে উদ্যোগী হলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাষ্ট্র এগিয়ে আসে। ফলে রাষ্ট্র একটি নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
(v) কৃষি বাণিজ্যকরণ : মার্কেন্টাইলবাদ কৃষিক্ষেত্রে বাণিজ্যকরণকে সমর্থন করে। খাদ্যশস্য আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কৃষকদের কৃষিকাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশেষ কর মকুব করা হয়। রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনের চাইতে বিশেষত বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন কৃষকদের উৎসাহিত করে।
(vi) শিল্প সংরক্ষণ : মার্কেন্টাইল মতবাদে ইউরোপে শিল্পের উন্নতির জন্য বিদেশি শিল্পজাত পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়। আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর আমদানি কর হ্রাস করা হয়। এর ফলে ইউরোপীয় শিল্পের উন্নতি ঘটে। বিদেশের উন্নত পণ্যের প্রতিযোগিতার হাত থেকে ইউরোপীয় শিল্প রক্ষা পায়।
(vii) উপনিবেশ স্থাপন : শিল্পগুলি সারাবছর চালু রাখার জন্য কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্র ও উৎপাদিত পণ্যের বাজার দখল করার জন্য প্রয়োজন হয় উপনিবেশ স্থাপন করার। এর ফলে উপনিবেশ দখলের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমেই ইউরোপীয় দেশগুলি সমৃদ্ধ হয়।
(viii) নৌবহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি : বৈদেশিক বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ ও উপনিবেশগুলি রক্ষার জন্য সমুদ্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার আবশ্যিক হয়ে ওঠে। এর ফলে সামরিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নৌবহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি রাষ্ট্র বিশেষত স্পেন, পোর্তুগাল, ব্রিটেন বিশাল নৌবাহিনী গড়ে তোলে।
(ix) ধনী-দরিদ্র ব্যবধান: মার্কেন্টাইল মতবাদে সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে সমাজ ধনী-দরিদ্র ব্যবধানকেও স্বীকার করে নেয়।
❐মূল্যায়ন: মার্কেন্টাইল মতবাদ ছিল রাষ্ট্রের সরকার ও বণিক শ্রেণির সমঝোতার ফসল। জাতীয় রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও প্রসারের জন্য সেনাবাহিনী গঠনে রাজস্ব ও শুল্ক প্রদান করে বণিক শ্রেণি। তার বিনিময়ে বণিকগণ উপনিবেশে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার সরকারের কাছ থেকে লাভ করে। আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক স্থাপন বা নিষেধাজ্ঞা জারি করে বণিকরা স্বার্থ সুরক্ষিত করে। অপরদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
প্রশ্ন: 2.মার্কেন্টাইলবাদের ত্রুটিগুলি কী কী? অ্যাডাম স্মিথ মার্কেন্টাইলবাদের কী সমালোচনা করেছেন ? 5+3
উত্তর :
মার্কেন্টাইল মতবাদের সংজ্ঞা : 1600 থেকে 1800 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপে এক সংরক্ষিত বাণিজ্যিক মনোবৃত্তির প্রসার ঘটে যা মার্কেন্টাইলিজম (Mercantilism) নামে পরিচিত। মার্কেন্টাইলিজমের প্রধান উদ্দেশ্য হল ইউরোপীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা। এককভাবে এই মতবাদের সংজ্ঞা নির্দেশ করা যায় না। সংক্ষেপে, রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আর সমৃদ্ধিশালী করতে এক গুচ্ছ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নীতিকেই মার্কেন্টাইলিজম বলা হয়। তবে এই একগুচ্ছ নীতির প্রত্যেকটি একই সময়ে কোনো ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
(a) মার্কেন্টাইলবাদের ত্রুটি : উৎপত্তির অল্পকালের মধ্যেই মার্কেন্টাইলবাদ একটি সফল পন্থা হিসেবে ইউরোপে জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু মার্কেন্টাইলবাদের এই সাফল্য ছিল সাময়িক। মার্কেন্টাইলবাদের বেশ কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল। এই ত্রুটিগুলি প্রমাণিত হলে মার্কেন্টাইলবাদ সফল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে নিজের আসন হারায় এবং অল্প দিনের মধ্যেই ইউরোপীয় ক্ষেত্রে বাতিল হয়ে যায়। অ্যাডাম স্মিথের মতো, আরও অনেক অর্থনীতিবিদ মার্কেন্টাইলবাদের নিম্নলিখিত ত্রুটিগুলি তুলে ধরেছেন :
