👉 ( দক্ষিণ ভারতে ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে শ্রীনারায়ণ গুরুর ভূমিকা উল্লেখ করো।)
প্রশ্ন: ধর্ম ও সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা লেখো। অথবা, সমাজসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা লেখো।
🢖🢖উত্তর:
🢖🢖ভূমিকা : উনিশ শতকে ভারতীয় সমাজ ও ধর্মকে কুসংস্কারের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করে মানবমুক্তির জন্য যে সমস্ত ব্যক্তি জীবন উৎসর্গ করেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। রামমোহন বাল্যকালে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় জ্ঞান অর্জন করার পর জার্মান, ল্যাটিন, হিব্রু, গ্রিক ও ইংরেজি ভাষা শেখেন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মশাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
ফ্রান্সিস বেকন, লক, হিউম, নিউটন, টম পেইন, ভলতেয়ার প্রভৃতি ইউরোপীয় মনীষীর চিন্তাধারার সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। এর ফলে তিনি একজন যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদীরূপে পরিণত হন। রংপুরের দেওয়ানের পদে ইস্তফা দিয়ে রামমোহন রায় হিন্দুধর্ম ও সমাজসংস্কারে ব্রতী হন।
❐ ধর্মসংস্কার : হিন্দুধর্মের প্রচলিত কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, পুরোহিত শ্রেণির প্রাধান্য আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতা রামমোহনকে ব্যথিত করে। খ্রিস্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার জন্য তিনি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
❐ একেশ্বরবাদ: তিনি বেদ-পুরাণ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে মূর্তিপূজা, পুরোহিত তন্ত্র, আচার-সর্বস্বতা হিন্দুধর্মের মূলকথা নয়। হিন্দুধর্মের মূল কথা হল একেশ্বরবাদ। নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা হল হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
❐ একেশ্বরবাদের প্রচার: একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য 1803 খ্রিস্টাব্দে ফারসি ভাষায় ‘তুহাফৎ-উল-মুয়াহিদ্দিন’ (একেশ্বরবাদের প্রতি) নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া ‘ঈশ’ ও ‘কেন’ (1816 খ্রিস্টাব্দ), ‘কঠ’ ও ‘মাণ্ডুক্য’ (1817 খ্রিস্টাব্দ) এবং ‘মন্ডুক’ (1919 খ্রিস্টাব্দে)—এই পাঁচটি উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে তাঁর মত প্রচার করেন।
❐ আত্মীয় সভার প্রতিষ্ঠা: একেশ্বরবাদের আলোচনা ও প্রচারের জন্য রামমোহন রায় তাঁর অনুগামীদের নিয়ে 1813 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘আত্মীয় সভা' প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, নন্দকিশোর বসু প্রমুখ।
❐ ব্রাত্মসমাজ প্রতিষ্ঠা: 1828 খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে 1829 খ্রিস্টাব্দে রামমোহন একেশ্বরবাদ প্রচার করার জন্য ব্রাত্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে পরমব্রহ্মের উপাসনা প্রচার করা এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। 1830 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়।
🢖🢖 সমাজসংস্কার : হিন্দু সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারগুলি দূর করার জন্য রামমোহন রায় উদ্যোগী হন।
❐ কুসংস্কারগুলির বিরোধিতা: হিন্দু সমাজের প্রচলিত নানা কুসংস্কার যেমন—সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ প্রথা, বহুবিবাহ প্রথা, কৌলিন্য প্রথা, কন্যাপণ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন রায় তীব্র প্রতিবাদ জানান ও এই প্রথাগুলির বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন।
❐ সতীদাহ প্রথা বিরোধী প্রচার: হিন্দু সমাজে প্রচলিত প্রথাগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা অমানবিক ছিল সতীদাহ প্রথা। স্বামীর মৃত্যুর পর মৃত স্বামীর চিতায় তার সদ্য বিধবা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার প্রথাকে সতীদাহ বা সহমরণ বলা হত। তিনি এই মর্মান্তিক প্রথার বিরুদ্ধে 1828 খ্রিস্টাব্দে প্রচার করে জনমত গঠন করেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় এই প্রথার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পুস্তিকা লিখে প্রচার করেন। ‘সংবাদ কৌমুদী’ পত্রিকাতে তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখে প্রকাশ করেন।
❐ বড়োলাটের কাছে আবেদন: রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিবারণের জন্য বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র বড়োলাট বেন্টিঙ্কের কাছে জমা দেন। তাঁর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক 1829 খ্রিস্টাব্দে 4 ডিসেম্বর একটি আইন পাশ করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন।
❐ অন্যান্য কাজ : এ ছাড়া বিধবাদের পুনঃবিবাহ, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার, পুরুষের বহুবিবাহ রদ প্রভৃতি কুসংস্কারগুলি দূর করার জন্যও রামমোহন রায় সচেষ্ট হন।
No comments:
Post a Comment