👉( 4 মে আন্দোলনের কারণ ও গুরুত্ব লেখো। )
প্রশ্ন: ব্রিটিশ যুগে দলিত আন্দোলনগুলির বিবরণ দাও। অথবা, ‘দলিত শ্রেণি' কাদের বলে? ব্রিটিশ শাসিত ভারতের দলিত শ্রেণির আন্দোলনগুলির বিবরণ দাও।
🢖🢖উত্তর:
❐ দলিত শ্রেণি : ভারতবর্ষের নিম্ন জাতির মানুষদের ‘দলিত’ বলা হত। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে কুনবি, মালি, মাঙ, মাহার এবং উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের চামার, হাঁড়ি, বাউরী, নমশূদ্র, কাহার, ভূমিহার, ভূমিজ প্রভৃতি শ্রেণির মানুষ ‘দলিত’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঋকবৈদিক যুগে ‘বর্ণাশ্রম' প্রথার সঙ্গেই দলিত শ্রেণির উদ্ভব হয়। হিন্দুধর্মে সমাজের মানুষকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয় ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। প্রথম তিন সম্প্রদায়ের সেবা করার কাজে নিযুক্ত শূদ্র শ্রেণির মানুষ। তিন উচ্চবর্ণের মানুষের ঘৃণা, বৈষম্য ও বঞ্চনার ফলে ‘দলিত' শ্রেণিতে পরিণত হয়। এই সামাজিক বিভাগ ঔপনিবেশিক যুগেও প্রচলিত ছিল। সংস্কৃত ভাষা ও পাশ্চাত্য আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চশ্রেণির মানুষের কাছে ‘দলিত’ শ্রেণি শোষণ, বৈষম্য ও অত্যাচারের সম্মুখীন হয় ।
🢖🢖 ব্রিটিশ শাসিত ভারতে দলিত শ্রেণির আন্দোলন :
❐ আন্দোলনের সূচনা : উনিশ শতকের বেশ কিছু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক ‘দলিত’ শ্রেণির মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক উন্নতির জন্য আন্দোলন শুরু করেন। দলিত শ্রেণির ওপর শোষণ ও বঞ্চনার তীব্র প্রতিবাদ করে আন্দোলন গড়ে তোলেন।
❐ দক্ষিণ ভারতে জ্যোতিবা ফুলে, নারায়ণ গুরু: দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত সমাজসংস্কারক জ্যোতিবা ফুলে কুনবি, মাঙ, মালি, মাহার প্রভৃতি শ্রেণির উন্নতির জন্য সত্যশোধক সমাজ (1873 খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেন ব্রাহ্মণদের শোষণ ও বঞ্চনা দলিত শ্রেণির দুর্দশার প্রধান কারণ। তিনি দলিত শ্রেণির অবস্থার উন্নতির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। দক্ষিণ ভারতের অপর একজন সংস্কারক শ্রী নারায়ণ গুরু দলিত শ্রেণির মন্দিরে প্রবেশের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। দলিতদের হীনম্মন্যতা দূর করে তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। মাদ্রাজ প্রদেশে মোট জনসংখ্যার 3% ছিল ব্রাহ্মণ, কিন্তু সরকারি চাকুরির 42% ছিল তাদের দখলে। এই পরিসংখ্যান থেকে সমাজে ও প্রশাসনে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য অনুমান করা যায়।
❐ বাংলার দলিত আন্দোলন: বাংলার দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত ‘নমশূদ্র’দের ব্রাহ্মণ্য শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেন মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক ‘হরিচাঁদ ঠাকুর' ও ‘গুরুচাঁদ ঠাকুর'। উনিশ শতকের শেষ দিকে উচ্চবর্ণের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে নমশূদ্র সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন যোগেন মণ্ডল ও প্রমথরঞ্জন ঠাকুর।
❐ গান্ধিজি ও জাতীয় কংগ্রেস: জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বে উচ্চবর্ণের প্রাধান্য থাকায় তারা দলিত শ্রেণির ব্যাপারে নীরব ছিল। দলিত শ্রেণিও কংগ্রেসের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করত। গান্ধিজি জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর ‘হরিজন' আন্দোলন গড়ে তোলেন। দলিত শ্রেণিও কংগ্রেসের প্রতি কিছুটা নরম হয়। কিন্তু গান্ধিজির সাবধানী দৃষ্টিভঙ্গি দলিতদের পছন্দ হয়নি।
