সপ্তম অধ্যায়
প্রশ্ন উত্তর
অধ্যায় -৮ প্রশ্ন উত্তর পড়তে ক্লিক করো
👉( অষ্টম অধ্যায়)
❐ অতি - সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর :
১. গান্ধিজির পুরো নাম কী ?
উঃ । গান্ধিজির পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ।
২. জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডটি কত খ্রিস্টাব্দে ঘটেছিল ?
উঃ । ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ।
৩. করে দুটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছিল ?
উঃ । বিংশ শতকের প্রথমভাগে দুটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছিল ।
৪. ভারতবর্ষে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার আগে গান্ধিজি কোথায় কোন আন্দোলন চালিয়েছিলেন ?
উঃ । ভারতবর্ষে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার আগে গান্ধিজি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য বিরোধী একটি আন্দোলন চালিয়েছিলেন ।
৫. গুজরাটের কোথায় গান্ধিপন্থী আন্দোলন শুরু হয় ?
উঃ । গুজরাটের খেড়া জেলায় গান্ধিপন্থী সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় ।
৬. কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে গান্ধি সর্বভারতীয় স্তরে আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন ?
উঃ । রাওলাট আইন চালু করাকে কেন্দ্র করে গান্ধি সর্বভারতীয় স্তরে আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন ।
৭. কংগ্রেসের মধ্যে কোন নতুন গোষ্ঠী তৈরি হয়ে হয়েছিল ?
উঃ । কংগ্রেসের মধ্যে স্বরাজ্যপন্থী নামে একটি নতুন গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল ।
৮. কত খ্রিস্টাব্দে কার নেতৃত্বে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ অর্জনের কথা ঘোষণা করেন ?
উঃ । ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস পুর্ণ স্বরাজ অর্জনের কথা ঘোষণা করেন ।
৯. কত খ্রিস্টাব্দে কাদের মধ্যে দিল্লি চুক্তি হয়েছিল ?
উঃ । ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে গান্ধি ও লর্ড আরউইনের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তাকে দিল্লি চুক্তি বলা হয় ।
১০. ইসলাম জগতের খলিফা কে ছিলেন ?
উঃ । তুরস্কের সুলতান ইসলাম জগতের খলিফা ছিলেন ।
২১. কার নেতৃত্বে সিলেট , মৈমনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ?
উঃ । মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে ।
১২. কারা কবে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন ?
উঃ । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিনয় বসু , বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন ।
১৩. চন্দ্রশেখর আজাদ কোথায় কোন পার্টি গড়ে তোলেন ?
উঃ । চন্দ্রশেখর আজাদ পাঞ্জাবে ‘ হিন্দুস্থান রিপাবলিকান পার্টি ’ গড়ে তোলেন ।
১৪. ভগৎ সিং নিজে কোন্ সংগঠন গড়ে তোলেন ?
উঃ । নওজোয়ান ভারত সভা সংগঠন ।
১৫. কোন কথাটিকে ভগৎ সিং ও তাঁর অনুগামীর জনপ্রিয় করেন ?
উঃ । ‘ ইনকিলাব জিন্দাবাদ ’ বা ‘ বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক ' এই কথাটিকে ভগৎ সিং ও তাঁর অনুগামীরা জনপ্রিয় করেন ।
১৬. কার নেতৃত্বে ও কোথায় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত হয় ?
উঃ । সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে মেদিনীপুরের তমলুক মহকুমায় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠিত হয় ।
১৭. কে ভারতকে ‘ যুদ্ধরত দেশ ’ বলে ঘোষণা করেন ?
উঃ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো ভারতকে ‘ যুদ্ধরত দেশ ' বলে ঘোষণা করেন ।
১৮. ‘ ফরওয়ার্ড ব্লক ’ কে তৈরি করেছিলেন ।
উঃ । সুভাষচন্দ্র বসু ত্রিপুরি কংগ্রেসের সভাপতির পদ পদত্যাগ করে ‘ ফরওয়ার্ড ব্লক ' নামে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেন ।
১৯. ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি কোথা থেকে ভারতে ফেরেন ?
উঃ । দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফেরেন ।
২০. কত সালে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ঘটে ?
