ইতিহাস
প্রশ্ন উত্তর
নবম অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর পড়তে নিচের লিঙ্ক এ ক্লিক করো
👉 ( নবম অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর )
ভূমিকা: আমার মৃত্যুর পরেই আসবে প্লাবন'— ঔরঙ্গজেবের এই খেদোক্তির মধ্যেই তাঁর শাসনের ব্যর্থতা ও মুঘল সাম্রাজ্যের সুনিশ্চিত ধ্বংসের ইঙ্গিত পাওয়া যায় । শাসনকালের শেষ পর্বে এসে ঔরঙ্গজেব তাঁর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ( ১৬৫৮ ১৭০৭ খ্রি . ) রাজত্বকালের বিরাট ব্যর্থতা বুঝতে পেরেছিলেন । প্রকৃতপক্ষে শাসনদক্ষতা ও রণনৈপুণ্য সত্ত্বেও ঔরঙ্গজেবের জীবিতকালেই মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙন শুরু হয়ে যায় । এই ভাঙন রোধ করা সম্ভব হত যদি তাঁর উত্তরাধিকারীদের দক্ষতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি থাকত । কিন্তু তা না থাকায় তা সম্ভবপর হয়নি । তবে মুঘল সাম্রাজ্যের সংকটের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক । ঔরঙ্গজেবের সময়কালে সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পায় । মনসব নিয়ে অভিজাতদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ও মারাঠা আঞ্চলিক শক্তি মুঘলদের সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে । ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহই মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামরিক ভিত দুর্বল করে দিয়েছিল , যা মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করেছিল । মুঘল শাসনের শেষ পর্বে শিবাজীর ( ১৬৩০-৮০ খ্রি . ) নেতৃত্বে মারাঠা শক্তি অসম্ভব শক্তিশালী হয়ে পড়েছিল । এ ছাড়া মারাঠাদের রণনীতির কাছে মুঘল রণনীতি ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের , যা মুঘলদের সাথে যুদ্ধে মারাঠাদের জয় এনে দিয়েছিল ।
এ ছাড়া এই সময় শিখদের সাথে মুঘলদের সম্পর্ক ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে । এর পাশাপাশি জাঠ ও সৎত্নামি প্রভৃতি আঞ্চলিক কৃষক বিদ্রোহগুলি মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল করে দিয়েছিল । জায়গিরদারি ও মনসবদারি ব্যবস্থায় এই সময় সম্পূর্ণ সংকট দেখা যায় । মনসব পাওয়া নিয়ে অভিজাতদের মধ্যে এইসময় বাদানুবাদ তৈরি হওয়া , সৎ রাজপুত নেতার অভাব পরিলক্ষিত হয় । এই সমস্ত কারণই মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে চরম ভাবে দুর্বল করে । তাই ঔরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করলে হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্রোহ করে , যা মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ডেকে আনে । এই সমস্ত কারণগুলি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে , ফলে ঔরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারীদের এমন কোনো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও দক্ষতা ছিল না , যা এই সমস্ত সংকটগুলির মোচন ঘটিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যকে পূর্ববর্তী স্রোতে ফিরিয়ে আনতে পারে ।
বাংলা "পাগলা গণেশ" প্রশ্ন উত্তর পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করো
◾দু - এক কথায় উত্তর দাও :
১। মারাঠারা কোন্ অঞ্চলে বাস করত ?
উত্তর । পুনে ও কোঙ্কন অঞ্চলে ।
২। শিবাজীর পিতা কে ছিলেন এবং তিনি কোথাকার জায়গিরদার ছিলেন ?
উত্তর । শিবাজীর পিতা শাহজি ভোঁসলে বিজাপুরের সুলতানের জায়গিরদার ছিলেন ।
৩। শিবাজীর মাতার নাম কী ছিল ?
উত্তর । শিবাজীর মাতা ছিল জিজাবাঈ ।
৪। মাবলে বা মাওয়ালি কারা ?
উত্তর । শিবাজী পুনে আক্রমণ কালে মাওয়াল তাঞ্চল থেকে যে একদল সেনা নিয়োগ করেন , তাদের মাবলে বা মাওয়ালি ।
৫। পেশোয়ার প্রথম বাজীরাও - এর হিন্দু রাজ্য গড়ে তোলার পরিকল্পনাকে কী বলে ?
উত্তর । হিন্দু পাদ পাদশাহি ।
৬। শিখদের মোট কতজন গুরু ছিল ?
উত্তর । দশজন ।
৭। কত খ্রিস্টাব্দে কে খালসা সংগঠন গড়ে তোলেন ?
