👉( ঔপনিবেশিক শাসনকালে 'অবশিল্পায়নের' বর্ণনা দাও।)
প্রশ্ন: চিনে বক্সার বিদ্রোহের কারণগুলি ও ফলাফল লেখো । অথবা, চিনে বক্সার বিদ্রোহের পটভূমি, প্রসার ও গুরুত্ব লেখো।
🢖🢖উত্তর:
🢖🢖ভূমিকা : চিনের ইতিহাসে প্রথম জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ হল বক্সার বিদ্রোহ। 1898 খ্রিস্টাব্দে ‘আই-হো-চুয়ান’ নামে একটি গুপ্ত সমিতি এই বিদ্রোহ পরিচালনা করে। ‘চুয়ান’ কথাটির অর্থ হল মুষ্টিযুদ্ধ। এই সমিতির সদস্যরা মুষ্টিযুদ্ধ অনুশীলন করত এবং হাত সবসময় মুষ্টিবদ্ধ রাখত বলে এই বিদ্রোহের নাম হয় বক্সার বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে সমগ্র উত্তর চিন উত্তাল হয়ে ওঠে। সর্বত্র ধ্বনিত হয় ‘বিদেশিদের ধ্বংস করো', ‘চিংদের রক্ষা করো' শ্লোগান। ‘চিং’ শব্দের অর্থ রাজবংশ। বিদ্রোহীরা চিনা সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ছিল। বৌদ্ধ, কনফুসীয়, তাওবাদের ওপর ভিত্তি করে বক্সার বিদ্রোহীদের মতাদর্শ গড়ে ওঠে।
❐ বক্সার বিদ্রোহের পটভূমি বা কারণ:
❐ বিদেশিদের আধিপত্য: ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির চিনের বিভিন্ন স্থানে আধিপত্য বিস্তার, চিনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও চিনের সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের অভব্য আচরণ চিনাদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। বিদেশি শয়তানদের হাত থেকে রক্ষার জন্য চিনা দেশপ্রেমিকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
❐ বিদেশি শোষণ : বিদেশিদের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ বক্সার বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল। আফিম যুদ্ধের পর চিনের বন্দরগুলি বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত হয়। সমগ্র চিন বিদেশি পণ্যে ছেয়ে যায়। ফলে চিনের শিল্প ও বাণিজ্য ধ্বংস হয়, বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। চিনাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
❐ খ্রিস্টধর্মের বিরোধিতা : 1858 খ্রিস্টাব্দে তিয়েনমিন চুক্তির পর যাজকরা চিনে অবাধে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার অধিকার পায়। 1860 খ্রিস্টাব্দের পিকিং অধিবেশনের পর তারা গির্জা নির্মাণ করার অধিকার পায়। খ্রিস্টান মিশনারিরা দরিদ্র চিনাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করত। এই ধর্মান্তরিত চিনারা ও খ্রিস্টান মিশনারী চিনের প্রাচীন সভ্যতা ও ধর্ম বিরোধী প্রচার শুরু করে। এর ফলে মিশনারীদের চিনের সাধারণ মানুষের সংঘর্ষ শুরু হয়।
❐ প্রাকৃতিক বিপর্যয়: 1898 খ্রিস্টাব্দে ইয়াংসি নদীর প্রবল বন্যা, 1899 খ্রিস্টাব্দে উত্তর চিনের ভয়াবহ খরা চিনের লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন ও অন্নহীন করে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিনারা মনে করে যে, চিনে বিদেশি আধিপত্য ও খ্রিস্টধর্মের কুপ্রভাবের জন্য দেবতাদের অভিশাপে এই বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
❐ রেলপথ নির্মাণ: ইউরোপীয়রা চিনে রেলপথ নির্মাণ শুরু করলে জমিহারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এছাড়া টেলিগ্রাফ লাইন বসাবার সময় পূর্বপুরুষদের 1 কবরস্থানগুলির প্রতি অসম্মানজনক আচরণ সাধারণ মানুষকে - ক্ষিপ্ত করে তোলে।
❐ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষি সংকট : উনিশ শতকে চিনে ব্যাপক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেই অনুপাতে কৃষিজমির পরিমাণ এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। ফলে কৃষিক্ষেত্রে সংকটের সৃষ্টি হয়।
❐ গুপ্তসমিতিগুলির প্রভাব: ‘আই-হো-চুয়ান’, ‘তরবারি সমিতি' প্রভৃতি গুপ্তসমিতিগুলি ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে প্রচার এবং বিদেশিদের হত্যা করে দেশবাসীকে রক্ষা করার কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর ফলে সাধারণ মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
❐ সূচনা : 1900 খ্রিস্টাব্দে শানটুং প্রদেশে বক্সার বিদ্রোহের সূচনা হয়। তারপর সমগ্র উত্তর চিনে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। বক্সার-বিদ্রোহীরা গির্জা ও বিদেশি দূতাবাসগুলি আক্রমণ করে অগ্নি সংযোগ করে। দূতাবাসের কর্মীদের হত্যা করে। জাপানি চ্যান্সেলর সুসিয়ামাকে এবং জার্মান রাষ্ট্রদূত ক্লিমেন্স ভন কেটলারকে হত্যা করে। বক্সার বিদ্রোহীরা বিদেশিদের প্রভাব থেকে চিনকে মুক্ত করার জন্য ‘মাঞ্জুদের রক্ষা করো, বিদেশিদের ধ্বংস করো' এই ধ্বনি তোলে। এর ফলে প্রিন্স চুয়াং ও প্রিন্স তুয়ান বক্সার বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন। বহু রাজকর্মচারী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। রাজমাতা জুসি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বক্সার বিদ্রোহীদের সাহায্য করার নির্দেশ দেন। শানটুং, পিকিং, তিয়েনমিন বিদ্রোহীরা দূতাবাসগুলি আক্রমণ করে।
❐ বিদ্রোহ দমন: বক্সার বিদ্রোহ দমন করার জন্য বিদেশিরা একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন করে। এই বিদেশিবাহিনী তিয়েনমিন দখল করে পিকিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। বক্সার বিদ্রোহীদের পরাজিত করে তারা পিকিং-এর দূতাবাসগুলিকে অবরোধ মুক্ত করে। রাজমাতা জুসি ছদ্মবেশে পিকিং ত্যাগ করেন। এইভাবে বক্সার বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
🢖🢖 বক্সার বিদ্রোহের গুরুত্ব বা ফলাফল : বক্সার বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এটি—এই বিদ্রোহের প্রায় সমগ্র চিনে ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে।
(i) ফলে চিনে বিদেশি বিরোধী মানসিকতার সৃষ্টি হয়। মাঞ্জু রাজবংশ বিদ্রোহীদের সমর্থন করে পরাজিত হয়। এর ফলে চিনের ভবিষ্যৎ বিদেশিদের হাতে চলে যায়।
(ii) আমেরিকার উদ্যোগে মাঞ্জু রাজবংশ চিনের সিংহাসন ফিরে পেলেও হৃত গৌরব ফিরে পায়নি।
(iii) প্রোটোকল মেনে নেবার পর চিনে মাঞ্জু রাজবংশ বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পায়। বক্সার প্রোটোকল চিনের সার্বভৌমিকতাকে ক্ষুণ্ণ করে।
No comments:
Post a Comment