উঃ । ১৯২১ সালে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ঘটে ।
২১. কে কবে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন ?
উঃ । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে রাসবিহারী বসু জাপানে যুদ্ধবন্দি ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন ।
২২. বেনিতো মুসোলিনি কে ছিলেন ? তাঁর কোন প্রকল্পগুলি সুভাষকে উৎসাহিত করে ?
উঃ । বেনিতো মুসোলিনি ছিলেন ইতালির রাষ্ট্রপ্রধান । তাঁর দুর্নীতি দূরীকরণ ও সামাজিক প্রকল্পগুলি সুভাষকে উৎসাহিত করে ।
২৩. সাইমন কমিশনকে ফিরে যাওয়ার -
উ: । দেশজোড়া বিভিন্ন হরতালে পতাকা দেখিয়ে আওয়াজ তোলা হয়েছিল ' সাইমন ফিরে যাও ।
২৪. কত খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় ?
উঃ । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় ।
২৫. ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কোন মামলা শুরু হয় ?
উঃ । লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ।
২৬. ভগৎ সিং কেন স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন ? জন্য কমিশনকে জনগণ কী করেছিল ? কালো।
উ । লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভগৎ সিং স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন ।
২৭. চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কত খ্রিস্টাব্দে কার নেতৃত্বে হয় ?
উঃ । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয় ।
২৮. ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কে কে কেন্দ্রীয় আইনসভা কক্ষে বোমা ফেলেন ?
উঃ । ভগৎ সিং ও বঁটুকেশ্বর দত্ত কেন্দ্রীয় আইনসভা কক্ষে বোমা ফেলেন ।
২৯. কে , ' করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে ' ডাক দিয়েছিলেন ?
উঃ । ' করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে ' ডাক দিয়েছিলেন গান্ধিজি ।
৩০. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোন্ কোন্ দেশ দুটি দলে ছিল ?
উঃ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একদিকে ছিল জার্মানি , ইতালি ও জাপান । আর অন্যদিকে ছিল ইংল্যান্ড , ফ্রান্স ও সোভিয়েত রাশিয়া ।
৩১. কত খ্রিস্টাব্দে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু হয় ?
উঃ । ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু হয় ।
৩২. কবে রাওলাট আইন সংঘটিত হয় ?
উঃ । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে রাওলাট আইন সংঘটিত হয় ।
৩৩. দিল্লির লালকেল্লায় কাদের ' দেশদ্রোহী ' বলে অভিযুক্ত করা হয় ?
উঃ । পি . কে . সেহগাল , জি . এস . ধিলো , শাহনওয়াজ খানকে দিল্লির লালকেল্লায় ‘ দেশদ্রোহী ' বলে অভিযুক্ত করা হয় ।
৩৪. কত খ্রিস্টাব্দে নৌ - বিদ্রোহ ঘটে ? কারা এই বিদ্রোহ শুরু করেন ?
উঃ । ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নৌ - বিদ্রোহ ঘটে । তলোয়ার জাহাজের সেনারা এই বিদ্রোহ শুরু করেন ।
৩৫. কে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের জন্য কোন উপাধি ত্যাগ করেন ?
উঃ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের জন্য ' স্যার ' উপাধি ত্যাগ করেন ।
৩৬. চৌরিচৌরা গ্রাম কোন জেলায় অবস্থিত ?
উঃ । উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলায় চৌরিচৌরা গ্রাম অবস্থিত ।
৩৭. স্বরাজ্য দল কে কে গঠন করেন ?
উঃ । স্বরাজ্য দল গঠন করেন চিত্তরঞ্জন দাশ ও মোতিলাল নেহেরু ।
৩৮. খান - আবুদল - গফফর খানের বাহিনীর নাম কী ছিল ?
