প্রশ্ন: কীভাবে নদী সৃষ্টি হয়?
🢖🢖উত্তর: পৃথিবীতে আলো ও উত্তাপের মূল উৎস যেমন সূর্য, নদীর উৎস তেমনিই অধঃক্ষেপণ। অধঃক্ষেপণের প্রধান দুটি রূপ হল বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত। এই বৃষ্টির জল থেকে বা তুষারগলা জল থেকে নদী সৃষ্টি হয়।
ভূপৃষ্ঠে অধঃক্ষেপণ রূপে যে জল পতিত হয়, তার কিছু অংশ বাষ্পীভূত হয়ে যায়, কিছু অংশ ভূগর্ভে প্রবেশ করে এবং অতি সামান্য অংশ ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বৃষ্টির জল বা তুষারগলা জলের যে অংশ ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে নির্দিষ্ট খাতে ভূমির ঢাল বরাবর অভিকর্ষের টানে প্রবাহিত হয় তা বহু জলধারা বা জলপ্রবাহের সৃষ্টি করে। এই জলধারাগুলি মিলিত হয়েই নদী সৃষ্টি হয়।
নদীর সৃষ্টি বিভিন্ন স্থান থেকে হয়ে থাকে। যেমন- উঁচু পর্বতের হিমবাহ, উচ্চ বা অনুচ্চ পাহাড় অথবা মালভূমি, প্রস্রবণ ও অথবা হ্রদ কিংবা অপর কোনো নদী। গঙ্গা নদী গঙ্গোত্রী হিমবাহ শি থেকে উৎপন্ন হয়েছে, দামোদর নদ ছোটোনাগপুর মালভূমির খামারপাত পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে, ভাগীরথী নদী গঙ্গা নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
প্রশ্ন: নদীর শক্তি কীসের ওপর নির্ভর করে? অথবা, নদীর শক্তির সঙ্গে নদীর কাজের কী সম্পর্ক লেখো।
🢖🢖উত্তর: নদীর শক্তি যে বিষয়গুলির ওপর নির্ভর করে সেগুলি হল-
🢖🢖ভূমির ঢাল : ভূমির ঢাল যত বেশি হয় নদীর শক্তি (প্রধানত ক্ষয় ও বহন করার ক্ষমতা) তত বেশি হয়। ভূমির ঢাল কমলে নদীর শক্তিও কমে যায়।
🢖🢖নদীতে জলের পরিমাণ: নদীতে জলের পরিমাণ বাড়লে নদীর ক্ষয় ও বহন শক্তি বাড়ে এবং জলের পরিমাণ কমলে নদীর ক্ষয় ও বহন শক্তি কমে।
🢖🢖জলের গতিবেগ: নদীতে জলের গতিবেগ যত বেশি হয় নদীর নিম্নক্ষয় করার শক্তি এবং বহন ক্ষমতা তত বেশি হয়। জলস্রোতের বেগ কম হলে নদীর এই শক্তি কমে যায়।
🢖🢖নদীবাহিত বস্তুর আকার, ওজন ও পরিমাণ: নদীবাহিত বস্তুগুলি যদি আকৃতিতে ছোটো, হালকা এবং পরিমাণে কম হয়, তবে নদীর বহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আবার বাহিত বস্তুর ওজন ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে নদী তা বহন করতে না পেরে তলদেশে সঞ্চয় করে।
🢖🢖শিলার প্রকৃতি: নদীর তলদেশে শিলার প্রকৃতি নদীর ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। তলদেশের শিলা প্রকৃতিতে কঠিন হলে তা কম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নদীর বোঝার পরিমাণ হ্রাস করবে, যা পরোক্ষভাবে নদীর বহন ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করবে।
প্রশ্ন: নদীর এতো জল আসে কোথা থেকে?
🢖🢖উত্তর: নদী হল ভূপৃষ্ঠের একটি স্বাভাবিক জলপ্রবাহ, যার বেশিরভাগ উৎস হল কোনো পার্বত্য অঞ্চল, মালভূমি, উচ্চভূমি কিংবা কোনো পাহাড়ি অঞ্চল।
নদীর উৎস ও প্রকৃতিগত জলের যোগান আসে। যেমন- তারতম্যেই মূলত নদীতে এতো পার্বত্য অঞ্চল থেকে যে সমস্ত নদীগুলির সৃষ্টি হয় সেগুলিতে সারা বছরই জল দেখতে পাওয়া যায় কারণ, পার্বত্য অঞ্চলে সৃষ্ট হিমবাহগুলি প্রতিদিনই সূর্য তাপে একটু একটু করে গলতে থাকার দরুণ নদীতে জলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ও সারাবছরই কোথাও না কোথাও কম-বেশি বৃষ্টিপাত ঘটে। বেশিরভাগ মালভূমি, উচ্চভূমি, কিংবা পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সৃষ্ট নদীতে জলের মূল উৎস হল বৃষ্টিপাত। প্রধান নদীতে অন্যান্য কোনো উপনদী বিপুল পরিমাণ জল নিয়ে এসে মিশলেও জলের পরিমাণ বাড়ে। কোনো বড়ো নদী ছোটো ছোটো নদীকে গ্রাস করলেও নদীর জল বাড়ে।
প্রশ্ন: নদী কী কী পদ্ধতিতে ক্ষয়কার্য করে?