উত্তর । ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে গুরু গোবিন্দ সিংহ খালসা নামক সংগঠন গড়ে তোলেন ।
৮। গুরু গোবিন্দ সিংহ কোন্ পাঁচটি জিনিস শিষ্যদের সব সময় রাখতে বলেছিলেন ?
উত্তর । এগুলি হল — কেশ , কঙ্ঘা ( চিরুনি ) , কচ্ছা , কৃপাণ এবং কড়া ।
৯। গোবিন্দ সিংহের শিষ্যের নাম কী ছিল ?
উত্তর । বান্দা বাহাদুর ।
১০। কোন্ মুঘল সম্রাটের আমলে জাঠরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ?
উত্তর । মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে ।
◾সংক্ষেপে ( ৩০-৫০টি শব্দের মধ্যে ) উত্তর দাও ( পূর্ণমান -৩ ) :
( ক ) ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে কী কী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল ?
উত্তর । ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে পূর্ববর্তী মুঘল সম্রাটদের তুলনায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল যা , সাম্রাজ্যের পক্ষে একেবারে সুখকর হয়নি । ঔরঙ্গজেবের আমলে রাজকর্মচারীরা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কৃষকদের নানাভাবে অত্যাচার করত । এ ছাড়া এই সময়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে অভিজাতরা এই পরিস্থিতিতে জমি থেকে তাদের আয় বাড়াতে চাইলে , জমিদার ও কৃষকদের ওপর চাপ বাড়ে । ফলে কৃষকরা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয় । ঔরঙ্গজেবের সময় জায়গিরদারি ও মনসবদারি সমস্যা বৃদ্ধি পায় । ঔরঙ্গজের রাজস্ব আয় বাড়াতে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা জয়ের পর ওই অঞ্চলে ভালো জমিগুলিকে খালিসা জমিতে পরিণত করেছিলেন । এ ছাড়া তাঁর আমলে জিজিয়া কর আবার পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছিল । রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা বড়ো পরিবর্তন হল — এতকাল মুঘল সম্রাটরা রাজপুতদের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রেখেছিল ঔরঙ্গজেবের আমলে তা ছিন্ন হয়ে যায় এবং তিনি রাজপুতদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন । তাঁর দাক্ষিণাত্য নীতি ছিল রাজনৈতিক চরম অজ্ঞতা । রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি মারাঠা দমনের নীতি নিয়েছিলেন ।
( খ ) কবে , কাদের মধ্যে পুরন্দরের সন্ধি হয়েছিল ? এই সন্ধির ফলাফল কী হয়েছিল ?
উত্তর । ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে জুন শিবাজীর সাথে মুঘলদের পুরন্দরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । পুরন্দরের সন্ধির ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারি । সন্ধির শর্তানুসারে— ( ১ ) শিবাজী ২৩ টি দুর্গ মুঘলদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন । ( ২ ) শিবাজীর পুত্র শম্ভুজীকে পাঁচ হাজারী মনসবদার পদে নিযুক্ত করা হয় । ( ৩ ) শিবাজীকে জায়গির দান করা হয় । জয়সিংহের অনুরোধে শিবাজী মুঘল দরবারে এলে সম্রাট শিবাজীকে অপমান করেন এবং আগ্রা দুর্গে বন্দি করে রাখেন । ( ৪ ) মুঘল সার্বভৌমত্ব মেনে নেন শিবাজী ।
( গ ) জাঠদের সঙ্গে মুঘলদের সংঘাত কেন বেধেছিল ?
উত্তর । দিল্লি ও আগ্রা অঞ্চলে বসবাসকারী জাঠরা ছিল মূলত কৃষিজীবী । রাজস্ব দেওয়া নিয়ে জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের আমলে তাদের সঙ্গে মুঘলদের সংঘাত বাধে । কঠোর করভার ও ঔরঙ্গজেবের নীতির প্রতিবাদে ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় জমিদার গোকলার নেতৃত্বে জাঠরা বিদ্রোহ করে । অন্যদিকে জাঠরা একটি পৃথক রাজ্য গঠন করতে চেয়েছিল বলে জানা যায় । তাই বলা যায় যে , মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল এক দিকে কৃষক বিদ্রোহ , অন্যদিকে একটি আলাদা গোষ্ঠীরূপে পরিচিত হবার জন্য সংগ্রাম ।
( ঘ ) শিবাজীর সঙ্গে মুঘলদের দ্বন্দ্বের কারণ কী ছিল ? শিবাজীর শাসন ব্যবস্থা কেমন ছিল বলে তোমার মনে হয় ?