উঃ । খুদাই - খিদমদগার ।
❐ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর:
১. ভারতের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব আলোচনা করো ।
উঃ । এশিয়া ও ইউরোপের ছোটো বড়ো নানা দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে । ভারত ও এর ব্যতিক্রম ছিল না । ঔপনিবেশিক হওয়ার ফলে ভারতের অর্থনীতিও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি মেনে নিয়ে নরমপন্থীরা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল । বহু ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ হারান । ভারতের সামরিক খাতে ব্যয় প্রবলভাবে বেড়ে গিয়েছিল । যার ফলে জিনিসপত্রের দাম হু - হু করে বাড়তে থাকে । সেই সময় খাদ্যশস্য উৎপাদনও কমে যায় । ১৯১৮-১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের বুকে নেমে আসে হাহাকার , দুর্ভিক্ষ । অকাল দুর্ভিক্ষ ও সংক্রামক ব্যাধির কারণে বলি হয় কয়েক লক্ষ মানুষ । ক্রমে ভারতে শ্রমিকরা সংগঠিত হতে শুরু করে । ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয়দের মোহভঙ্গ হয় ।
২. মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার কী ছিল ?
উঃ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয়দের দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতি ব্রিটিশ সরকার বাস্তবায়িত করেনি । এই অবস্থায় ভারতে স্বশাসন বা Home Rule Movement জোরদার হয়ে ওঠে । এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত - সচিব মন্টেগু এবং লর্ড চেমসফোর্ড ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন পাশ করেন । এই আইনে বিভিন্ন ক্ষমতা ও দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় । যদিও এই সংস্কারগুলি ভারতীয়দের পছন্দ হয়নি । কারণ ভারতীয়দের স্বশাসনের সাবিকে মন্টেগু - চেমসফোর্ড সংস্কারে মানা হয়নি ।
৩. গান্ধিজির স্বরাজ ভাবনা কীরূপ ছিল ?
উঃ । ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ হিন্দ স্বরাজ ’ নামের রচনায় গান্ধিজি তাঁর স্বরাজ বিষয়ে সামাজিক দাবিগুলিকে ও আদর্শগুলিকে স্পষ্ট করে বিশ্লেষণ করেছেন । তাঁর বক্তব্য ছিল শুধু ঔপনিবেশিক শাসন বা ব্রিটিশরা নয় সমগ্র পাশ্চাত্য আদর্শভিত্তিক আধুনিক শিল্প সমাজই ভারতের সাধারণ মানুষের শত্রু । স্বরাজ হলো রাজনৈতিক ভাবে অর্ধেক স্বাধীনতার দাবি । শুধু ব্রিটিশ শক্তিকে তাড়ালেই হবে না , তাদের চিন্তা ভাবনা , আদর্শ সবকিছুকে পুরোপুরি ত্যাগ করতে হবে । সবাইকে চাষিদের মতো সহজ - সরল জীবন যাপন করতে হবে । খাদির পোশাক , চ্যাকা কাটা সুতোর তৈরি জিনিস ব্যবহার করতে হবে । নির্ভ সভাযাদি বিরোধিতা দেখা যায় ছিল স্বরাজের আলোচনার মাধ্যমে ।
৪. রবীন্দ্রনাথ - এর বক্তব্য আলোচনা করো ।
উ: রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ স্বরাজসাধন ' প্রবন্ধের একস্থানে বলেছেন- স্বরাজ জিনিসটা কী ? এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশে নেতার স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি । স্বাধীনতা শব্দের অর্থ বিশাল সুবিস্তৃত । চলাকায় সুতো কাটার স্বাধীনতা আমাদের আছে , কিন্তু ঝটি না কারণ বলের সুতার সাথে সাধারণ চরকার সুতো মেলে না । বহু কোটি লোক বিনামূল্যে চরকায় সুতো কেটে সরকারের সুতোর মূল্য কমিয়ে দেবে এটা হতে পারে না । এদেশের সব লোক মিলে চরকা কাটলে অর্থকষ্ট কিছুটা দূর হতে পারে কিন্তু স্বরাজ আসবে না । ব্যক্তিগতভাবে মহাত্মাকে সবাই শ্রদ্ধা করেন । এইজন্য তাঁর আদেশে পালন করাকেই অনেকে ফললাভ বলে গণ্য করে , কিন্তু তা স্বরাজ লাভের অনুকূল নয় ।
৫. গান্ধিজি ও তাকে নিয়ে গুঞ্জবগুলি আলোচনা করো ।
উঃ গান্ধিজির নেতৃত্বে আন্দোলনগুলির পিছনে গুজব ও জনশ্রুতি একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল । অনেকে বিশ্বাস করতেন গান্ধিজি একজন ক্ষমতাবান সাধুর মতো । কৃষকেরা যেমন বিশ্বাস করতেন গান্ধি জমিদারি শোষণকে আটকাবেন । আবার আসামের চা বাগানের কুলিরা তাদের বাগিচা ছেড়ে চলে এসে দাবি করেন যে তারা গান্ধির আদেশ মতো কাজ করছেন । কোথাও গান্ধিকে দেবতা মনে করা হতো । বাংলায় ও উপজাতি সমাজের মানুষেরা মনে করতেন গান্ধির নাম নিলে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিও কোনো ক্ষতি করতে পারবে না ।
৬. রাওলাট সত্যাগ্রহ ও জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাটির বিবরণ দাও ।