🢖🢖উত্তর: নদী প্রধানত পাঁচটি পদ্ধতিতে ক্ষয়কার্য করে থাকে। যথা-
🢖🢖 জলপ্রবাহ ক্ষয়: নদীবাহিত জলের আঘাতে নদীর তলদেশ ও দুই পাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সাধারণত অপেক্ষাকৃত কোমল ও অসংলগ্ন শিলাখণ্ডই নদীর জলপ্রবাহ দ্বারা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত ও অপসারিত হলে, তাকে জলপ্রবাহ ক্ষয় বলে।
🢖🢖 অবঘর্ষ ক্ষয়: নদীবাহিত প্রস্তরখণ্ড দ্বারা নদীখাতের (নদীর দুই পাড় ও তলদেশ) ক্ষয়কে অবঘর্ষ ক্ষয় বলে।
🢖🢖 ঘর্ষণ ক্ষয়: নদীবাহিত প্রস্তরখণ্ডগুলি পরস্পরের সঙ্গে ঘষা লেগে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং আয়তনে ক্রমশ ছোটো হতে হতে অবশেষে নুড়ি ও বালিকণায় পরিণত হয়। একে ঘর্ষণ ক্ষয় বলে।
🢖🢖 দ্রবণ ক্ষয়: চুনাপাথর ও খনিজ লবণ সমৃদ্ধ শিলাস্তর নদীর জলে দ্রবীভূত অম্লের প্রভাবে দ্রবীভূত হয়ে যায়, এই প্রকার ক্ষয়কে দ্রবণ ক্ষয় বলে।
🢖🢖 বুদবুদ ক্ষয়: নদীর স্রোত মধ্যস্থিত বুদ্বুদের মধ্যে বাতাসের প্রবল চাপ থাকে। ওই বুদ্বুদ যখন ফেটে যায় তখন তার মধ্যস্থিত বাতাসের চাপে নদী মধ্যস্থ শিলাতে ফাটল ধরে এবং তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, একে নদীর বুদ্বুদ ক্ষয় বলে।
প্রশ্ন: নদী কী কী পদ্ধতিতে বহন করে?
🢖🢖উত্তর: নিম্নলিখিত চারটি প্রক্রিয়ায় নদী প্রস্তরখণ্ড, বালি, কাদা বহন করে থাকে; যথা-
🢖🢖 দ্রবণ প্রক্রিয়ায় বহন: নদীর গতিপথে লবণ বা চুনজাতীয় প্রস্তরখণ্ড থাকলে তাকে দ্রবীভূত করে জলস্রোতের সঙ্গে নদী বহন করে থাকে।
🢖🢖 ভাসমান প্রক্রিয়ায় বহন: ক্ষুদ্রাকার ও কম ওজনের পাথর, বালি বা কাদার কণা নদীস্রোতে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে একস্থান থেকে অন্যত্র ভেসে যায় এবং নদী এগুলিকে ভাসমান অবস্থায় বহন করে থাকে। লম্ফদান
🢖🢖 প্রক্রিয়ায় বহন: নদীর স্রোতের টানে কিছু কিছু শিলাখণ্ড নদীখাতে বারবার ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলে এবং কালক্রমে নদীপথে বাহিত হয়।
🢖🢖 আকর্ষণ প্রক্রিয়ায় টানের মাধ্যমে বহন: নদীগর্ভে পতিত বিভিন্ন রকম ভারী প্রস্তরখণ্ড স্রোতের টানে নদীর তলদেশ দিয়ে বোঝা হিসেবে (Bed load) গড়িয়ে গড়িয়ে অন্যত্র বাহিত হয়।
প্রশ্ন: নদীর বহনক্ষমতার নির্ধারকসমূহ লেখো।
🢖🢖উত্তর: নিম্নলিখিত নির্ধারকগুলির ওপর নদীর বহনক্ষমতা নির্ভর =করে। যথা-
🢖🢖নদীর গতিবেগ: নদীর গতিবেগ বৃদ্ধি পেলে নদীর - বহনক্ষমতা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। আবার নদীর গতিবেগ নদীর প্রত্যক্ষ ঢালের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল। যদি একটি নদীর গতিবেগ - দ্বিগুণ হয় তবে তার বহনক্ষমতা সেই অনুপাতে 64 গুণ (28) বৃদ্ধি । পায়। অর্থাৎ, নদীর বহনক্ষমতা তার গতিবেগের ষষ্ঠাঘাতে বৃদ্ধি পায়।
