প্রশ্ন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলি লেখো।
🢖🢖উত্তর:
আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (1914-1918 খ্রিস্টাব্দ)। ইতিপূর্বে এত ব্যাপক, ভয়াবহ ও সর্বগ্রাসী যুদ্ধ আর কখনো ঘটেনি। এই রকম একটি বিশাল যুদ্ধ কেবল একটি কারণে ঘটেনি। এর পিছনে ছিল দীর্ঘদিনের নানা ঘটনার ঘাত-সংঘাত। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অস্ত্র-নির্মাণের প্রতিযোগিতা, পারস্পরিক সন্দেহ ও বিদ্বেষ এবং অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ এই যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে।
❐ উগ্র জাতীয়তাবাদ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল শ উগ্র জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের সূচনায় এই সংকীর্ণ, স্বার্থপর, উগ্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জাতিগুলি নিজের দেশ ও জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে এবং অপর দেশ ও জাতিকে পদানত করে নিজের দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়। জার্মানরা টিউটন জাতি, ইংরেজরা অ্যাংলো স্যাক্সন জাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার শুরু করে। এর ফলে ইউরোপে জাতিগত বৈরিতার সৃষ্টি হয়। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে।
❐ অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ: আহত ও অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অপর প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। ফ্রান্স সেডানের যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ও জার্মানির কাছ থেকে আলসাস লোরেন পুনরুদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর ছিল। ট্রেনটিনো ও ট্রিয়েস্ট অস্ট্রিয়ার অধীনে থাকার ফলে ইটালির ঐক্যও অসম্পূর্ণ ছিল। বার্লিনের চুক্তিতে বলকান জাতিগুলির জাতীয় দাবি উপেক্ষা করা হলে সমগ্র বলকান অঞ্চল অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনার ওপর অস্ট্রিয়ার আধিপত্য স্থাপিত হলে সার্বিয়া ক্ষুব্ধ হয়। বলকানে শুরু হয় অস্ট্রো-সার্বিয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল।
❐ বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা: ইউরোপের বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। শিল্পজাত পণ্য বিক্রয় ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, স্পেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্য বিস্তার করে। জার্মানি ও ইটালি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর এই দুটি দেশে শিল্পের উন্নতি ঘটে। জার্মানি ও ইটালি তাদের শিল্পের প্রয়োজনে উপনিবেশ বিস্তারের নীতি গ্রহণ করলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হয়। জার্মানির নৌশক্তি বৃদ্ধি, বার্লিন-বাগদাদ রেলপথের পরিকল্পনা, বুয়োর যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বুয়োরদের সাহায্য দান, মরক্কোর ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা প্রভৃতি ঘটনায় জার্মানির সঙ্গে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সংঘাত প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
❐ পরস্পরবিরোধী রাষ্ট্রজোট : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপীয় দেশগুলি দুটি পরস্পরের বিরোধী জোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইটালি নিয়ে গঠিত হয় ত্রিশক্তি চুক্তি (1882 খ্রিস্টাব্দ), অপরদিকে এই সংগঠনের বিরোধী সংগঠনরূপে ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড গঠন করে ত্রিশক্তি আঁতাত (1907 খ্রিস্টাব্দ)। নিজ নিজ সামরিক শক্তিবৃদ্ধির মাধ্যমে দুটি জোটই ইউরোপে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করে।
❐ সামরিক প্রতিযোগিতা: পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস-এর ফলে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ আত্মরক্ষার জন্য সামরিক অস্ত্র নির্মাণের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। জার্মানি বিশ্বজয়ের জন্য বিশাল সামরিক বাহিনী গঠন করলে ফ্রান্স ও আলসাস লোরেন উদ্ধারের জন্য জোরকদমে সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে। ফলে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে অন্তহীন সামরিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। জার্মানি নৌশক্তি বৃদ্ধি করলে ইংল্যান্ড আতঙ্কিত হয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে ইঙ্গ-জার্মান নৌ-প্রতিযোগিতা শুরু হয়। অনুরূপভাবে বলকান অঞ্চলকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। 1870-1914 খ্রিস্টাব্দ এই সময়ে সমগ্র বিশ্বে আপাত শান্তির আড়ালে বিপুল অস্ত্র নির্মাণ শুরু হয়। তাই এই সময়কে সশস্ত্র শান্তির যুগ বলা হয়। এই বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার ও অস্ত্র নির্মাতাদের পরোক্ষ ইন্ধন রাষ্ট্রনেতাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররোচিত করে।
❐ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংকট: উপরের কারণগুলির ফলে ইউরোপের পরিবেশ যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, ঠিক সেই সময় কতকগুলি আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল। এই ঘটনাগুলি হল—
(i) মরক্কো সংকট
(ii) আগাদির ঘটনা
(iii) বলকান সংকট
এই ঘটনাগুলি ইঙ্গ-জার্মান, অস্ট্রো-রুশ সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে।
❐ পীত সাংবাদিকতা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপের এক শ্রেণির সংবাদপত্র মিথ্যা, বিকৃত ও দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন করে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করে। পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি করে সমগ্র ইউরোপে যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি করে।
❐ প্রত্যক্ষ কারণ (সেরাজাভোর হত্যাকাণ্ড) : 1914 খ্রিস্টাব্দে 28 জুন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়া বসনিয়ার রাজধানী সেরাজাভো শহরে এলে শ্লাভ সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ব্ল্যাক হ্যান্ডর সদস্য ন্যাভরিলো প্রিন্সেপ রাজপথের ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁদের হত্যা করেন। অস্ট্রিয়া এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে একটি চরম পত্র দেয়। সার্বিয়া এই চরম পত্রের প্রায় সকল দাবি মেনে নেয়, কিন্তু যেগুলি মানলে তার সার্বভৌমত্ব থাকবে না সেগুলি মানতে অস্বীকার করে। ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া সার্বিয়া আক্রমণ করলে জার্মানি অস্ট্রিয়ার পক্ষে এবং রাশিয়া সার্বিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। তারপর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সও রাশিয়ার পক্ষে যোগ দেয়। ফলে বলকান অঞ্চলের যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।
No comments:
Post a Comment