উঃ । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এ . টি . রাওলাটের নেতৃত্বে একটি কমিটি দুটি বিল আনেন । তাতে বিপ্লবী আন্দোলন আটকাতে ব্রিটিশ সরকারের হাতে আরো বেশি ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল । ওই বিল দুটির বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধি সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন । পাঞ্জাব প্রদেশে রাওলাট সত্যাগ্রহের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার চূড়ান্ত দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ই এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে অনেক মানুষ নিরন্ত্র প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন । কিন্তু কমান্ডার মাইকেল ও ডায়ার ওই নিরস্ত্র মানুষগুলির উপর চূড়ান্ত সন্ত্রাস চালান । জালিয়ানওয়ালাবাগের বের হবার একটি মাত্র পথকে আটকে রেখে প্রতিবাদী মানুষের উপর একটানা গুলি চালিয়ে যাওয়া হয় । অসংখ্য মানুষ হতাহত হয় । ভারতবাসী এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সার ’ উপাধি
৭. খিলাফত আন্দোলন সম্পর্কে যা জানো লেখো ।
উঃ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্রেট ব্রিটেন তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে , ভারতীয় মুসলমানগণ তীব্র প্রতিবাদ করেন । কারণ তুরস্কের সুলতান ছিলেন ইসলাম জগতের ধর্মগুরু খলিফা । ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের সুলতানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় । তাঁর মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতীয় মুসলমানগণ খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করেন । ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে খিলাফত কমিটি গড়ে ওঠে । ওই কমিটির অন্যতম নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধি ।
৮. চৌরিচৌরার ঘটনাটির বর্ণনা দাও ।
উঃ । অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সর্বত্র অহিংস ছিল না । হিংসার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরের চৌরিচৌরা গ্রামে । ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি ওই গ্রামের স্থানীয় মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হন । ক্রমে পুলিশ ও জনতায় সংঘর্ষ বাধে । জনতার তাড়ায় পুলিশেরা থানায় ঢুকে পড়লে থানার দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে আগুন লাগানো হয় । এই ঘটনায় গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলন তুলে নেন । তাঁর মনে হয়েছিল যে দেশবাসী অহিংস আন্দোলনের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি । তবে জাতীয় কংগ্রেসের অনেক নেতাই গান্ধিজির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন ।
৯. স্বরাজ্য দল সম্পর্কে যা জানো লেখো ।
উঃ । কংগ্রেসের মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাশ ও মোতিলাল নেহেরু প্রমুখ নেতারা গান্ধিনীতি থেকে সরে আসার জন্য আহ্বান জানান । তাঁদের মতে সরকারি আইন পরিষদকে বয়কট না করে তাতে অংশগ্রহণ করে সরকারী নীতি ও কাজে বাধা দেওয়া যাবে । অন্যদিকে গান্ধি প্রথা পুরোনো পথেই চলতে উৎসাহী ছিলেন । ফলে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে চিত্তরঞ্জন দাশ ও মোতিলাল নেহেরু মিলে কংগ্রেস - খিলাফৎ স্বরাজ্য দল তৈরি করেন । তাঁরা কংগ্রেসের মধ্যেই একটি গোষ্ঠী হিসাবে কাজ করতে থাকেন । ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে চিত্তরঞ্জন দাশ মারা যাওয়ার পর গোষ্ঠীগুলি এক হয়ে যায় ।
১০. ভারতের উত্তর - পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলে আইন অমান্য আন্দোলন - এর বিবরণ দাও ।
উঃ । খান আবদুল গফফর খানের নেতৃত্বে ভারতের উত্তর - পশ্চিম প্রান্তে পাঠানরা আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন । তাঁরা ছিলেন অহিংস গান্ধিবাদী সংগ্রামী , তাঁদের সংগঠনটির নাম খুদাই - বিদমদগার । লাল রং - এর কুর্তা পরতেন বলে তাঁদের লালকুর্তা বাহিনীও বলা হতো । আবদুল গফফর খান ‘ সীমান্ত গান্ধি ' নামে পরিচিত । ছিলেন । মনিপুরি ও নাগাদের মধ্যেও আইন অমান্য আন্দোলন সাড়া ফেলেছিল । ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নাগা অঞ্চলের তরুণী রানি গিদালো বিদ্রোহে যোগ দেন ও গ্রেফতার হন । ১৯৩০ এর দশকে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে সিলেট , মৈমনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ।
১১. গান্ধি - আরউইন চুক্তি কী ছিল ?
