👉 ( বার্লিন সম্মেলনের ( 1885) পটভূমি ও গুরুত্ব লেখো। )
প্রশ্ন: মার্কেন্টাইলবাদের সুফল ও কুফলগুলি আলোচনা করো। অথবা, বিশ্বের রাজনীতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাব আলোচনা করো।
🢖🢖উত্তর:
🢖🢖ভূমিকা : সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাবেই ইউরোপের বাইরে উপনিবেশ স্থাপিত হয়। উপনিবেশগুলি থেকে শোষিত সম্পদ ইউরোপের শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটায়। শিল্পের প্রয়োজনেই দাস প্রথার অবসান ঘটে। একচেটিয়া বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশের ফলে ইউরোপের জমিদার থেকে বণিক শ্রেণির শ্রীবৃদ্ধি বেশি হয়। উদ্ভব হয় বিভিন্ন পেশার মানুষের, ফলে সামাজিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে। মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাবগুলি আলোচনার সুবিধার জন্য দু-ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। সেগুলি হল--
❐ মার্কেন্টাইল অর্থনীতির সুফল :
(i) জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব: মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাবে ইউরোপের জাতীয় রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্র বণিকদের সুরক্ষা ও বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা প্রদান করে যেমন করের বোঝা লাঘব করে তেমনি বিদেশি পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করে। রাষ্ট্র একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ দেয় এবং এর পরিবর্তে বণিক শ্রেণিও রাষ্ট্রকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা কর বাবদ রাজার ভাণ্ডারে জমা দেয়। এর ফলে রাজার আয় কেবল ভূমিরাজস্বের ওপর নির্ভরশীল থাকল না। এই অর্থ দিয়ে রাজা সৈন্যবাহিনী গঠন করে শক্তি সঞ্চয় করল। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন ও পোর্তুগালের সম্রাটের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই ইউরোপে প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্রের উদ্ভব মার্কেন্টাইল মতবাদের বিকাশের সঙ্গে জড়িত।
(ii) বাণিজ্যিক বিপ্লব: মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাবে ইউরোপে বাণিজ্যিক বিপ্লব সংগঠিত হয়। নতুন নতুন দেশ ও জলপথ আবিষ্কারের ফলে বাণিজ্যের জন্য সমগ্র বিশ্ব উন্মুক্ত হয়ে যায়। ফলে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি রাষ্ট্রই ক্ষমতাশালী নৌবণিক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার প্রদান বা সফল ব্যবসায়ীকে অনুদান দিয়ে সরকারও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিত। মার্কেন্টাইল যুগের বাণিজ্যের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে সোনা বা রুপা আমদানি করা। সামুদ্রিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি সফল ছিল ওলন্দাজরা। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্যই নেভিগেশন আইন পাস করে।
(iii) আর্থিক উন্নতি : মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাবে স্পেন, পোর্তুগাল, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও ফ্রান্সের আর্থিক উন্নতি ঘটে। মার্কেন্টাইল অর্থনীতিতে ইউরোপীয় দেশগুলি উপনিবেশগুলিকে শোষণ করে সমৃদ্ধ হয়। তা ছাড়া মার্কেন্টাইল নীতিতে সোনা রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি বেশি করা হত। অন্যদিকে পণ্য আমদানি অপেক্ষা রপ্তানি বেশি করা হত। ফলে বাণিজ্যের সূচক ইউরোপীয় দেশগুলির অনুকূলে থাকত।
(iv) কৃষিব্যবস্থার উন্নতি: এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবে কৃষির উন্নতি ঘটে। ইউরোপীয় দেশগুলিতে বহু পতিত জমি ও জলাভূমিকে কৃষির উপযোগী করে তোলা হয়। কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য অনেক সময় কর মকুব করা হত। কারণ কৃষকরা বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করলে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি হ্রাস পাবে এবং রাজকোশে স্বর্ণমুদ্রা জমা থাকবে।
