👉( তাইপিং বিদ্রোহের কারণ, ফলাফল/গুরুত্ব )
প্রশ্ন: পলাশির যুদ্ধের কারণগুলি লেখো।
🢖🢖উত্তর:
🢖🢖ভূমিকা : প্রথমে সিরাজ-উদ্ দৌলার সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক ছিল সুমধুর। কারণ নবাব আলিবর্দি খাঁ সিরাজকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করার পর সিরাজ হুগলি পরিভ্রমণে গেলে ইংরেজ বণিকরা অন্যান্য ইউরোপীয়দের তুলনায় তাঁকে বেশি সম্মান প্রদর্শন করে। কিন্তু সিংহাসনে বসার পর কয়েকটি কারণে ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং বিরোধের সূত্রপাত হয়।
এই কারণগুলি হল—
❐ আনুগত্য প্রদর্শন না করা: সিরাজ-উদ্ দৌলা সিংহাসনে বসার পর অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ভারতীয় প্রথা অনুযায়ী আনুগত্য জানিয়ে নজরানা পাঠালেও ইংরেজরা আনুগত্য দেখিয়ে কোনো নজরানা পাঠায়নি। এই ঘটনায় সিরাজ অপমানিত বোধ করেন এবং ইংরেজদের প্রতি রুষ্ট হন। পরে অবশ্য সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি কাটিয়ে ইংরেজরা সিরাজকে উপঢৌকন পাঠিয়েছিল।
❐ ষড়যন্ত্রের সংবাদ: এ সময়ে সিরাজের কাছে খবর আসে যে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগম ও পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই সংবাদে সিরাজ আরও ক্রুদ্ধ হন।
❐ কৃয়দাসকে আশ্রয় : ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ রাজকোশে অর্থ জমা দেওয়ার ব্যাপারে গরমিল করলে সিরাজ তাঁকে মুর্শিদাবাদে এসে সমস্ত হিসেব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু রাজবল্লভের নির্দেশে তাঁর পুত্র কৃষ্ণদাস প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে যান। কলকাতার ইংরেজ গভর্নর ড্রেক কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দেন। সিরাজ বারংবার নির্দেশ দিলেও ইংরেজরা কৃষ্ণদাসকে নবাবের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে। ইংরেজদের এই উদ্ধত মনোভাব সিরাজকে ইংরেজদের প্রতি ক্রুদ্ধ করে তোলে।
❐ দুর্গ নির্মাণ : দক্ষিণ ভারতে ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাতে ইংরেজ ও ফরাসি উভয় কোম্পানিই দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। সিরাজ উভয়পক্ষকেই দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ফরাসিরা দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করলেও ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণ চালিয়ে যায় এবং নবাবের দূত নারায়ণ দাসকে তারা অপমান করে। এতে নবাবের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।
❐ দস্তকের অপব্যবহার: মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ারের 1717 খ্রিস্টাব্দের ফরমান অনুসারে 'দস্তক' ছিল কোম্পানির বাংলাদেশে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার ছাড়পত্র। কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে দস্তকের ব্যবহার করত। এর ফলে বাংলার নবাব রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতেন। সিরাজ দস্তকের অপব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিলে কোম্পানি নীরব থাকে।
❐ কলকাতা আক্ৰমণ : পরে ইংরেজরা এই বলে যুক্তি দেখায় যে, তারা ভেবেছিল বাংলার সিংহাসনে যেহেতু নবাবরা । দীর্ঘস্থায়ী হন না, সেইহেতু সিরাজ-এর ক্ষেত্রেও অনুরূপ কিছু ঘটবে এবং এই কারণেই তারা উপঢৌকন পাঠাতে বিলম্ব করে। এই পরিস্থিতিতে সিরাজ ইংরেজদের সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাশিমবাজার কুঠি দখল করে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং 1756 খ্রিস্টাব্দে 20 জুন ফোর্ট উইলিয়াম যা দুর্গ সমেত কলকাতা দখল করেন। ইংরেজরা পরাজিত হয়ে ফলতায় আশ্রয় গ্রহণ করে। সম্ভবত সিরাজের নির্দেশে 146 জন বন্দি-ইংরেজকে 18 ফুট লম্বা ও 10 ফুট 10 ইঞ্জি চওড়া একটি ঘরে আটক রাখা হয়। এর ফলে 123 জন বন্দি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়।