উত্তর । ঔরঙ্গজেবের সময়কালে শিবাজীর সাথে মুঘলদের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল । শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতির উত্তরোত্তর ক্ষমতা বৃদ্ধি মুঘলদের কাছে ছিল চক্ষুশূল । দাক্ষিণাত্যে শাসনকর্তা নিযুক্ত থাকাকালীনই ঔরঙ্গজের শিবাজীকে দমন করার চেষ্টা করেছিলেন । কেননা বিজাপুরের সুলতানের অসুস্থতার সুযোগে শিবাজী বিজাপুরের বেশ কিছু জমিদারকে নিজের দখলে নিয়ে আসেন ।
( ঙ ) বিজাপুর ও গোলকোণ্ডা জয়ের ফলে মুঘলদের কী সুবিধা হয়েছিল ?
উত্তর । ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর ও গোলকোণ্ডা রাজ্যদুটি আক্রমণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে ক্রমাগত যুদ্ধ - বিগ্রহের কারণে অর্থনীতি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে তার থেকে পরিত্রাণে বিজাপুর ও গোলকোণ্ডার মতো দুটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল দখল করা আবশ্যিক হয়ে পড়ে । তাই বিজাপুর ও গোলকোন্ডা জয়ের মধ্যে দিয়ে দাক্ষিণাত্যের বিশাল অঞ্চল মুঘলদের হাতে আসে । এই অঞ্চলের সব থেকে ভালো জমিগুলি ঔরঙ্গজেব খাস জমি বা খালিসা হিসাবে রেখে মুঘল অর্থনীতিকে সুগঠিত করেন । এ ছাড়া এই অঞ্চল থেকে তৎকালীন পরাক্রমশীল মারাঠা শক্তিকে আক্রমণ করা মুঘলদের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল ।
◾বিশদে ( ১০০-১২০টি শব্দের মধ্যে ) উত্তর দাও ( পূর্ণমান -৫ ) :
( ক ) মুঘলদের বিরুদ্ধে শিখরা কীভাবে নিজেদের সংগঠিত করেছিল ?
উত্তর । শিখদের সঙ্গে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির এবং শাহজাহানের আমলে মুঘলদের সংঘাত দেখা দিয়েছিল । এই সংঘাতের চরিত্র ছিল রাজনৈতিক । মুঘলদের ধর্মীয় নীতি শিখদের সংগঠিত করার কাজে সাহায্য করেছিল । ষোড়শ শতকের শেষের দিকে চতুর্থ গুরু রামদাসের ছেলে অর্জুনদের গুরু হন । এই সময় থেকেই শুরু হয় বংশানুক্রমিক গুরু নির্বাচন । ফলে মুঘল রাষ্ট্রে শিখরা এক স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে উত্থান ঘটায় । মুঘলদের ধর্মীয় নীতি শিখদের এই ক্ষমতায় আঘাত হানে । ফলে তারা দশম শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয় । ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে গুরু গোবিন্দ সিংহ খালসা নামক একটি সংগঠন তৈরি করেন । যেখানে শিখদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া ছিল দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ । গুরু গোবিন্দ সিংহ শিখদের ‘ পন্থা ’ বা পথ ঠিক করে দেন । যা শিখদের মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে সাহায্য করেছিল । এ ছাড়া খালসাপন্থী শিখরা সিংহ পদবি ব্যবহার করতে শুরু করে । যা তাদের ভ্রাতৃত্ববোধের সংগঠনকে জাগরিত করে ।
( খ ) মুঘল যুগের শেষ দিকে কৃষি সংকট কেন বেড়ে গিয়েছিল ? এই কৃষি সংকটের ফল কী হয়েছিল ?
উত্তর । শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে গৃহযুদ্ধ এবং মারাঠা ও রাজপুতদের সাথে অবিরাম যুদ্ধে রাজকোশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । এই পরিস্থিতিতে মুঘল সম্রাটরা ভূমি রাজস্বের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে কৃষকরা অসন্তুষ্ট হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে , যা কৃষি ক্ষেত্রে সংকট ঘনিয়ে আনে । এই সংকট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে । উপরন্তু খালিসা জমি ইজারা দেওয়ার ফলে কৃষকের ওপর অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের চরম নির্যাতন শুরু হয় । কখনো কখনো অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষক চাষ ছেড়ে পলায়ন করে , যা কৃষিক্ষেত্রে সংকট নিয়ে আসে । কৃষিক্ষেত্রে এই সংকটের ফলে কৃষকগণ রাষ্ট্রের অতিরিক্ত রাজস্বের বোঝা সামলাতে না পেরে বিদ্রোহ শুরু করে । এমনকি মুঘল সম্রাটদের আদায়কৃত রাজস্বের হার কমে যাওয়ায় যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয় , তা মেটাতে মুঘল শাসকরা সঞ্চিত ধনসম্পদের ব্যবহার শুরু করে দেয় । ফলে রাজকোশ শূন্য হতে থাকে । এমনকি এই কৃষিসংকটের ফলে ইজারাদার ও জায়গিরদাররা তাদের জমি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করতে না পারার ফলে তাদের ঘোড়সাওয়ার ভরনপোষণের পরিমাণ কমিয়ে দেয় , যা মুঘল সামরিক শক্তির অবনতি সূচিত করে । ফলে মুঘল শাসন ব্যবস্থা পতনের পথে পা বাড়ায় ।
( গ ) মুঘল যুগের শেষ দিকে জায়গিরদারি ও মনসবদারি ব্যবস্থায় কেন সংকট তৈরি হয়েছিল ? মুঘল সাম্রাজ্যের উপর এই সংকটের প্রভাব কী পড়েছিল ?
