ইতিহাস
প্রশ্ন উত্তর
সপ্তম অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর পড়তে নিচের লিঙ্ক এ ক্লিক করো
👉( সপ্তম অধ্যায় )
ভূমিকা : সুলতানি ও মুঘল যুগে গ্রামের পাশাপাশি অনেক নগর ও শহরের অবস্থান ছিল, যা ছিল আর্থিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। মধ্যযুগের অন্যতম নগর ছিল দিল্লি, এ ছাড়াও অনেক বাজার, যেমন— বাংলায় পান্ডুয়া, গৌড়, নবদ্বীপ, চট্টগ্রাম, পাঞ্জাবের লাহোর, উত্তর ভারতের আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি, গোলকোন্ডা, বিজাপুর সুরাট, আহমেদাবাদ প্রভৃতি। দিল্লিকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে সাতটি নগর শহর গড়ে ওঠে— (১) কিলা রাই পিথোরা, (২) সিরি, (৩) তুঘলকাবাদ, (৪) জাহানপনাহ, (৫) ফিরোজাবাদ, (৬) পুরানা কেল্লা, (৭) শাহাজনাবাদ ।
ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যেকার ভারতে ব্যাবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার দেখা দেয়। বণিকেরা জলপথ ও সড়কপথে বাণিজ্য পরিচালনা করত। পশুর পিঠে, পালতোলা নৌকা ও জাহাজে মালপত্র নিয়ে বণিকরা বেচাকেনা করত। ভারতীয় বণিকদের পাশাপাশি বিদেশি বণিকদের কথাও জানা যায়। এইসময় নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠায় জনসমাগম বৃদ্ধি পায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। সুলতানি আমলে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলগুলির সাথে ভারতের বাণিজ্যের লেনদেন গড়ে ওঠে। সুলতানি শাসকরা নতুন নতুন সড়কপথ, বণিকদের বিশ্রাম ও থাকার জন্য সরাইখানা, কূপ খনন প্রভৃতি কর্মসূচী গ্রহণ করেন।
পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণের মালাবারে উপস্থিত হন। আলবুকাকের হাত ধরে ভারতে পোর্তুগিজ প্রাধান্য স্থাপিত হয়। ডাচ, ফরাসি, দিনেমার, ইংরেজ এরপর একে একে ভারতে নিজ ঘাঁটি স্থাপন করেন। এইভাবে ভারতের গুজরাট, উত্তর ও দক্ষিণ করমণ্ডল এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠে ইউরোপীয় বণিকদের প্রধান অঞ্চল।
◾দু-এককথায় উত্তর দাও :
১. মধ্যযুগে ভারতে গড়ে ওঠা কয়েকটি শহরের নাম লেখো।
উত্তর। মধ্যযুগের শহরগুলি হল দিল্লি, বাংলার পান্ডুয়া, গৌড়, নবদ্বীপ, চট্টগ্রাম, পাঞ্জাবের লাহোর, উত্তর ভারতের আগ্রা, আকবরের তৈরি ফতেপুর সিক্রি, দাক্ষিণাত্যের বুরহানপুর, গোলকোণ্ডা ও বিজাপুর এবং পশ্চিমে আমেদাবাদ, সুরাট ইত্যাদি।
২. কে দিল্লিতে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন ?
উত্তর । ত্রয়োদশ শতকে মহম্মদ ঘুরির সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক ।
৩. শাহজাহানাবাদ শহরটি কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
উত্তর। সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাট শাহজাহান ।
৪. যমুনার তীরে কিলোঘরি প্রাসাদটি কে নির্মাণ করেছিলেন?
উত্তর। ত্রয়োদশ শতকে বলবনের পৌত্র কায়কোবাদ এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
৫. গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নির্মিত শহরটির নাম কী?
উত্তর। তুঘলকাবাদ।
৬. দিল্লি কেন ‘হজরত-ই-দিল্লি' নামে পরিচিত ?
উত্তর। দিল্লি সুফিসাধকদের অন্যতম পীঠস্থান হয়ে ওঠায় এটি ‘হজরত-ই-দিল্লি' নামে পরিচিত।
৭. ‘হৌজ-ই আলাই' নামক চারকোনা জলাধারটি কে খনন করিয়েছিলেন?
