Class 7th History chapter -3 Questions And Answers || সপ্তম শ্রেণী ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর - Psycho Principal

Fresh Topics

Thursday, 19 December 2024

Class 7th History chapter -3 Questions And Answers || সপ্তম শ্রেণী ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর

  

ইতিহাস 
প্রশ্ন উত্তর




চতুর্থ অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর পড়তে নিচের লিঙ্ক এ ক্লিক করো
👉( চতুর্থ অধ্যায় )


ভূমিকা : খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের ভারতীয় সামাজিক ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন হয়েছিল আলোচ্য অধ্যায়ে সেই সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ইসলাম ধর্মের প্রভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। সুলতান মাহমুদ, মহম্মদ ঘুরি ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলা আক্রমণ করেন ও ধনসম্পদ লুঠ করেন। আনুমানিক ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি বাংলায় তুর্কি আক্রমণের সূচনা করেন। ভারতীয় অর্থনীতির প্রধান অঙ্গ কৃষি এইসময় অর্থনীতির পরিচালক শক্তিতে পরিণত হয়। এইসময় বিভিন্ন রাজবংশ ও ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিষ্কর জমি দান বৃদ্ধি পাওয়ায় সামন্ততন্ত্রের সূচনা হয়। ব্রাহ্মণদের জমি দান করার ফলে কৃষিকার্যের উন্নতি ঘটে। এই যুগের প্রধান শস্য ধান, সর্ষে, আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, খেজুর, নারকেল প্রভৃতি ফল, কার্পাস বা তুলো প্রভৃতি অর্থকরী ফসল উৎপন্ন হতো।

 আনুমানিক ৮০০-১১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাগধী অপভ্রংশ ভাষার গৌড় বঙ্গীয় রূপ থেকে ধীরে ধীরে প্রাচীন বাংলার জন্ম হয়। ‘চর্যাপদ' সন্ধ্যকর নন্দীর 'রামচরিতমানস', চক্রপাণি দত্তের চিকিৎসা বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ 'চিকিৎসা সংগ্রহ' ছিল। এই সময়কার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ ছাড়া নালন্দা, ওদন্তপুরী, বিক্রমশিলা, জগদ্দল প্রভৃতি ছিল শিক্ষার পীঠস্থান ও বৌদ্ধ দার্শনিকদের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এই যুগে অসাধারণ স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন ও পাওয়া যায়।


◾দু-এককথায় উত্তর দাও :


 ১। চোল রাজ্যে কোন্ ধাতুর হস্তশিল্প বিখ্যাত ছিল? ২। চোল রাজ্যের প্রদেশকে কী বলা হত? ৩। চোল বণিকদের কী বলা হত?

 উত্তর। চোল রাজ্যে ব্রোঞ্জ ধাতুর হস্তশিল্প বিখ্যাত ছিল। উত্তর। চোল রাজ্যের প্রদেশকে মণ্ডলম বলা হত। উত্তর। চোল বণিকদের শেট্টি বলা হত। 


৪। চর্যাপদগুলি কখন রচিত হয়?

 উত্তর। চর্যাপদগুলি অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত হয়।


 ৫। ‘উর' ও ‘নাড়ু’ এই সভা দুটি কী দায়িত্ব পালন করত? 

উত্তর। স্বায়ত্তশাসন, বিচার ও রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব। 


৬। দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দানের ব্যবস্থা কী নামে পরিচিত ছিল?

 উত্তর। ব্রহ্মদেয় ব্যবস্থা।


 ৭। চক্রপাণি দত্তের লেখা বইটির নাম লেখো।

 উত্তর। চিকিৎসা সংগ্রহ।


 ৯। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত 'রামচরিত' কাব্যে কোন্ পাল রাজার কাহিনি বর্ণিত আছে?

উত্তর। পাল রাজা রামপালের কাহিনি।


 ৮। পালযুগের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানীর নাম কী ছিল? তাঁর বাড়ি কোথায় ?

উত্তর। পালযুগের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানীর নাম চক্রপাণি দত্ত। তাঁর বাড়ি ছিল বীরভূম জেলায়।

 

 ১০। সিদ্ধাচার্য কারা ? কয়েকজন সিদ্ধাচার্যের নাম লেখো।

 উত্তর। বজ্রযান বা তন্ত্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মমতের প্রচারকরাই সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত। কয়েকজন সিদ্ধাচার্য ছিলেন—লুইপাদ, সরহপাদ, কাহ্নপদ, ভুসুকুপাদ প্রমুখ ।


 ১১। চর্যাপদ-এর পুঁথি কে, কোথা থেকে উদ্ধার করেন?

