👉( ঠান্ডা লড়াই কাকে বলে? এর পটভূমি আলোচনা করো )
প্রশ্ন: ট্রুম্যান নীতি কী? মার্শাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল ? 4+4
❐ ভূমিকা : 1947 খ্রিস্টাব্দের 12 মার্চ মার্কিন সিনেটের এক যৌথ অধিবেশনে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান ঘোষণা করেন যে, সাম্যবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার আক্রমণ বা সশস্ত্র সংখ্যালঘু কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রতিরোধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর যে-কোনো দেশকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেবে যা তাঁর নাম অনুসারে ‘টুম্যান নীতি' নামে পরিচিত।
❐ ট্রুম্যান নীতি :
❐ পটভূমি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলির আর্থিক সংকটের সুযোগ নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে প্রাধান্য বিস্তার করে। এরপর সোভিয়েত রাশিয়া, গ্রিস ও তুরস্কে সাম্যবাদের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হয়। গ্রিসে সাম্যবাদের প্রসার প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকা এই ঘোষণা করে।
❐ উদ্দেশ্য : এই নীতি ঘোষণার পশ্চাতে আমেরিকার কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল। এগুলি হল :
(i) সাম্যবাদের প্রতিরোধ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যবাদকে প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই নীতি গ্রহণ করে।
(ii) অস্ত্র বিক্রি: এই নীতি ঘোষণার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অর্থসাহায্যের নাম করে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিকে অস্ত্র বিক্রি করা।
(iii) বাণিজ্যের প্রসার: সবশেষে, মার্কিন শিল্পজাত পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো।
❐ গুরুত্ব :
(i) তুরস্কে সাম্যবাদের প্রতিরোধ: রাশিয়া ও তার সাম্যবাদী মতাদর্শ থেকে তুরস্ককে প্রভাবমুক্ত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর অর্থসাহায্য করে। তুরস্কের স্বাধীনতা অটুট থাকে ।
(ii) গ্রিসে কমিউনিস্টদের দমন: গ্রিসের রাজতন্ত্রী সরকারকে কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য আমেরিকা 400 মিলিয়ন ডলার সাহায্য করে। মার্কিন সাহায্যে বলীয়ান হয়ে গ্রিস কমিউনিস্টদের দমন করে।
(iii) ইরানের সঙ্গে চুক্তি: সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত করার জন্য ইরানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থসাহায্য করে এবং ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করে। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল ইরানের তেলের খনিগুলিকে দখল করা।
(iv) ঠান্ডা লড়াই-এর সূচনা: ট্রুম্যান নীতিকে কার্যকর করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমি দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি সোভিয়েত রাশিয়ার বিরোধিতা করে। ফলে মার্কিন পুঁজিবাদের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সংঘাত ঘটে এবং ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়।
❐ মার্শাল পরিকল্পনা:
1947 খ্রিস্টাব্দের 5 জুন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জর্জ সি মার্শাল হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বক্তৃতায়— যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ইউরোপীয় দেশগুলিকে আমেরিকার কাছ থেকে অর্থসাহায্য নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের জন্য সাম্যবাদের প্রসার ঘটছে। তাই জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থসাহায্য করবে এই অর্থ দিয়ে। তারা নিজেদের দেশকে আর্থিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর করবে কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শগত কোনো পরিকল্পনায় এই অর্থ ব্যয় করা চলবে না। এটি 'মার্শাল পরিকল্পনা' নামে পরিচিত।
❐ উদ্দেশ্য: এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্যগুলি হল:
(i) যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের দেশগুলিকে অর্থসাহায্য করে সোভিয়েত সাম্যবাদ থেকে মুক্ত রাখা।
(ii) অর্থসাহায্য গ্রহণকারী দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি গ্রহণের ওপর আমেরিকার প্রভাব বিস্তার করা।
(iii) অর্থসাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলিকে মার্কিন নীতিতে আস্থাভাজন তৈরি করা ও মার্কিন জোটের শক্তি বৃদ্ধি করা।
(iv) অর্থসাহায্য দিয়ে পূর্ব ইউরোপের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে মার্কিন পণ্যের বাজার তৈরি করা।
❐ গুরুত্ব :
(i) ইউরোপের উন্নয়ন: মার্শাল পরিকল্পনার আর্থিক সাহায্য পেয়ে ইউরোপের শিল্পক্ষেত্রে 1/4 অংশ এবং কৃষিতে 1/10 অংশ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরোপের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
(ii) 16টি দেশকে সাহায্য: এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমেরিকা 16টি দেশকে 1,200 কোটি ডলার সাহায্য করে। এতে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানির অর্থনীতির উন্নতি ঘটে।
(iii) মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস: মার্শাল পরিকল্পনা অনুসারে অর্থ সাহায্য পেয়ে পশ্চিম জার্মানি ও ফ্রান্সের মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পায়।
(iv) কমিউনিস্টদের পরাজয়: আমেরিকার কাছ থেকে অর্থসাহায্য পেয়ে গণতান্ত্রিক দলগুলি নির্বাচনে কমিউনিস্টদের পরাজিত করে।
(v) ঠান্ডা লড়াই শুরু: আমেরিকার কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলি পুঁজিবাদী জোটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে রাশিয়া ও আমেরিকা এই দুই জোটের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়।
(vi) সমাজতান্ত্রিক জোট গঠন: মার্শাল পরিকল্পনার জবাব দেওয়ার জন্য সোভিয়েত রাশিয়া তার অনুগত দেশগুলির অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কমিকন (COMECON) গঠন করে।
❐ মূল্যায়ন: ট্রুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল হয়। সাম্যবাদের প্রসার রোধ হয় এবং ইউরোপের আর্থিক উন্নতি ঘটে। 1952 খ্রিস্টাব্দে প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার পর মার্শাল পরিকল্পনার অবসান হয়।
No comments:
Post a Comment