উত্তর। আলাউদ্দিন খলজি।
৮. সুলতানি শাসনের সাড়ে তিনশো বছরে দিল্লির শাসকরা মোট কতবার শাসনকেন্দ্র বদল করেছিলেন ?
উত্তর। এগারো বার।
৯. ফতেপুর সিক্রি শহরটি কে কোথায় নির্মাণ করেন ?
উত্তর। আকবর শেখ অলিম চিস্তির স্মৃতিধন্য সিক্রি গ্রামে ফতেপুর সিক্রি শহরটি নির্মাণ করেন।
১০. সুলতানি আমলে প্রধান মুদ্রা কী ছিল ?
উত্তর। সুলতানি আমলের প্রধান মুদ্রা ছিল সোনার মোহর, রুপোর তঙ্কা ও তামার জিতল।
১১. মুঘল আমলের কয়েকটি মুদ্রার নাম করো।
উত্তর। মুঘল আমলে সোনার মুদ্রা মোহর বা আশরফি, রুপোর মুদ্রা তঙ্কা এবং তামার মুদ্রা জিতল।
১২. ভাস্কো-দা-গামা কত খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন ?
উত্তর। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগালের রাজার দূত ভাস্কো-দা-গামা আফ্রিকার দক্ষিণের উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতের দক্ষিণে মালাবার উপদ্বীপের কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছান।
১৩. সমুদ্রবাণিজ্যে পোর্তুগিজদের প্রাধান্য কে প্রতিষ্ঠিত করেন ?
উত্তর। ভাস্কো-দা-গামার পরবর্তী পোর্তুগিজ নৌ-সেনাপতি ডিউক-অফ আলবুকার্ক।
১৪. বাণিজ্যিক চাষ কাকে বলে ?
উত্তর। বাজারে বিক্রি করে আর্থিক লাভবান হবার জন্য যে চাষ করা হত, তাকে বাণিজ্যিক চাষ বলে। যেমন—আফিম ও রেশমের চাষ ।
২. সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর :
১. এলাহাবাদ দুর্গ, আটক দুর্গ ও রোহটাস দুর্গের অবস্থান ও গুরুত্ব কী রকম ছিল ?
উত্তর। এলাহাবাদ দুর্গ : গঙ্গা-যমুনার সন্ধিস্থলে বানানো এলাহাবাদ দুর্গ থেকে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলের ওপর নজরদারি করা হত।
আটক দুর্গ ও রোহটাস দুর্গ : রাজপুতানার আজমের ও উত্তর-পশ্চিম সিন্ধু নদের পারে তৈরি আটক দুর্গ ও তার কিছু পূর্ব দিকে রোহটাস দুর্গ ছিল অবস্থানগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই কেন্দ্রগুলোর সাহায্যে সিন্ধু যমুনা-গঙ্গা অববাহিকার সুবিশাল, উর্বর, সমতল অঞ্চলের জনগণ, কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য প্রাকৃতিক ধনসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যেত।
২. সুলতানি আমলে কী মুদ্রা ছিল ?
উত্তর। সুলতানি আমলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কেনাবেচার ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রধান মুদ্রা ছিল সোনার মোহর, রুপোর তঙ্কা ও তামার জিতল। ওই আমলের শেষদিকে উত্তর ভারতে আদানপ্রদানের মাধ্যম হিসাবে প্রচলিত হয় এক রকমের রুপো ও তামা মেশানো মুদ্রা। শেরশাহ সোনা, রুপা, তামা এই তিন রকমের মুদ্রা চালু করেন যা পরবর্তী কালে মুঘলরাও অনুসরণ করেছিলেন।
৩. মধ্যযুগে ভারতীয় বণিক সম্প্রদায় সম্পর্কে কী জান?