উত্তর । সপ্তদশ শতক থেকে মুঘল যুগের জায়গিরদারি ও মনসবদারি সংকট একটা বিশেষ আকার নিতে শুরু করে । কেননা এই সময়কালে মনসবের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও জায়গির জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি । অর্থ সংকট আরও বৃদ্ধি পায় ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষের দিকে । তিনি এই সময় দাক্ষিণাত্যের রাজপুতদের যথেষ্টভাবে মনসব প্রদান করেন । ফলে এদের বেতন দিতে জায়গির অবশিষ্ট রইল না । এখানেই মুঘল কেন্দ্রীয় শক্তির আধার জায়গিরদারি ব্যবস্থার সংকট ঘনিভূত হয় । অন্যদিকে এই সময় নানা রকম গৃহযুদ্ধের কারণে রাজকোশ একেবারে ফাঁকা হয়ে পড়ায় মনসবদারদের প্রাপ্য বেতন দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে , যা মনসবদারি ব্যবস্থাকে গুরুতর সংকটের সামনে নিয়ে আসে । এই মনসবদারি ও জায়গিরদারি সংকটের মধ্যেই মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সূচনা শুরু হয় । মনসবদাররা নির্দিষ্ট পরিমাণ । বেতন না পাওয়া ও জায়গিরদার জায়গির না পাওয়ার ফলে মুঘল খালিসা জমির দিকে হাত বাড়ায় ; যা প্রতিরোধেই মুঘল সম্রাটরা অপরাগ ছিল । এমনকি মনসবদার ও জায়গিরদাররা রাজস্ব আদায়ে কৃষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে ছিল , তার ফলে বহু কৃষক ভূমি ছেড়ে পালিয়ে যায় ফলে অনেক জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে । যা কৃষিক্ষেত্রে সংকটের পাশাপাশি মুঘল অর্থনীতিতে চরম আঘাত হেনেছিল । এমনকি সপ্তদশ - অষ্টাদশ শতকে বারে বারে কৃষক বিদ্রোহ মুঘল শাসকদের বিচলিত করে তুলেছিল । যা দমন করতে গিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজকোশ ও সামরিক শক্তি দুটি ক্ষেত্রেই ঘাটতি তৈরি হয় । এর ফলেই মুঘল শাসন দুর্বল প্রতিপন্ন হয়ে পড়ে ।
( ঘ ) সম্রাট ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্যের সামগ্রিক অবস্থা বিষয়ে তোমার মতামত কী ?
উত্তর । সম্রাট ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্য অর্থনৈতিক , ধর্মীয় , রাজনৈতিক , সামরিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক সংকটময় অবস্থার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয় । ঔরঙ্গজেব উত্তর ভারতের আফগান দলপতিদের সন্তুষ্ট করতে যে বিপুল পরিমাণ ভাতা ও জায়গির প্রদান করেন তা রাজকোশে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে । অপরদিকে তাঁর আমল ছিল বিদ্রোহের যুগ ; এই সময়কালে জাঠ , সৎনামি , শিখ প্রভৃতি বিদ্রোহ দেখা যায় । ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির কারণে তাঁর সাথে শিখ সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ বেঁধেছিল । তা ছাড়া তাঁর আমলে কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ায় জায়গিরদার ও ইজারাদাররা কৃষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালালে তাঁরা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয় । এমনকি দাক্ষিণাত্যের গোলকোণ্ডা ও বিজাপুরের প্রতি ঔরঙ্গজেবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফল ভালো হয়নি । ঔরঙ্গজেবের সময়ে জায়গিরদারি ব্যবস্থা ও মনসবদারি ব্যবস্থায় সংকটের কারণে মনসবদারও স্বল্প বেতনে সৈন্যবাহিনী ভরণপোষণে কারচুপি শুরু করে । যা মুঘল সামরিক শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল । ঔরঙ্গজেবের আমলে শাসনক্ষেত্রে এই সব দুর্বলতাগুলি ভারত ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের মর্যাদা অনেকখানি ক্ষুন্ন করেছিল ।
No comments:
Post a Comment