(v) দাস প্রথার অবসান: মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রভাবে ক্রীতদাস ও ভূমিদাস প্রথার বিলোপ ঘটে। শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিক্ষেত্রে মজুরির বিনিময়ে স্বাধীন শ্রমিক নিয়োগ শুরু হয়। (vi) নৌ-পরিবহণের উন্নতি : সামুদ্রিক বাণিজ্য ও সমুদ্রের ওপর আধিপত্য স্থাপনের জন্য ইউরোপে নৌবহর শিল্পের উন্নতি ঘটে। হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন ও পোর্তুগালের নৌশক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটে।
❐ মার্কেন্টাইল অর্থনীতির কুফলগুলি হল :
(i) জনস্বার্থ বিরোধী : অ্যাডাম স্মিথ তাঁর 'The Wealth of Nation' গ্রন্থে মার্কেন্টাইল ব্যবস্থাকে বণিক গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের মধ্যে অশুভ আঁতাত ও জনস্বার্থ বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এই ব্যবস্থায় জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। সরকারও বণিকদের স্বার্থে পরিচালিত হয়। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
(ii) রাষ্ট্রীয় সংঘাত: মার্কেন্টাইল যুগে জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সামরিক সংঘাত সংখ্যায় এবং তীব্রতার নিরিখেও বৃদ্ধি পায়। এই সময় প্রতিটি রাষ্ট্র স্থায়ী পেশাদার সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনী গড়ে তোলে। ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধ, অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ, সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ ও আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতিকে অস্থির করে তোলে। সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপের জাতীয় রাষ্ট্রগুলি ক্ষমতা বিস্তারের জন্যই পারস্পরিক সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
(iii) কৃষকদের দুরবস্থা : মার্কেন্টাইল যুগে কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি পায়। কৃষকরা জমির ওপর মালিকানা হারায়। জমিদার বা ভূস্বামীরা জমির মালিকে পরিণত হয়। নগদ অর্থে খাজনা দেওয়ার প্রথা প্রবর্তন হওয়ার ফলে কৃষকরা মহাজনদের শোষণের কবলে পড়ে। নির্দিষ্ট ফসলের ভাগের বিনিময়ে ভাগচাষ প্রথার উদ্ভব হয়। আখ, পাট, শন, নীল, আফিং প্রভৃতি বাণিজ্যিক ফসলগুলি বণিক শ্রেণির কাছে লাভজনক ছিল কিন্তু কৃষকদের কাছে ছিল না—অতত্রব এই ফসলগুলি কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি করে।
(iv) ঔপনিবেশিক শোষণ বৃদ্ধি: মার্কেন্টাইলবাদের প্রভাবে উপনিবেশগুলির ওপর শোষণ বৃদ্ধি পায়। স্পেনের ঔপনিবেশিক শোষণ ও অত্যাচারের জন্য ধ্বংস হয় আজটেক ও ইনকার মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলি। মার্কেন্টাইল যুগে মনে করা হত উপনিবেশগুলি স্থাপিত হয়েছে ইউরোপীয় মাতৃদেশগুলিকে সমৃদ্ধ করার জন্য। ফলে উপনিবেশের অধিবাসীদের ওপর শোষণ ও অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই শোষণের হাত থেকে রক্ষার জন্যই আমেরিকার ঔপনিবেশিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
(v) ধনী-দরিদ্র ব্যবধান বৃদ্ধি : মার্কেন্টাইল যুগে ধনী-দরিদ্র ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। এই মতবাদে বলা হয় যে, একটি ব্যক্তি বা দেশ যত বেশি সম্পদ লাভ করবে অন্য একটি ব্যক্তি বা দেশ সেই পরিমাণ সম্পদ হারাবে। সম্পদের ওপর ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত হওয়ার ফলে ধনীরা আরও ধনী হয়, গরিব আরও গরিব হয়। রাষ্ট্র কেবল বণিকদের স্বার্থরক্ষা করায় সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
❐ মূল্যায়ন: মার্কেন্টাইল যুগের কুফলগুলির প্রভাবেই দক্ষিণ আমেরিকাতে স্পেনের বিশাল সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়। আমেরিকা স্বাধীনতা ঘোষণা করার ফলে ইংল্যান্ডেরও বিশাল ক্ষতি হয়। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দেশে দেশে সামরিক সংঘাত বৃদ্ধি সত্ত্বেও মার্কেন্টাইল যুগে বিশেষত ইংল্যান্ডের ব্যাপক অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়।
No comments:
Post a Comment