উত্তর। মধ্যযুগীয় বাণিজ্যিক ইতিহাসে ভারতীয় বণিকগোষ্ঠীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এই সময় ভারতীয় বণিক দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বের সাথে এক প্রাণোজ্জ্বল বাণিজ্যিক লেনদেন গড়ে তুলেছিল। মধ্যযুগীয় সম্রাটদের উৎসাহ দান একে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় বণিকদের মধ্যে গুজরাতি, মালাবারি, তামিল, ওড়িয়া, তেলুগু ও বাঙালি বণিকরা সুনাম অর্জন করেছিল। এই বণিকরা ধর্মে ছিল হিন্দু, মুসলমান ও জৈন। এরা আরব, পারসিক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বণিকদের সাথে বাণিজ্য করত। এরা বিভিন্ন প্রকার খাদ্য শস্য, তৈলবীজ, তুলো, রেশম, সুতি বস্ত্র, নীল, আফিম ও মশলা রপ্তানি করে থাকত দেশ ও বিদেশের বাজারগুলোতে। এই বণিকদের মধ্যে যারা খুব বেশি ধনী ছিল তাদের বলা হত বণিক-সম্রাট। ভারতীয় বণিক সম্প্রদায় পণ্য বোঝাই বড়ো বড়ো জাহাজ নিয়ে বাণিজ্যে যেত।
◾ সংক্ষেপে (৩০-৫০টি শব্দের মধ্যে) উত্তর দাও : (পূর্ণমান—৩)
(ক) কী কী ভাবে মধ্য যুগের ভারতে শহর গড়ে উঠত?
উত্তর। শহর কথাটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। সুলতানি ও মধ্য মুঘল আমলে ভারতে গ্রামের পাশাপাশি অনেক শহর গড়ে উঠেছিল। শহরগুলি প্রধানত ছিল আর্থিক লেনদেন ও ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণেও শহর গড়ে উঠত। যেখানে দুর্গ নির্মাণ এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখভাল সহজ ছিল। সেখানেই মধ্যযুগের শহর গড়ে তোলা হত ৷ এই কারণগুলির কথা মাথায় রেখেই রাজা-রাজরা ও বণিকবৃন্দ এই অঞ্চলগুলির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেখানে। শহর গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতেন। আবার অনেক সময় ধর্মীয় স্থান বা মন্দির, মসজিদকে ঘিরে কোনো কোনো শহর গড়ে উঠত। এ ছাড়া নদী-বাণিজ্যের সুবিধার কথা ভেবেও বিভিন্ন নদী তীরবর্তী অঞ্চলে শহর গড়ে উঠত। যেমন— গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে যমুনার পারে তৈরি হয়েছিল গিয়াসপুর শহরতলি। কায়কোবাদ ত্রয়োদশ শতকে যমুনার তীরে তৈরি করেন কিলোয়ারি প্রাসাদ।
(খ) কেন সুলতানদের সময়কার পুরানো দিল্লির আস্তে আস্তে ক্ষয় হয়েছিল?
উত্তর। কুতুবউদ্দিন আইবকের আমলে দিল্লি তৈরি হয়েছিল রাজপুত শাসকদের শহর কিলা রাই পিথোরাকে কেন্দ্র করে। এটাই ছিল সুলতানি আমলের প্রথম দিল্লি বা পুরানো দিল্লি। মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে কুতুব দিল্লির বা পুরানো দিল্লিকে একটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরার চেষ্টা হয়েছিল। চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দিল্লি শহরের চেহারা বদলে যায়। আগেকার মতো আরাবল্লির পাথুরে এলাকায় শহর তৈরি না করে। ফিরোজ শাহ তুঘলক যে ফিরোজাবাদ শহর গড়ে তোলেন তার মধ্যমণি ছিল ফিরোজশাহ কোটলা । যার অবস্থান ছিল যমুনা নদীর ধার বরাবর। এই পরিকল্পনার ফলে শহরের জলের সমস্যা লাঘব হয়। নদীপথে অল্পখরচে বয়ে আনা জিনিসপত্র শহরের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সহজ হয়। এর ফলে সুলতানদের পুরানো দিল্লি শহর আস্তে আস্তে ক্ষয় পেতে লাগল। ফিরোজাবাদ শহর পত্তনের ফলে এই ক্ষয় পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
(গ) কেন, কোথায় শাহজাহানাবাদ শহরটি গড়ে উঠেছিল ?
উত্তর। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে শাহাজাহান দিল্লিতে শাহাজানাবাদ শহরটি গড়ে তুলেছিলেন। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান আগ্রা থেকে দিল্লি চলে আসেন। শাহাজাহান কর্তৃক শাহাজানাবাদ শহরটি গড়ে তোলার কারণ হল – এই সময়ে যমুনা নদীর পাড় ভেঙে আগ্রা শহর ক্রমশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এমনকি শহরে পথঘাটও ঘিঞ্জি হয়ে পড়ে। যার জন্য প্রয়োজন ছিল নতুন কোনো শহরের পত্তন। এ ছাড়া আগ্রার প্রাসাদদুর্গ মুঘল বাদশাহের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের জন্য আর যথেষ্ট বড়ো ছিল না। তাই তৈরি করা হল শাহজানাবাদ শহরটি।
(ঘ) ইউরোপীয় কোম্পানির কুঠিগুলি কেমন ছিল ?