উঃ । গান্ধি ও লর্ড আরউইনের মধ্যে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা ‘ গান্ধি আরউইন চুক্তি ’ বা ‘ দিল্লি চুক্তি ’ নামে পরিচিত । এই চুক্তিতে বলা হয় —– ( ১ ) অহিংস সত্যাগ্রহী বন্দিদের ব্রিটিশ সরকার ছেড়ে দেবে । ( ২ ) ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা চলবে না । ( ৩ ) দমনমূলক আইনগুলি ব্রিটিশ সরকার তুলে নেবে । এ সবের পরিবর্তে কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলন তুলে নেবে । পাশাপাশি লন্ডনে দ্বিতীয় বৈঠকে গান্ধিজি যোগ দেবেন । কিন্তু দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় গান্ধিজি হতাশ হয়ে , আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন ।
১২. মাস্টারদা সূর্য সেন সম্বন্ধে কী জানা যায় ?
উঃ । মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবীরা এক গণআন্দোলনে যোগ দেন । ঠিক হয় যে একইসঙ্গে চট্টগ্রাম , ময়মনসিংহ ও বরিশালে আক্রমণ করা হবে । এই পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করা ।
১৩. জালালাবাদের যুদ্ধ সম্পর্কে যা জানো লেখো ।
উঃ । চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপ্লবীরা ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন । এখানে ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে বিপ্লবীদের লড়াই শুরু হয় , এই লড়াইয়ে ১১ জন বিপ্লবী মারা যান । এরপর বিপ্লবীরা গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করে । সূর্য সেনের সঙ্গে গণেশ ঘোষ , অনন্ত সিং , লোকনাথ বল , নির্মল সেন , হিমাংশু সেন , বিনোদ দত্ত প্রমুখরা ছিলেন । সূর্য সেন ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার এক বছর বাদে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয় ।
১৪. বিনয় - বাদল - দীনেশ ও অলিন্দ অভিযান - এর ঘটনাটি লেখো ।
উঃ । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করতে যান বিনয় বসু , বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত । এছাড়া এই অভিযানে সাহায্য করেছিলেন রসময় শুর ও নিকুম্ভ সেন । বিনয় , বাদল ও দীনেশ রাইটার্স বিল্ডিং - এর অলিন্দে ঢুকে কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসন সহ আরও দুজনকে হত্যা করেন । পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবীদের দীর্ঘক্ষণ ধরে গুলির লড়াই চলে । ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার আগে বাদল বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন । ক - দিন পর আহত বিনয়ের মৃত্যু হয় । দীনেশ সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয় ।
১৫. সাইমন কমিশন কী ? কেন ভারতীয়রা এর বিরোধ করে ?
উঃ । ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক সরকার ভারতীয়দের সাংবিধানিক অধিকার খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিশন তৈরি করে । স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে ওই কমিশন ভারতে আসে । এই কমিশনে কোনো ভারতীয় সদস্য না থাকায় ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠনগুলি সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করে । পাশাপাশি নানা স্তরে গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে । দেশের বিভিন্ন হবতালে কমিশনকে কালো পতাকা দেখিয়ে ' সাইমন ফিরে যাও ’ আওয়াজ তোলা হয় ।
১৬. ‘ ডান্ডি অভিযান ' কী ?