🢖🢖নদীর জলের পরিমাণ: নদীতে জলের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে নদীর বহনক্ষমতা তত বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ, নদীর জলের পরিমাণ - হ্রাসবৃদ্ধি ও নদীর বহনক্ষমতার হ্রাসবৃদ্ধি পরস্পর সমানুপাতিক - সম্পর্কযুক্ত।
🢖🢖ভূমির ঢাল: ভূমির ঢাল বেশি হলে নদীর গতিবেগ বৃদ্ধি পায়, ফলে নদীর বহনক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
🢖🢖ক্ষরজাত পদার্থের পরিমাণ: নদীতে ক্ষয়জাত পদার্থের পরিমাণ বেড়ে গেলে নদীর বহনক্ষমতা হ্রাস পায়।
🢖🢖বস্তুর আয়তন ও ওজন: নদীতে বৃহদাকার ও ভারী প্রস্তরখন্ডের তুলনায় ক্ষুদ্রাকার ও হালকা প্রস্তরখণ্ড থাকলে বহনক্ষমতা বেশি হয়।
প্রশ্ন: 'I'' আকৃতির উপত্যকা কীভাবে 'V' আকৃতির উপত্যকায় পরিণত হয়? ★
🢖🢖উত্তর: পার্বত্য প্রবাহে ক্ষয়কার্যের ফলে নদী-উপত্যকা নিম্নরূপ দুটি পদ্ধতিতে প্রথমে '।' ও পরে 'V' আকৃতি ধারণ করে - ও পার্বত্যপথের প্রথম অবস্থায় নদীর উপনদীর সংখ্যা কম থাকায় জল ও শিলার জোগান পর্যাপ্ত থাকে না। কিন্তু নদীর ঢাল খুব বেশি হওয়ায় নদী নিম্নক্ষয় করে '।' আকৃতির নদী-উপত্যকার সৃষ্টি করে।
ও নদীর পার্বত্যপথের দ্বিতীয় অবস্থায় ইংরেজি '।' আকৃতির নদী-উপত্যকার দু-পাশ ধস, বৃষ্টির জল বা আবহবিকারের ফলে ক্ষয় পেতে থাকে এবং নদী-উপত্যকার আকৃতি ইংরেজি 'V' অক্ষরের মতো হয়।
প্রশ্ন: নদীর নিম্নগতি বা বদ্বীপ প্রবাহ কাকে বলে? এই প্রবাহে নদীর প্রধান কাজ কী?
🢖🢖উত্তর: সমভূমি প্রবাহের পর নদী যখন প্রায় সাগরের নিকটবর্তী স্থানে এসে পড়ে তখন ভূমির ঢাল একেবারে কমে যায়, ফলে নদীর গতিবেগও কমে যায়। এই গতিকে নদীর নিম্নগতি বা বদ্বীপ প্রবাহ বলে।
🢖🢖 নিম্নপ্রবাহে নদীর কাজ : নিম্নগতিতে নদী অত্যন্ত ধীর গতিতে প্রবাহিত হয় বলে পলি, বালি বহনক্ষমতাও একেবারে কমে যায়। ফলে সেগুলি নদীগর্ভে সঞ্চিত হয়, অর্থাৎ, নিম্নপ্রবাহে নদীর প্রধান কাজ সঞ্চয়। সঞ্চয়কার্যের দ্বারা নদী এই গতিতে প্লাবনভূমি, স্বাভাবিক বাঁধ, বদ্বীপ প্রভৃতি গঠন করে।
প্রশ্ন: বদ্বীপ সৃষ্টির পদ্ধতিটি আলোচনা করো।
🢖🢖উত্তর: নিম্নগতিতে ভূমির ঢাল একদম থাকে না বলে নদীর স্রোতের বেগ ও বহনক্ষমতা দুই-ই কমে যায়। ফলে নদীবাহিত পলি, বালি মোহানা অঞ্চলে সঞ্চিত হতে থাকে যা বদ্বীপ গঠন করে। বদ্বীপ গঠনের পর্যায়গুলি হল -
🢖🢖নদীর মোহানায় সূক্ষ্ম পলির সঞ্চয় বৃদ্ধি। ও নদীগর্ভ অধিক পলি সঞ্চয় দ্বারা ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে ওঠে, ফলে নদীর গভীরতা কমে যায়।
ভূমি ঢালের অভাবে নদীতে স্রোত থাকে না বলে একটু বাধা পেলেই নদী শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়। শাখার মধ্যবর্তী অংশে পলি সঞ্চয় ঘটে। নদীর দুই নদীর সঙ্গে সমুদ্রতরঙ্গ বাহিত পলিরও সঞ্চয় ঘটে, ফলে নদী ও সমুদ্র দুয়ের পলির সমন্বয় হয়।
এরপর মাত্রাহীন 'ব'-এর মতো বা গ্রিক অক্ষর ডেল্টার (Δ) মতো আকৃতির পরিণত বদ্বীপের উৎপত্তি ঘটে।
No comments:
Post a Comment