 উত্তর। চর্যাপদের পুঁথি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে উদ্ধার করেন।


 ১২। পাল যুগের বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে কয়েকটি বৌদ্ধবিহারের নাম লেখো।

 উত্তর। নালন্দা, ওদন্তপুরী, বিক্রমশীল, সোমপুরী, জগদ্দল, বিক্রমপুরী ইত্যাদি।


 ১৩। হিউয়েন সাঙ কত খ্রিস্টাব্দে নালন্দা মহাবিহারে বৌদ্ধ শিক্ষা লাভের জন্য এসেছিলেন?

 উত্তর। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে।


 ১৪। বিক্রমশীল মহাবিহারটি কে কত খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ?

 উত্তর। পাল সম্রাট ধর্মপাল খ্রিস্টীয় অস্টম শতকে বিক্রমশীল মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন।


◾ অতি-সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন :


 ১। বাংলার ইতিহাসে সেন যুগের গুরুত্ব কী ছিল?

 উত্তর। বাংলার ইতিহাসে সেন যুগের প্রধান গুরুত্ব হল :

 (i) পাল বংশের অবক্ষয়ের যুগে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সূচনা হয়, তার অবসান। (ii) পাল রাজাদের মতোই উত্তর-পূর্ব ভারতে একটি বড়ো সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং (iii) সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি।


 ২। সামন্ততন্ত্র কী?

 উত্তর। মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্রভু ও তার অনুচরদের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক লেনদেনের যে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাকে সামন্ততন্ত্র বলা হয়। শাসক তাঁর সেবকদের মধ্যে যে ভূসম্পত্তি দান করতেন তাকে মধ্যযুগে লাতিন ভাষায় ‘Feodum' বলা হত। এই ‘Feodum' শব্দটি থেকে যে ইংরেজি 'Feudalism' (ফিউডালিজম্) শব্দের উৎপত্তি হয় তারই বাংলা অনুবাদ সামন্ততন্ত্র। তবে ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের সাথে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের পুরোপুরি সামঞ্জস্য ছিল না। ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে ছিল একদিকে রাজা ও সামন্তপ্রভুদের পারস্পরিক লেনদেনের সম্পর্ক। অন্যদিকে ছিল সামন্তপ্রভুদের সাথে কৃষকদের আর্থিক আদানপ্রদানের বোঝাপড়া।


 ৩। পাল ও সেন যুগে বাংলার খাওয়া-দাওয়ার পরিচয় দাও ।

 উত্তর। কৃষি নির্ভর বাংলায় পাল ও সেন যুগে ধানই ছিল প্রধান ফসল। তাই ভাত ছিল বাঙালির প্রধান খাদ্য। এর সাথে ঘি, দুধ, পাট শাক, বিভিন্ন ধরনের মাছ (রুই, পুঁটি, মৌরলা ইত্যাদি) ছিল দৈনন্দিনের খাবার। গরিব লোকেদের খাদ্য তালিকায় ছিল বিভিন্ন সবজি, যেমন—বেগুন, লাউ, কুমড়ো, ঝিঙে ইত্যাদি। এই সময় হরিণ, ছাগল, ভেড়া, নানা রকম পাখি ও কচ্ছপের মাংস ইত্যাদি খাওয়ার চল ছিল। মহুয়া ও আখ থেকে তৈরি পানীয়ও বাঙালি সমাজে চালু ছিল।


 ৪। চক্রপাণি দত্ত কে ছিলেন?

 উত্তর। চক্রপাণি দত্ত ছিলেন পালযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তিনি সম্ভবত পালরাজা নয়নপালের সমসাময়িক ছিলেন। তার বাড়ি ছিল বীরভূম জেলায়। তার লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ বই হল ‘চিকিৎসা সংগ্রহ'। চরক ও সুশ্রুতের রচনার ওপর তিনি টীকা লিখেছিলেন। এছাড়া ভেষজ গাছ-গাছড়া, ঔষধের উপাদান, পথ্য নিয়েও তিনি বই লিখেছিলেন।


৫। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান কে ছিলেন?