উত্তর। ইউরোপীয় বাণিজ্যিক কোম্পানি ইংরেজ, ডাচ, ফরাসি দিনেমার বা বাণিজ্যের সুবিধার্থে ভারতে বেশ কিছু বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করেছিল। এগুলি তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র রূপে কাজ করত। যেখান থেকে বাণিজ্যিক লেনদেন পরিচালনা করা হতো। এ ছাড়া কোম্পানির কুঠিতে ইউরোপীয় বণিকরা নিজেদের মতো করে বাড়িঘর করত। কুঠিগুলো তারা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দুর্গের মতো সুরক্ষিত রাখত। এখানে তাদের বাসগৃহ ও মালের গুদাম থাকত। এই গুদামগুলি থেকে তারা জাহাজে করে ইউরোপে মাল পাঠাত।
(ঙ) মুঘল শাসকরা কী ভাবে ব্যাবসা বাণিজ্যে উৎসাহ দিতেন?
উত্তর। ব্যাবসা বাণিজ্যে মুঘল সম্রাটদের উৎসাহ দান ইউরোপীয় বণিকদের ভারত আগমনে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। মুঘল শাসকেরা বাণিজ্য করত বা নিজেদের নানা ভাবে উৎসাহিত করত। আমদানিকৃত মালের শুল্ক ছাড় দিয়ে, বাণিজ্যের অনুমতি দিয়ে তারা বণিকদের সুবিধা করে দিত। এ ছাড়া প্রয়োজনে মুঘল শাসকরা বণিকদের বাণিজ্য ঋণ দেবারও ব্যবস্থা করেছিল। মুঘল অভিজাতদের মধ্যে কেউ সরাসরি কেউ বা নিজে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে এই প্রয়াস ছিল খুবই সীমিত। মুঘল সম্রাট, রাজপুত্ররা ও অভিজাতরা নিজেদের প্রয়োজন ও শখ মেটাতে নিজেদের কারখানায় কারিগরদের দিয়ে নানা ধরনের শৌখিন জিনিস, বস্ত্র, বিলাসদ্রব্য তৈরি করত। যা পরোক্ষভাবে বণিকদের উৎসাহ দান করেছিল। তা ছাড়া বিভিন্ন বন্দর শহর ও অভ্যন্তরস্থ বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে ইউরোপীয় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন ও ইউরোপের বাজারগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন মুঘল যুগের বাণিজ্যধারাকে বেগবান করেছিল।
◾ বিশদে (১০০-১২০টি শব্দের মধ্যে) উত্তর দাও : (পূর্ণমান-৫)
(ক) খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে দিল্লি কেন একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে উঠেছিল ?
উত্তর। ত্রয়োদশ শতক থেকে দিল্লি একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল আরাবল্লি শৈলশিরার একটি প্রান্ত ও যুমনা নদীবিধৌত সমতলের সংযোগস্থলে। এখানে আরাবল্লির পাথর দিয়ে জমির ঢাল অনুযায়ী সুরক্ষিত দুর্গনির্মাণ করা সহজ ছিল। ফলে উত্তর-পশ্চিম দিকের সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে যে মোঙ্গল আক্রমণ -এর সম্ভাবনা ছিল তা থেকে রাজধানীকে মুক্ত করা সম্ভবপর ছিল। আবার দিল্লি শহরের পাশ দিয়েই প্রবাহিত হয়েছিল যমুনা নদী, যা শহরের পূর্ব দিকে একটি প্রাকৃতিক সীমানা রচনা করেছিল। এ ছাড়া যমুনা নদী ছিল প্রধান জলপথ, তার সাথে সমুদ্রবাণিজ্য বৈদেশিক বাণিজ্য বন্দরগুলি যুক্ত ছিল, যা দিল্লিকে অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেছিল। এই প্রাকৃতিক সীমানা ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা মাথায় রেখেই বহু যুগ ধরেই রাজরাজরা ও বণিকবৃন্দ দিল্লি অঞ্চলের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন।
ত্রয়োদশ শতকে মহম্মদ ঘুরির সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লিতে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। আজ পর্যন্ত মধ্য যুগের দিল্লির সাতটি নাগরিক বসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। দিল্লির প্রশাসনিক গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে মধ্যযুগের সুলতানরা দিল্লিকে ঘিরে তাদের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। যেমন—কুতুবউদ্দিন আইবকের আমলে, দিল্লি তৈরি হয়েছিল রাজপুত শাসকদের শহর কিলা রাই পিথোরাকে কেন্দ্র করে। এটাই ছিল সুলতানি আমলের প্রথম দিল্লি বা কুতুব দিল্লি। দিল্লি শহরটি যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় ও এটি একটি রাজধানী শহর হওয়ায় বিদেশি পর্যটক ও বণিকদের কাছে শহরটি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং ত্রয়োদশ শতক থেকেই দিল্লিতে বিভিন্ন পর্যটক ও বণিকদের আগমনও উত্তরোত্তর বাড়তে শুরু করে।
(খ) শাহজাহানাবাদের নাগরিক চরিত্র কেমন ছিল?