উঃ । ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ অর্জনের কথা ঘোষণা করে এবং আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেয় । আমেদাবাদের সবরমতী আশ্রম থেকে অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে গান্ধিজি দীর্ঘদিন পদযাত্রা করে গুজরাটের ডান্ডি নামক স্থানে পৌঁছে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল লবণ আইন ভঙ্গ করেন । ইতিহাসে এই ঘটনা ‘ ডান্ডি অভিযান ' নামে পরিচিত । সমুদ্রের তটভূমিতে একমুঠো লবণ তুলে গান্ধি প্রতীকীভাবে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনকে অস্বীকার করেন ।
১৭. সীমান্ত গাখি সম্পর্কে যা জানো লেখো ।
উঃ । ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে পাঠানরা আইন অমান্য আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন । এদের নেতৃত্ব দেন খান আব্দুল গফফর খান । এরা ছিলেন অহিংস গান্ধিবাদী সংগ্রামী । গান্ধি অনুগামী হওয়ার সুবাদে আব্দুল গফফর খান ' সীমান্ত গান্ধি ' নামে পরিচিত হন । তাদের সংগঠনটির নাম ছিল খুদা - ই - খিদমদদ্গার ।
১৮. কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা কী ?
উঃ । কাকোরি রেল স্টেশনে ডাকাতির অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা করে । এই মামলায় ভগতের সহযোগী রামপ্রসাদ বিশমিল , আসফাকউল্লাসহ চারজনের ফাঁসি হয় ।
১৯. ১৯৩০ এর দশকে কংগ্রেসের মধ্যে কেন মতবিরোধ দেখা দেয় ?
উঃ । নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পুরোনো রক্ষণশীল নেতৃত্বের আন্দোলনের উপায় ও সামাজিক - অর্থনৈতিক ভাবনা চিন্তার মধ্যে নানা মতপার্থক্য দেখা দেয় । সুভাষচন্দ্র , জওহরলাল প্রমুখ তরুণ নেতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ও ভবিষ্যতের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে যুবসম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বৈপ্লবিক কর্মসূচির দাবী তোলেন । ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রাদেশিক সরকার পরিচালনায় কংগ্রেসের কি ভূমিকা হওয়া উচিত তা নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে একটা বিরাট মতবিরোধ বা ফাটল দেখা দেয় ।
২০. ' লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ' কী ?
উঃ । ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল দিল্লিতে কেন্দ্রীয় আইনসভার কক্ষে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত বোমা মারেন । দুই বিপ্লবীই স্বেচ্ছায় ধরা দেন । এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ প্রশাসন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ' লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ' শুরু করেন । সেই মামলার রায়ে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ ভগৎ সিংহ সহ বঁটুকেশ্বর দত্ত , সুখদেও ও রাজগুরুর ফাঁসি হয় ।
২১. হোমরুল আন্দোলন কী ? এর গুরুত্ব কী ছিল ?
উঃ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় স্বায়ত্তশাসন লাভের আশায় ভারতীয়রা হোমরুল আন্দোলনের ডাক দেয় । আয়ারল্যান্ডের হোমরুল আন্দোলনের অনুকরণে , ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যানি বেসান্ত ও বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে ভারতে হোমরুল আন্দোলনের সূচনা হয় । বেসান্ত এর ‘ নিউ ইন্ডিয়া ’ ও তিলকের ‘ মারাঠা ’ ও ‘ কেশরী ' পত্রিকা আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে । স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে । তবে হোমরুল আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় । তবে আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ প্রশাসন মন্টেগু - চেমসফোর্ড সংস্কার দ্বারা ভারতীয়দের সীমিত স্বায়ত্তশাসনের দাবী মেনে নেয় ।
২২. নেহেরু রিপোর্ট কী ?