 উত্তর । দীপঙ্কর-শ্রীজ্ঞান ছিলেন পালযুগের বিখ্যাত বাঙালি পণ্ডিত ও দার্শনিক। তিনি বঙ্গাল অঞ্চলের বিক্রমমণিপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শীলরক্ষিতের কাছে দিক্ষা নিয়ে তিনি ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান' উপাধিতে ভূষিত হন। দীপঙ্কর বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাচার্য ছিলেন। তিব্বত অঞ্চলে তিনি মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তিব্বত, কোরিয়া ও চিনের মানুষের মধ্যে তিনি 'বুদ্ধের অবতার' রূপে পূজিত হন।


 ৬। চর্যাপদ কী?

 উত্তর । পালযুগে মাগধী-প্রাকৃত ও শৌরসেনী অপভ্রংশের মিশ্রণে বাংলা ভাষার আদি রূপের উদ্ভব হয়। এই আদি রূপকে চর্যাপদ বলে। এটি ছিল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকে লেখা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের কবিতা ও গানের সংকলন, লুইপাদ, কাহ্নপাদ প্রমুখ বৌদ্ধধর্মাচার্যের রচিত চর্যাপদগুলি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নমুনা। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে এই চর্যাপদের পুঁথি উদ্ধার করেন।


৩। সংক্ষেপে (৩০-৫০ টি শব্দের মধ্যে) উত্তর দাও : (পূর্ণমান – ৩ )

(ক) দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টীয় নবম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে বাণিজ্যের উন্নতি কেন ঘটেছিল ?

উত্তর। খ্রিস্টীয় নবম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্যের উন্নতিসাধনে বাণিজ্য ব্যবস্থার সাথে নিযুক্ত অনেকগুলি বণিক সংগঠন ও সমবায়ের কথা জানা যায়। আর দক্ষিণ ভারতের সাথে যুক্ত বাণিজ্য পথটিকে নিয়ন্ত্রণ করত দক্ষিণ ভারতের শক্তিশালী চোল শাসকরা। তারা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ও বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলার জন্য 'নগরম' নামের একটি পরিষদ গড়ে তুলেছিলেন। নবম শতক থেকে আরব বণিকদের যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় বহির্বাণিজ্যের উন্নতি হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চোলদের ক্ষমতা বাড়ায় সেখানকার বাণিজ্যের ওপর ভারতীয় বণিকদের প্রভাব আস্তে আস্তে বেড়েছিল। দক্ষিণ ভারতের তাম্রলেখগুলি থেকে জানা যায় যে, শেট্টি বা বণিকরা পণ্য সাজিয়ে যাতায়াত করতেন। এমনকি মন্দিরগুলিকে বণিক সংগঠনগুলি জমি দান করত।


(খ) পাল ও সেন যুগে বাংলায় কী কী ফসল উৎপন্ন হত? সেই ফসলগুলি কোন্ কোন্‌টি এখনও চাষ করা হয়? 

উত্তর। পাল-সেন যুগে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অবদান থাকলেও কৃষিই ছিল অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। এ আমলের বিভিন্ন লেখগুলি থেকে কৃষিনির্ভর সমাজে উৎপাদিত শস্যের একটি বিস্তৃত তালিকা পাওয়া যায়।

ধান, সরষে, পাট, আখ, নীল ও তুলা এই যুগের বাংলার প্রধান কৃষিজাত শষ্য ছিল। এ ছাড়া নানারকমের ফল, যেমন— আম, কাঁঠাল, কলা, ডালিম, খেজুর, নারকেল ইত্যাদি ও ফুলের রীতিমতো চাষ হত। তবে, সে যুগের শস্যের মধ্যে ডালের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ ছাড়া পান, সুপুরি, এলাচ, মহুয়া ইত্যাদিও প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো। পাল ও সেন যুগে বাংলায় উৎপন্ন ফসলের সবকটিই এখনও চাষ করা হয়।


(গ) রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজসভার সাহিত্যচর্চার পরিচয় দাও।

উত্তর। সেনযুগ ছিল বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির যুগ। এ যুগকে বাংলার সংস্কৃত কাব্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। রাজা লক্ষ্মণসেন নিজেই ছিলেন সুকবি। তার রচিত কয়েকটি শ্লোক পাওয়া গেছে।