(b) সম্পদের ভুল ব্যাখ্যা: মার্কেন্টাইল মতবাদ অনুসারে প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত এবং পৃথিবীর সীমিত সোনার ভাণ্ডারই ধনের একমাত্র মানদণ্ড। তাই এক ব্যক্তির কাছে যে পরিমাণ বেশি সম্পদ থাকবে তা স্বাভাবিকভাবেই অপর কোনো ব্যক্তি যে পরিমাণ সম্পদ হারিয়েছে তার সমানুপাতিক। কিন্তু বাস্তবে ধনের উৎস অসীম। তাই সম্পদের বিভাজন সমানুপাতিক হয়। না। তা ছাড়া মার্কেন্টাইল মতবাদে প্রাকৃতিক সম্পদের চরিত্র অনুধাবনের ক্ষেত্রে এক বিরাট গলদ আছে। এই মতবাদে প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে সকল যুগে একই ধরনের সম্পদের কথা বলা হয়েছে। এক যুগের প্রাকৃতিক সম্পদ অন্য যুগে সম্পদরূপে স্বীকৃত না হতেও পারে। যেমন—তিমি মাছের তেল।
➣মূল্যবৃদ্ধি: একচেটিয়া বাণিজ্য ও বিদেশি পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষের ( জীবনধারণে অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
➣ আন্তর্জাতিক অস্থিরতা: মার্কেন্টাইল যুগে জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সংঘাতের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ, সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ, আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ, নেপোলিয়নের যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে অশান্ত করে তোলে।
➣ভ্রান্ত উপনিবেশনীতি : মার্কেন্টাইল মতবাদ অনুসারে মনে করা হত যে, উপনিবেশগুলি গড়ে উঠেছে মূলত দেশগুলিকে সমৃদ্ধ করার জন্য। তাই ইংল্যান্ড ও স্পেন উপনিবেশগুলিকে আর্থিক দিক থেকে চরম শোষণ করা শুরু করে। এর ফলে আমেরিকাতে ইংল্যান্ড ও স্পেনের উপনিবেশগুলি হাতছাড়া হয়। তাই মার্কেন্টাইল মতবাদের ঔপনিবেশিক নীতিও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।
➣অ্যাডাম স্মিথের ব্যাখ্যা : অ্যাডাম স্মিথ মার্কেন্টাইল মতবাদকে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের মধ্যে অশুভ সমঝোতা বলে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবিক ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইলিজম সরকার ও একশ্রেণির বণিকের স্বার্থরক্ষার জন্য পরিচালিত হত। ফলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ উপেক্ষিত হত। রাষ্ট্রকে সৈন্যবাহিনী গঠন করার জন্য রাজস্ব ও অন্যান্য শুল্ক দেওয়ার বিনিময়ে বণিক শ্রেণি তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষার জন্য বৈদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে সরকারি সমর্থন সুনিশ্চিত করেছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি, কোটা বা পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে বণিকদের স্বার্থ সরকার রক্ষা করত, অপরদিকে বৈদেশিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া বা সফল ব্যবসায়ীকে সরকারি অনুদান দিয়েও সাহায্য করে। এ ছাড়াও সরকার যন্ত্রপাতি রপ্তানি ও দক্ষ শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়া নিষিদ্ধ করে।
উপরিউক্ত ত্রুটিগুলির জন্য মার্কেন্টাইলিজম সফল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে নিজের আসন হারায়। ইউরোপীয় ক্ষেত্রে নীতিটি অল্প দিনের মধ্যেই বাতিল হয়ে যায় এবং ‘মুক্ত বাণিজ্য' নীতি ইউরোপে প্রাধান্য বিস্তার করে।
প্রশ্ন: 3.মার্কেন্টাইলবাদের সুফল ও কুফলগুলি আলোচনা করো। অথবা, বিশ্বের রাজনীতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাব আলোচনা করো।
উত্তর :
