👉 ( কীভাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান হয়? ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করো )
প্রশ্ন: ঠান্ডা লড়াই কাকে বলে? এর পটভূমি আলোচনা করো। 2+6
🢖🢖উত্তর:
🢖🢖ঠান্ডা লড়াই : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিজয়ী মিত্রশক্তিবর্গ পরস্পরবিরোধী দুটি রাষ্ট্রজোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট, অন্যদিকে ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। এই দুই জোটের মধ্যে সমগ্র বিশ্বে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের জন্য যে-লড়াই শুরু হয়—তাকে Cold War বা ঠান্ডা যুদ্ধ বলে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু না-হলেও দুটি বিবদমান জোটের মধ্যে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি হয়। এজন্য একে স্নায়ুযুদ্ধ (War of nerves ) বা ব-কলমের যুদ্ধ (Proxy War) বলা হয় ।
🢖🢖 ঠান্ডা লড়াই-এর পটভূমি: ঠান্ডা লড়াইয়ের সৃষ্টির পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল :
❐ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে:
বলশেভিক বিপ্লব শুরু হলে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বিপ্লব দমন করার জন্য জারকে সাহায্য করে। তা সত্ত্বেও 1917 খ্রিস্টাব্দে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক সরকার রাশিয়াতে একটি সাম্যবাদী সরকার গঠন করে। এই সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরে আসে। জার্মানির সঙ্গে ব্রেস্টলিটভস্কের সন্ধি স্বাক্ষর করে। এরপর থেকেই বলশেভিক সরকার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। জার্মানিতে হিটলারের উত্থান হলে মিত্রশক্তি তোষণনীতি গ্রহণ করে।
হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে আক্রমণের চাপে রাশিয়া দিশাহীন হয়ে পড়ে। জার্মান আক্রমণের চাপ কমানোর জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে পশ্চিম ইউরোপ দ্বিতীয় একটি রণাঙ্গন খোলার জন্য রাশিয়া আবেদন করে। মিত্রশক্তি এই আবেদনে সাড়া না-দিলে রাশিয়ার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, রাশিয়ার গেরিলা আক্রমণে জার্মান নাৎসিবাহিনী বিপর্যস্ত হয়। মিত্রপক্ষ যুদ্ধে জয়ের আশায় দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলে, ফলে মিত্রশক্তির প্রতি রাশিয়ার সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়।
❐ জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ:
পটসডাম সম্মেলন চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওপর আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। বাস্তবে জাপান তখন একের-পর-এক যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছিল। বোমা নিক্ষেপ না-করলেও জাপান আত্মসমর্পণ করত। কিন্তু আমেরিকার আসল উদ্দেশ্য ছিল আণবিক বোমার ভয় দেখিয়ে রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এর ফলে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে বিদ্বেষ তৈরি হয়।
❐ প্রবিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা :
পরাজিত জার্মানির ভবিষ্যৎ নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ তৈরি হয়। রাশিয়া চেয়েছিল জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল জার্মানিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে। ফলে রুশ-মার্কিন বিরোধ চরমে ওঠে।
❐ পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার প্রাধান্য স্থাপন:
জার্মান নাৎসিবাহিনীকে বিতাড়িত করে রাশিয়ার লালফৌজ এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটাভিয়াকে নিজের দখলে নিয়ে আসে। এরপর পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, আলবেনিয়া, যুগোশ্লাভিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়াতে সোভিয়েত রাশিয়া তার অনুগত সমাজতান্ত্রিক সরকার স্থাপন করে। এভাবে রাশিয়া পূর্ব ইউরোপে প্রাধান্য স্থাপন করলে পশ্চিমি দেশগুলি আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
মার্কিন সামরিক দফতর পেন্টাগনের সেনাপতিরা ছিল কট্টর রুশ বিরোধী। তারা মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যানকে রাশিয়ার প্রতি কঠোর নীতি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে “এদিকে চার্চিলের ফুলটন বক্তৃতা আমেরিকার রুশবিরোধী নীতিতে ইন্ধন জোগায় সব ট্রুম্যান নীতি: ঘোরতর রুশবিরোধী মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সাম্যবাদী প্রভাব রোধ করার জন্য 1947 খ্রিস্টাব্দের 12 মার্চ ঘোষণা করেন যে, পৃথিবীর যে-কোনো জায়গার স্বাধীন জনগণ যদি কমিউনিস্টদের আগ্রাসন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে—তবে সেখানে তাদের আমেরিকা সব ধরনের সাহায্য দেবে। এটি ‘ট্রুম্যান নীতি' নামে পরিচিত। এই ঘোষণার ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।
❐ প্রমার্শাল পরিকল্পনা:
মার্শাল পরিকল্পনা হল ট্রুম্যান নীতির বাস্তবায়নের পরিপূরক 1947 খ্রিস্টাব্দের 5 জুন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন মার্শাল ঘোষণা করেন যে, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির অর্থনৈতিক সংকট সাম্যবাদ প্রসারের মূল কারণ। তিনি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটি পরিকল্পনা পেশ করেন যা তাঁর নাম অনুসারে মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। ফলে রুশ-মার্কিন লড়াই তীব্র হয়।
❐ বেষ্টনী নীতি :
এই পরিস্থিতিতে 1947 খ্রিস্টাব্দের 4 জুলাই রাশিয়াতে কর্মরত প্রাক্তন সহকারি রাষ্ট্রদূত জর্জ এফ কেন্নান Mr. X ছদ্মনামে 'Foreign Affairs' পত্রিকাতে লেখেন যে—রাশিয়া রণক্লান্ত, রুশ জনগণ দুর্দশাগ্রস্ত। রাশিয়ার দিক থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। তাই আমেরিকার উচিত যে-অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব আছে তাকে সীমাবদ্ধ রাখা। এটি ‘বেষ্টনী নীতি' নামে পরিচিত।
❐ মূল্যায়ন:
ইউরোপের সীমা অতিক্রম করে ঠান্ডা লড়াই দাবানলের মতো সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র বিশ্বের মানুষের মন ভয়ংকর আণবিক যুদ্ধের ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে NATO, SEATO, CENTO, MEDO মতো সামরিক জোট। সোভিয়েত রাশিয়া তৈরি করে ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা—COMECON । সমগ্র বিশ্ব পরস্পরবিরোধী জোটে বিভক্ত হয়। 1991 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েতের পতন ঘটলে এর অবসান ঘটে।
No comments:
Post a Comment