যাঁরা লক্ষ্মণসেনের রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ধোয়ী, উমাপতি ধর, জয়দেব। ধোয়ীর লেখা ‘পবনদূত’, উমাপতি ধরের লেখা ‘চন্দ্রচূড় চরিত' প্রভৃতি গ্রন্থগুলি সেযুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। লক্ষ্মণসেনের সভাকবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন জয়দেব। তার রচিত ‘গীত গোবিন্দম’ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার এক মনোরম বর্ণনা আছে। এসময়ে আরও দুজন কবি হলেন গোবর্ধন ও শরণ।

এই পাঁচজন কবি একসঙ্গে লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় 'পঞ্চরত্ন' নামে পরিচিত ছিলেন।


 (ঘ) পাল শাসনের তুলনায় সেন শাসন কেন বাংলায় কম দিন স্থায়ী হয়েছিল?

উত্তর। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে যে অরাজকতা, বিদেশি শত্রুর ক্রমাগত আক্রমণ চলছিল, তা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পাল শাসকদের সম্পর্কে স্থানীয় জনসাধারণের মনে এক অনন্য প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই দিক থেকে সেন রাজারা বিদেশি আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে ততটা সফল ছিলেন না। এমনকি সামরিক প্রতিভার দিক থেকে সেন রাজাদের থেকে পাল শাসকরা অনেক এগিয়ে ছিলেন। সেন রাজাদের আমলে স্থানীয় গ্রামীণ শাসনব্যবস্থার অবনতি ঘটেছিল ফলে স্থানীয় জনসাধারণের সাথে রাষ্ট্রের যোগাযোগ শিথিল হয়ে এসেছিল। রাষ্ট্র অসংখ্য ছোটো ছোটো খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সমগ্র পাল শাসনকালে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা অনেকটা শক্তিশালী ছিল। পালযুগের তুলনায় সেন যুগে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি পরিলক্ষিত হয়।

পাল শাসনের তুলনায় সেন শাসন বাংলায় কম দিন স্থায়ী থাকার আরেকটি কারণ ছিল ধর্মীয়। পাল যুগের মতো সেন যুগে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটেনি। সেন রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মকেই প্রাধান্য দিতেন। অন্যদিকে পাল আমলের তুলনায় সেন আমলে বর্ণব্যবস্থা কঠোর, অনমনীয় হয়ে পড়েছিল যা সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় চিড় ধরিয়েছিল।


 ◾ বিশদে (১০০-১২০ টি শব্দের মধ্যে) উত্তর দাও : (পূর্ণমান-৫)

(ক) ভারতের সামন্ত ব্যবস্থার ছবি আঁকতে গেলে কেন তা একখানা ত্রিভুজের মতো দেখায়? এই ব্যবথায় সামন্তরা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করত ?

উত্তর। ভারতের আদি মধ্যযুগের সময়কালে গড়ে ওঠা সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। আমরা যদি সামন্ততন্ত্রের একটি ছবি আঁকি তাহলে তা অনেকটা ত্রিভুজের আকার নেয়। কেননা এই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিম্ন শ্রেণির / শোষক শ্রেণির ওপর শোষণকারী ব্যক্তির সংখ্যা উপরের দিকে ক্রমপর্যায়ে কমতে কমতে প্রধান একজন শাসক বা রাজার ওপর দাঁড়াত। ফলে তা স্বাভাবিকভাবে অনেকটা ত্রিভুজের মতো দেখাত।

আদি-মধ্যযুগে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে গড়ে ওঠা এই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্ত শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার দখল নিয়ে তীব্র মতোবিরোধ থাকলেও এরা প্রত্যেকেই এক জায়গায় ছিল সমকক্ষ। এই সকল সামন্ত শাসকরা কেউই পরিশ্রম করে উৎপাদন করত না। প্রত্যেকেই নিম্ন শ্রেণির থেকে আদায়কৃত দ্রব্য বা রাজস্ব থেকে নিজেরা জীবিকা নির্বাহ করত। এরা যে সকল জমি পেত তাতে সাধারণ কৃষক শ্রেণিকে খাটিয়ে খাবৎ হিসাবে বা নগদ অর্থে রাজস্ব আদায় করত। এই রাজস্বের একটা অংশ মহাসামন্ত ও রাজাদের কাছেই যেত। এই রাজস্ব আদায়ের জন্য সামন্তরা বিভিন্ন ভাবে কৃষকশ্রেণিকে শোষণ করত ও জমিতে বেগার খাটাত। এইভাবেই সামন্ত শাসকরা নিম্নশ্রেণিকে শোষণ করে যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণ - রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে নিজেদের বিসালবহুল জীবন যাপন করতেন।