» ভূমিকা : সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাবেই ইউরোপের বাইরে উপনিবেশ স্থাপিত হয়। উপনিবেশগুলি থেকে শোষিত সম্পদ ইউরোপের শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটায়। শিল্পের প্রয়োজনেই দাস প্রথার অবসান ঘটে। একচেটিয়া বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশের ফলে ইউরোপের জমিদার থেকে বণিক শ্রেণির শ্রীবৃদ্ধি বেশি হয়। উদ্ভব হয় বিভিন্ন পেশার মানুষের, ফলে সামাজিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে।
➣ মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাবগুলি আলোচনার সুবিধার জন্য দু-ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। সেগুলি হল- মার্কেন্টাইল অর্থনীতির সুফল -
(i) জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব : মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাবে ইউরোপের জাতীয় রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্র বণিকদের সুরক্ষা ও বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা প্রদান করে যেমন করের বোঝা লাঘব করে তেমনি বিদেশি পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করে। রাষ্ট্র একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ দেয় এবং এর পরিবর্তে বণিক শ্রেণিও রাষ্ট্রকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা কর বাবদ রাজার ভাণ্ডারে জমা দেয়। এর ফলে রাজার আয় কেবল ভূমিরাজস্বের ওপর নির্ভরশীল থাকল না। এই অর্থ দিয়ে রাজা সৈন্যবাহিনী গঠন করে শক্তি সঞ্চয় করল। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন ও পোর্তুগালের সম্রাটের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই ইউরোপে প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্রের উদ্ভব মার্কেন্টাইল মতবাদের বিকাশের সঙ্গে জড়িত।
(ii) বাণিজ্যিক বিপ্লব: মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাবে ইউরোপে বাণিজ্যিক বিপ্লব সংগঠিত হয়। নতুন নতুন দেশ ও জলপথ আবিষ্কারের ফলে বাণিজ্যের জন্য সমগ্র বিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে যায়। ফলে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি রাষ্ট্রই ক্ষমতাশালী নৌবণিক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার প্রদান বা সফল ব্যবসায়ীকে অনুদান দিয়ে সরকারও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিত। মার্কেন্টাইল যুগের বাণিজ্যের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সোনা বা রুপা আমদানি করা। সামুদ্রিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি সফল ছিল ওলন্দাজরা। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্যই নেভিগেশন আইন পাস করে।
(iii) আর্থিক উন্নতি : মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাবে স্পেন, পোর্তুগাল, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও ফ্রান্সের আর্থিক উন্নতি ঘটে। মার্কেন্টাইল অর্থনীতিতে ইউরোপীয় দেশগুলি উপনিবেশগুলিকে শোষণ করে সমৃদ্ধ হয়। তা ছাড়া মার্কেন্টাইল নীতিতে সোনা রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি বেশি করা হত। অন্যদিকে পণ্য আমদানি অপেক্ষা রপ্তানি বেশি করা হত। ফলে বাণিজ্যের সূচক ইউরোপীয় দেশগুলির অনুকূলে থাকত।
(iv) কৃষিব্যবস্থার উন্নতি : এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবে কৃষির উন্নতি ঘটে। ইউরোপীয় দেশগুলিতে বহু পতিত জমি ও জলাভূমিকে কৃষির উপযোগী করে তোলা হয়। কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য অনেক সময় কর মকুব করা হত। কারণ কৃষকরা বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি হ্রাস পাবে এবং রাজকোশে স্বর্ণমুদ্রা জমা থাকবে।