উত্তর। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট শাহজাহান দিল্লি শহরে শাহজানাবাদ শহরটি নির্মাণ করেছিলেন। আগ্রা থেকে এখানেই তিনি রাজধানী স্থানান্তর করেন। এখানেই তিনি লাল রঙের বেলেপাথর দিয়ে বিখ্যাত লালকেল্লা নির্মাণ করেন। শাহাজাহানবাদের নাগরিক বসতি ছিল মিশ্র প্রকৃতির। এখানে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বসবাস করত এবং এদের বসত বাড়িগুলি ছিল বিভিন্ন প্রকারের। রাজপুত্র ও উচ্চপদস্থ আমিররা সুন্দর বাগান বাড়িতে থাকত। তাদের বাড়িগুলি ছিল সুন্দরভাবে সজ্জিত। ধনী বণিকরা টালি দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো ইট ও পাথরের অট্টালিকাতে থাকত। সাধারণ ব্যবসায়ীরা থাকত নিজেদের দোকানের উপরে বা পেছন দিকের ঘরে। এদের কোনো পৃথক বাসস্থান ছিল না। মুঘল যুগের সবচেয়ে বড়ো ও সুন্দর বাড়িগুলোকে বলা হত ‘হাভেলি'। এ হাভেলিতে সাধারণত রাজপুত্র, উচ্চপদস্থ আমির ও রাজপরিবারের সদস্যরাই থাকত। এর থেকে নিচুস্তরের বাড়িকে ‘মকান' ও 'কোঠি' বলা হত। যেখানে সাধারণ ব্যবসায়ীরা থাকত। সবচেয়ে ছোটো ঘরকে বলা হত 'কোঠরি' যা ছিল সাধারণ -এর বাসগৃহ। এ ছাড়া ছিল আলাদা বাংলো বাড়ি। বড়ো বড়ো বাড়ির আশেপাশে মাটি ও খড় দিয়ে তৈরি বহু ছোটো ছোটো কুঁড়েঘর ছিল। এই সব কুঁড়েতে সাধারণত সৈনিক, দাসদাসী, কারিগর প্রমুখ মানুষজন থাকত। বসতবাড়ির এই বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও বসতি এলাকার মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। সেযুগে উচ্চপদস্থ আমির ও গরিব কারিগর একই মহল্লায় পাশাপাশি অবস্থান করত। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে মোটামুটিভাবে একটা সম্পর্ক বজায় ছিল। এই মিশ্র প্রকৃতির সুন্দর ভাবে পরিকল্পিত নগর জীবন মধ্যযুগের ইতিহাসে শাহাজানাবাদ শহরটির গুরুত্ব বাড়িয়েছিল।
(গ) দিল্লির সুলতানদের আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার কেন ঘটেছিল ?