(খ) পাল ও সেন যুগের বাংলার বাণিজ্য ও কৃষির মধ্যে তুলনা করো।

উত্তর। পাল ও সেন যুগের বাংলার অর্থনীতির প্রধান ভিত্তিই ছিল বাণিজ্য ও কৃষি। তবে এই আমলে বাংলায় বাণিজ্য ও কৃষির মধ্যে অগ্রগতির দিক থেকে বিস্তর ফারাক দেখা দিয়েছিল। বাণিজ্য ও কৃষি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমপর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি।

পাল ও সেন যুগে স্থল ও জলপথেই বাণিজ্যের আদানপ্রদান চলত। প্রাচীন নগরগুলি বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল। বাংলার তাম্রলিপ্ত বা তমলুক বন্দরটি ছিল আন্তর্জাতিক বন্দর। এ ছাড়া হুগলির সপ্তগ্রাম ছিল অপর প্রসিদ্ধ বন্দর। বাংলার মসলিন বস্ত্র ও নানা ধরনের গাছ গাছড়া বিদেশে চালান যেত। এ ছাড়া বাংলার চিনি, গুড়, মশলা, চন্দনকাঠের জিনিস, হাতির দাঁতের জিনিস এবং সোনা, রুপা ও মুক্তোর অলংকারের বিশেষ খ্যাতি ছিল। তবে অষ্টম শতক থেকে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে আরব বণিকদের দাপটের ফলে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্যেও ভাটা পড়ে। ফলে বাংলার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হয়ে পড়েছিল।

পাল ও সেন যুগে কৃষি ছিল বাংলার অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি ও অধিকাংশ মানুষের জীবিকা। বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলার বণিকদের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় বাংলার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হয়ে পড়েছিল। প্রতি গ্রামে বাস্তুভূমি ছাড়াও কৃষি ও গোচারণ ভূমি ছিল। ধান, পাট, আখ, ও তুলা ছিল বাংলার প্রধান কৃষিজাত ফসল। এ ছাড়া নানা ফল ও ফুলের চাষ হতো। জমির ওপর চাষীর স্বত্ত্ব কেমন ছিল তা জানা যায় না। তবে রাজারা উৎপন্ন ফসলের ১/৬ ভাগ কৃষকদের কাছ থেকে কর হিসাবে নিতেন। পাল রাজারা ব্রাক্ষ্মণ, বৌদ্ধবিহার এবং সামন্তদের জমি দান করতেন। এরা চাষ করার জন্য সেই জমি কৃষকদের দিতেন। সেন যুগেও ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করা হত।


(গ) পাল আমলের বাংলার শিল্প ও স্থাপত্যের কী পরিচয় পাওয়া যায় তা লেখো।

উত্তর। পাল শাসনকালে শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে বাংলার ইতিহাস এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়। পাল যুগে কারুশিল্পে, কাচশিল্পে, মৃৎশিল্পে ও ধাতুশিল্পে বাঙালিরা যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ করেছিল। পালযুগের শিল্পরীতিকে প্রাচ্য শিল্পরীতি বলা হয়। এ যুগে পাথর ও ধাতুশিল্পের যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে, সেগুলির বেশিরভাগ হল দেব-দেবীর মূর্তি।পালযুগে পোড়ামাটির শিল্প জনপ্রিয় ছিল। পাহাড়পুরের মন্দিরের গায়ে যে খোদাই করা পাথর ও পোড়ামাটির ফলক আছে তা পালযুগের ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ যুগে ধীমান ও বিভপাল ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী। তাদের চেষ্টায় বাংলায় একটি শিল্পীসংঘ গড়ে উঠেছিল।