এই ঘটনাটি ইতিহাসে 'অন্ধকূপ হত্যা' নামে পরিচিত। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকরা এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, প্রথমত, ওই আয়তনের ঘরে 146 জন বন্দি রাখা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যদিও অধিকাংশ ইংরেজ ফলতায় আশ্রয় নেয়, তাহলে অতজন ইংরেজের ওই ঘরে থাকা সম্ভব নয়। এইভাবে ঘটনাগুলি পরপর ঘটতে থাকলে সিরাজের মনে সন্দেহ হয়। সিরাজ কলকাতা দখলের পর মাতামহ আলিবর্দির নাম অনুসারে কলকাতার নতুন নামকরণ করেন ‘আলিনগর'। মানিকচাঁদকে কলকাতার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। অ্যানি বেসান্ত বলেছেন, এ ক্ষেত্রে জ্যামিতি আঙ্কিক সংখ্যাগুলিকে অপ্রমাণিত করে।
❐ আলিনগরের সন্ধি: কলকাতার পতনের সংবাদ মাদ্রাজে পৌঁছালে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি নৌবহর নিয়ে কলকাতায় আসেন। তাঁরা মানিকচাঁদকে ঘুষ দিয়ে 1757 খ্রিস্টাব্দের 2 ফেব্রুয়ারি একরকম বিনা বাধাতেই কলকাতা পুনর্দখল করেন। এই সংবাদে সিরাজ আবার সসৈন্যে কলকাতায় পৌঁছান। কিন্তু কয়েকদিন যুদ্ধ করার পর 1757 খ্রিস্টাব্দের 9 ফেব্রুয়ারি সিরাজ ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণের অধিকার ফিরে পায় এবং বিনা শুল্কে বাণিজ্য ও নিজ নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করার অধিকার লাভ করে। এই সন্ধি ইংরেজদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে। 0 চন্দননগর দখল: সিরাজ গোপনে ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ বাংলাদেশে ফরাসিদের বাণিজ্যকুঠি চন্দননগর দখল করেন এবং সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
❐ সিরাজ-উদ্ দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: মুর্শিদাবাদের রাজদরবারে জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, ইয়ার লতিফ, মিরজাফর প্রমুখ সিরাজের উদ্ধত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। ক্লাইভ এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। এভাবে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে মিরজাফরকে বাংলার নবাব করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।
❐ পলাশির যুদ্ধ: পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়ণের জন্য আলিনগরের সন্ধির শর্তভঙ্গের অজুহাতে রবার্ট ক্লাইভ সিরাজ-উদদৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। 1757 খ্রিস্টাব্দের 23 জুন পলাশির প্রান্তরে মিরজাফরের চরম বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ-উদদৌলা পরাজিত হন। মিরজাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে ও চক্রান্তে সিরাজ নিহত হন।
❐ মূল্যায়ন : পলাশির যুদ্ধের প্রকৃত কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইংরেজ ঐতিহাসিক এস সি হিলের মতে—নবাবের অহমিকা ও লোভ (Vanity and avarice) পলাশির যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিল। তিনি বলেন সিরাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির অর্থ ও সম্পদ লুঠ করা। দুর্গ নির্মাণ ও অন্যান্য কারণ অজুহাত হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন। পি জে মার্শাল ও ক্রিস বেইলি হিলের মতকেই সমর্থন করেন। অপরদিকে রবার্ট ওরম ও পার্সিভ্যাল স্পিয়ার হিলকে সমর্থন না করে অন্য কথা বলেছেন। ওরম বলেন—ইংরেজরা আর্কটের মতো বাংলার সিংহাসনে নিজেদের পছন্দমতো লোককে বসাবার জন্য সিরাজের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেন—বাংলার সম্পদ কোম্পানির বার্ষিক লগ্নিতে বিনিয়োগ করে বিপুল মুনাফা অর্জন করার লোভে ক্লাইভ ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা নেন। ব্রিজিন গুপ্ত বলেন—ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ইংরেজরা সাম্রাজ্যবাদী কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তার ফলেই পলাশি যুদ্ধের সৃষ্টি হয় ।
No comments:
Post a Comment