উত্তর। সমসাময়িক বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে দিল্লির সুলতানদের আমলে ব্যাবসা-বাণিজ্য যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। সুলতানি আমলে ব্যাবসা-বাণিজ্যের বিস্তারের পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে দিল্লির সুলতানরা কয়েকটি নতুন শহর তৈরি করেন বা পুরোনো শহরগুলিতে নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরি করেন। এই সব শহরে
সুলতানরা ও তাদের অভিজাতরা, সৈনিকরা ও সাধারণ মানুষ বসবাস শুরু করলে শহরগুলো জনবহুল হয়ে ওঠে। শহরগুলিতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও বাড়ি-ঘর তৈরির কাঁচামাল জোগান দেবার জন্য আমদানি-রপ্তানির বাণিজ্য গড়ে ওঠে। আবার সুলতানি আমলে রাষ্ট্র কৃষকদের কাছ থেকে নগদে কর নেবার ফলে কৃষকরা নগদ অর্থ জোগাড় করতে ব্যবসায়ীদের কাছে উৎপন্ন ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হত। সেই শস্য নিয়েও বাণিজ্য চলত। সুলতানি আমলে জল ও স্থলপথে অন্তর্বাণিজ্য সম্পন্ন হত। জনবহুল শহরগুলোর অধিবাসীদের প্রয়োজনে গ্রাম থেকে নানা রকম খাদ্যশস্য, খাবার তেল, কাঁচা তুলো, ঘি, আনাজ, ফল, লবণ ইত্যাদি শহরে যেত। আর এক শহর থেকে অন্য শহরে রপ্তানি হত দামি শৌখিন জিনিসপত্র, যেগুলো ধনী, অভিজাতদের জন্যই তৈরি করত কারিগররা।
সুলতানি আমলে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাথে বহির্বাণিজ্যের সমধিক সম্প্রসারণ ঘটেছিল। গুজরাত ও মালাবারের বন্দরগুলো থেকে পশ্চিম দিকে আরব সাগর, পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের তীরবর্তী দেশগুলিতে প্রধানত বস্ত্ৰ মশলা, নীল ও খাদ্যশস্য যেত। আর ওইসব দেশ থেকে আসত ঘোড়া, কাচের তৈরি সামগ্রি, সাটিন কাপড়, ইত্যাদি।
(ঘ) মধ্যযুগে ভারতে দেশের ভেতরে বাণিজ্যের ধরনগুলি কেমন ছিল তা লেখো।
উত্তর। মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাসে প্রাপ্ত বিভিন্ন নথিপত্র থেকে এযুগে দেশের ভেতর সাধারণত দুধরনের বাণিজ্যের কথা জানা যায়। প্রথমত গ্রাম ও শহরের বাণিজ্য এবং দ্বিতীয়ত দুটি শহরের মধ্যে বাণিজ্য। এই কারণে জনবহুল শহরগুলির অধিবাসীদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য গ্রাম থেকে শহরে কম দামি কিন্তু অনেক বেশি পরিমাণে জিনিস জলপথে নিয়ে আসত। এই সব জিনিসের মধ্যে ছিল নানা প্রকার খাদ্যশস্য, তৈলবীজ, কাঁচাতুলো, ঘি, আনাজ, ফল, লবণ ইত্যাদি। শহরের বাজারে এই সব পণ্য বিক্রি হত। বর্তমানকালের মতো সেই আমলেও গ্রামগুলো নগরবাসীর কৃষি ও হস্তশিল্পজাত সবরকম পণ্যের চাহিদা মেটাতো।
আবার এক শহর থেকে অন্য শহরে রপ্তানি করা হত প্রধানত বিভিন্ন প্রকার শৌখিন জিনিসপত্র, যেগুলো ধনী ও অভিজাতদের জন্যই তৈরি করত কারিগররা। সুলতানদের রাজধানী দিল্লি শহরে সাম্রাজ্যের নানা এলাকা থেকে দামি মদ, সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র আমদানি করা হত। তা ছাড়া বাংলাদেশ, করমণ্ডল ও গুজরাতের সুতি ও রেশমের কাপড়ের চাহিদা ছিল দেশের সর্বত্র। সেযুগে গুজরাট তথা পশ্চিম ভারত খাদ্যশস্য-এর দিকে স্ব-নির্ভর ছিল না। এই জন্য পূর্ব ও উত্তর ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য এই অঞ্চলে আমদানি করা হত।
মধ্যযুগে বিভিন্ন প্রকার হস্তশিল্পের বাণিজ্যও চলত। যেমন—চামড়া, কাঠ ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন জিনিস, গালিচা ইত্যাদি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রপ্তানি হত। বাণিজ্যের সূত্র ধরেই সেই আমলে বহু নগরকেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল, যেমন— সুরাট, বেশগাঁও, সাতগাঁও, সোনারগাঁও, হুগলি প্রভৃতি।
No comments:
Post a Comment