পাল আমলের স্থাপত্যের মধ্যে ছিল স্তূপ, বিহার ও মন্দির। পাল রাজত্বকালে তৈরি স্তূপগুলি শিখরের মতো দেখতে ছিল। বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার আসরফপুর গ্রামে, রাজশাহীর পাহাড়পুরে, চট্টগ্রামে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ভরতপুর গ্রামে বৌদ্ধ স্তূপ পাওয়া গেছে। তবে স্তূপ নির্মাণে ওই আমলে বাংলায় কোনো মৌলিক ভাবনার বিকাশ লক্ষ করা যায়নি।

এযুগে স্থাপত্য-শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে বিক্রমশীল মহাবিহার ও সোমপুরী বিহারগুলি ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বাসস্থান ও বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। পাল সম্রাট ধর্মপাল খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে মগধের উত্তর ভাগে গঙ্গার তীরে আধুনিক ভাগলপুর শহরের কাছে বিক্রমশীল মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য সোমপুরী বিহারের ধ্বংসাবশেষ রাজশাহী জেলার অন্তর্গত পাহাড়পুরে পাওয়া গেছে। এই বিহারের আঙ্গিনাটি চতুষ্কোণ ও উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মন্দিরের মধ্যে সোমপুরী বিহারের মন্দিরই ছিল উল্লেখযোগ্য। চারকোণা এই মন্দিরে গর্ভগৃহ, প্রদক্ষিণ পথ, মণ্ডপ, সুউচ্চ স্তম্ভ ইত্যাদি ছিল।


(ঘ) পাল ও সেন যুগের সমাজ ও ধর্মের পরিচয় দাও।

উত্তর। বাংলায় পালযুগে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা- ব্রাক্ষ্মণ, করণ-কায়স্থ, বৈদ্য, গন্ধবণিক, মালাকার, তন্তুবায় ইত্যাদি। তবে কায়স্থ, বৈদ্য ও অন্যান্য সংকর বর্ণ সবই ছিল শূদ্রবর্ণের অন্তর্ভুক্ত। পালযুগে বর্ণবিন্যাস সুস্পষ্টভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে পালযুগের সামাজিক আদর্শ ছিল বৃহত্তর সামাজিক সমন্বয় ও স্বাঙ্গীকরণ। সমাজে ব্রাহ্মণদের পরেই ছিল কায়স্থদের স্থান। বৈদ্য শ্রেণিক আত্মপ্রকাশ ঘটে একেবারে পাল রাজত্বের শেষে। সমাজে এদের যথেষ্ট মর্যাদা ছিল।

সেন যুগে ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের ফলে বর্ণভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণ্য ভিত্তিক সমাজে স্বভাবতই ব্রাহ্মণদের স্থান ছিল সবার উপরে। বাংলার হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য এই তিন শ্রেণির মধ্যে কৌলিন্য প্রথার প্রচলন হয়। অনেকের মতে রাজা বল্লালসেন কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তক।

. পাল ও সেনযুগে সমাজে নারীর তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না। একটিমাত্র স্ত্রী গ্রহণ করাই ছিল স্বাভাবিক প্রথা। তবে রাজারাজরা ও অভিজাতদের মধ্যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করার রেওয়াজও ছিল। সে যুগে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। নাচগানে নারীদের অংশগ্রহণের উল্লেখ আছে।

পাল রাজারা ব্রাহ্মণ ছিলেন না, এরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রসারের উদ্দেশ্যে পালরাজারা অনেক বৌদ্ধ মঠ ও শিক্ষায়তনের প্রতিষ্ঠা করেন। পালযুগে মহাযান বৌদ্ধধর্মের সাথে অন্যান্য দার্শনিক চিন্তাধারা মিলে গিয়ে বজ্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের জন্ম হয়। এই মতের নেতাদের বলা হত সিদ্ধাচার্য। তবে পালরাজারা বৌদ্ধধর্মের অনুগামী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি সমব্যবহার ও উদারতা দেখাতেন।

সেনযুগে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রবল হয়ে ওঠায় বাংলার বৌদ্ধধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সেন যুগে বিষ্ণু, শিব, পার্বতী প্রভৃতি দেব-দেবীর পূজা রীতিমত শুরু হয় এবং বহু মন্দির নির্মিত হয়। সেনযুগে শিবপূজার বিশেষ প্রচলন দেখা যায়। বিষ্ণু, শিব ও শক্তি ছাড়াও অনান্য পৌরাণিক দেব-দেবীর পূজাও বাংলায় প্রচলিত ছিল। অবশ্য এদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

No comments:

Post a Comment