(v) দাস প্রথার অবসান : মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাবে ক্রীতদাস ও ভূমিদাস প্রথার বিলোপ ঘটে। শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিক্ষেত্রে মজুরির বিনিময়ে স্বাধীন শ্রমিক নিয়োগ শুরু হয়। (vi) নৌ-পরিবহণের উন্নতি : সামুদ্রিক বাণিজ্য ও সমুদ্রের ওপর আধিপত্য স্থাপনের জন্য ইউরোপে নৌবহর শিল্পের উন্নতি ঘটে। হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন ও পোর্তুগালের নৌশক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটে।
➣ মার্কেন্টাইল অর্থনীতির কুফলগুলি হল-
(i) জনস্বার্থ বিরোধী: অ্যাডাম স্মিথ তাঁর 'The Wealth of Nation' গ্রন্থে মার্কেন্টাইল ব্যবস্থাকে বণিক গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের মধ্যে অশুভ আঁতাত ও জনস্বার্থ বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এই ব্যবস্থায় জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। সরকারও বণিকদের স্বার্থে পরিচালিত হয়। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
(ii) রাষ্ট্রীয় সংঘাত : মার্কেন্টাইল যুগে জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সামরিক সংঘাত সংখ্যায় এবং তীব্রতার নিরিখেও বৃদ্ধি পায়। এই সময় প্রতিটি রাষ্ট্র স্থায়ী পেশাদার সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনী গড়ে তোলে। ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধ, অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ, সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ ও আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতিকে অস্থির করে তোলে। সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপের জাতীয় রাষ্ট্রগুলি ক্ষমতা বিস্তারের জন্যই পারস্পরিক সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
(iii) কৃষকদের দুরবস্থা : মার্কেন্টাইল যুগে কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি পায়। কৃষকরা জমির ওপর মালিকানা হারায়। জমিদার বা ভূস্বামীরা জমির মালিকে পরিণত হয়। নগদ অর্থে খাজনা দেওয়ার প্রথা প্রবর্তন হওয়ার ফলে কৃষকরা মহাজনদের শোষণের কবলে পড়ে। নির্দিষ্ট ফসলের ভাগের বিনিময়ে ভাগচাষ প্রথার উদ্ভব হয়। আখ, পাট, শন, নীল, আফিং প্রভৃতি বাণিজ্যিক ফসলগুলি বণিক শ্রেণির কাছে লাভজনক ছিল কিন্তু কৃষকদের কাছে ছিল না— অতএব এই ফসলগুলি কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি করে।
(iv) ঔপনিবেশিক শোষণ বৃদ্ধি: মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাবে উপনিবেশগুলির ওপর শোষণ বৃদ্ধি পায়। স্পেনের ঔপনিবেশিক শোষণ ও অত্যাচারের জন্য ধ্বংস হয় আজটেক ও ইনকার মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলি। মার্কেন্টাইল যুগে মনে করা হত উপনিবেশগুলি স্থাপিত হয়েছে ইউরোপীয় মাতৃদেশগুলিকে সমৃদ্ধ করার জন্য। ফলে উপনিবেশের অধিবাসীদের ওপর শোষণ ও অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই শোষণের হাত থেকে রক্ষার জন্যই আমেরিকার ঔপনিবেশিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
(v) ধনী-দরিদ্র ব্যবধান বৃদ্ধি : মার্কেন্টাইল যুগে ধনী-দরিদ্র ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। এই মতবাদে বলা হয় যে, একটি ব্যক্তি বা দেশ যত বেশি সম্পদ লাভ করবে অন্য একটি ব্যক্তি বা দেশ সেই পরিমাণ সম্পদ হারাবে। সম্পদের ওপর ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত হওয়ার ফলে ধনীরা আরও ধনী হয়, গরিব আরও গরিব হয়। রাষ্ট্র কেবল বণিকদের স্বার্থরক্ষা করায় সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
❐ মূল্যায়ন : মার্কেন্টাইল যুগের কুফলগুলির প্রভাবেই দক্ষিণ আমেরিকাতে স্পেনের বিশাল সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়। আমেরিকা স্বাধীনতা ঘোষণা করার ফলে ইংল্যান্ডেরও বিশাল ক্ষতি হয়। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দেশে দেশে সামরিক সংঘাত বৃদ্ধি সত্ত্বেও মার্কেন্টাইল যুগে বিশেষত ইংল্যান্ডের ব্যাপক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়।
No comments:
Post a Comment