❐ আম্বেদকরের ভূমিকা: ড. আম্বেদকর দলিত শ্রেণির সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য এবং আর্থিক উন্নতির জন্য আন্দোলন শুরু করেন। 1927 খ্রিস্টাব্দে তিনি মহারাষ্ট্রে দলিত শ্রেণির মন্দিরে প্রবেশের অধিকার ও উচ্চ শ্রেণির বৈষম্যের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। তিনি বৈষম্যের প্রতীক ‘মনুস্মৃতি' গ্রন্থটি প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলেন।
🢖🢖 দলিত সংগঠন :
(i) দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অব্রাক্ষ্মণ সমাজগুলির মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। এর ফলে 1917 খ্রিস্টাব্দে দলিতদের রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘জাস্টিস পার্টি' প্রতিষ্ঠিত হয়।
(ii) 1926 খ্রিস্টাব্দে নাগপুরে 'সর্বভারতীয় দলিত সম্মেলনের পর দলিত আন্দোলন গতিশীল হয়। এই সম্মেলনে 'সর্বভারতীয় দলিত সমিতি' স্থাপিত হয়। এস সি রাজা এই সংগঠনটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
(iii) 1930 খ্রিস্টাব্দে ড. আম্বেদকর ‘সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস' প্রতিষ্ঠা করেন। এই আন্দোলন দলিত শ্রেণির জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি করেন।
(iv) 1942 খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর ‘সর্বভারতীয় দলিত ফেডারেশন' প্রতিষ্ঠা করার পর দলিত আন্দোলন তীব্র গতিশীল হয়ে ওঠে এবং জাতীয় কংগ্রেস দলিত শ্রেণিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে।
❐ পুণাচুক্তি: 1932 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড সাম্প্রদায়িক ঘোষণার মাধ্যমে দলিত শ্রেণির পৃথক নির্বাচনের অধিকার দান করেন। এর প্রতিবাদে গান্ধিজি অনশন শুরু করেন। গান্ধিজির জীবনরক্ষার জন্য হিন্দু উচ্চবর্ণের নেতা মদনমোহন মালব্যর সঙ্গে ড. আম্বেদকর পুণাচুক্তি (1932 খ্রিস্টাব্দের 24 সেপ্টেম্বর) স্বাক্ষর করে নিম্ন হিন্দুদের জন্য দ্বিগুণ আসন লাভ করেন এবং পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেন। ফলে পুণাচুক্তি দলিত শ্রেণির সাফল্যের একটি মাইলফলকে পরিণত হয়। গান্ধিজি 'দলিত' শ্রেণির উন্নতির জন্য আত্মনিয়োগ করেন। দলিত শ্রেণির সামাজিক প্রথাগুলির বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন শুরু করেন।
❐ দলিত শ্রেণির স্বীকৃতি: উনিশ শতকের 40-এর দশকে দলিত আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠলে কংগ্রেস দলিত শ্রেণিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। দলিত নেতা আম্বেদকরকে সংবিধান রচনার জন্য খসড়া কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করে। তাঁর নেতৃত্বে সংবিধান অস্পৃশ্যতাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে লোকসভা ও রাজ্যের বিধানসভাগুলিতে সরকারি চাকুরিতে তাদের আসন সংরক্ষিত করে।
🢖🢖মূল্যায়ন : স্বাধীনতার পর 70 বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু ‘দলিত' শ্রেণির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেও তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি ঘটেনি। হয়তো জগজীবন রাম, মীরাকুমার-এর মতো কেউ উপপ্রধানমন্ত্রী বা স্পিকার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন ঠিকই কিন্তু দেশের ক্ষুধার্ত ও গৃহহীন মানুষের সংখ্যার প্রায় সকলেই ‘দলিত’ শ্রেণির। আর শিক্ষার আঙিনা থেকে তারা অধিকাংশই অনেক দূরে।
No comments:
Post a Comment