উঃ । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনের পূর্ণ অধিবেশনে ভবিষ্যত ভারতের খসড়া সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে পণ্ডিত মোতিলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে গঠিত ৯ সদস্যের কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করে । এই রিপোর্ট নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত । তবে সুভাষচন্দ্র , জওহরলাল নেহেরু , জিন্নাহ সহ কংগ্রেস নেতৃত্ব এই রিপোর্ট মানতে অস্বীকার করেন ।
❐ রচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর ঃ
১. গান্ধিজির স্বরাজ ভাবনা কীরূপ ছিল ? তাঁর সব আদর্শ কি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল ?
উঃ । গান্ধিজি তাঁর স্বরাজ ভাবনার আদর্শ বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন যে কেবল ব্রিটিশ শাসন বা সরকার নয় , পুরো পাশ্চাত্য আদর্শভিত্তিক আধুনিক শিল্প সমাজ ভারতের সাধারণ মানুষের শত্রু । তাই শুধু ঔপনিবেশিক শাসনকে হটালেই হবে না । সমাজে ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে যা যা গড়ে উঠেছে সেগুলিও ত্যাগ করতে হবে । তিনি চাষির মতো সরল জীবনযাপন করার পরামর্শ দেন ।
এর পাশাপাশি যন্ত্রনির্ভর আধুনিক সভ্যতার বিরোধিতা করে তিনি খাদির পোশাক ও চরকা কাটার কর্মসূচি যোগ করেন । বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি গান্ধিজি নিজের ব্যক্তিত্বকেও আলাদা রূপ দেন । হাঁটুর উপরে সাধারণ কাপড় পরা , সরল ভাষায় কথা বলা এবং গ্রাম্যজীবনের সঙ্গে জড়িত লোকধর্মের প্রতীক তিনি ব্যবহার করতে শুরু করেন । স্বাভাবিক ভাবেই গান্ধির পাশ্চাত্য ও যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা বিরোধী বক্তব্য সবাই সমর্থন করেনি । মনে রাখতে হবে গান্ধিজি নিজেই তাঁর বক্তব্য প্রচারের কাজে সংবাদপত্র ব্যবহার করেন । পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াতের জন্য তিনি রেলব্যবস্থার সুবিধা নেন । সংবাদপত্র বা রেলব্যবস্থা ছিল আধুনিক যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার একটি প্রধান অঙ্গ । গান্ধিজি নিজের ব্যক্তিত্ব ও লোকবর্ণের অনুষঙ্গ ব্যবহার করে অসংখ্য সাধারণ মানুষের কাছে ‘ আপনজন ’ হয়ে উঠলেও তুলসীদাসী রামায়ণ বা রামরাজ্য প্রভৃতি প্রতীক দেশের হিন্দু জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল , কিন্তু দেশের অনেক সংখ্যক বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীর কাছে সেগুলির গুরুত্ব তেমন ছিল না । বরং হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের ফলে গাণির আদর্শের মধ্যে একটা অংশের সর্বজনীনতা নষ্ট হয়েছিল ।
২. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।
উঃ । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধি ডাক দেন ' করেঙ্গে ইয়া মরেখো " , ভারতজোড়া এই আন্দোলনে নানান অংশের জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে । ওই বছরে ১ আগস্ট ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনের প্রধান নেতাদের গ্রেফতার করে । ফলত নেতৃত্ববিহীন সাধারণ মানুষ ভারতের নানা জায়গায় স্বতস্ফূর্তভাবে আন্দোলন চালান । ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত শহরগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে । জনগণের সঙ্গে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে হরতাল ও বিক্ষোভ চলতে থাকে । আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই আন্দোলনের ভরকেন্দ্র শহর থেকে গ্রামের দিকে সরে যেতে থাকে । ব্যাপক সংখ্যায় কৃষকরা এই আন্দোলনে যোগ দেন । বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল করে দেওয়া হয় । কয়েকটি অঞ্চলে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সরকার গড়ে তোলে । মেদিনীপুরের তমলুক মহকুমায় সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার । ভারতছাড়ো আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারের তরফে বিরাট সংখ্যক পুলিশ ও সেনাবাহিনী ব্যবহার করা হয়েছিল । তমলুকের বৃদ্ধা বিদ্রোহিনী মাতঙ্গিনী হাজরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান । বাস্তবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর এত বড়ো বিদ্রোহ যে ভারতে হয়নি তা ব্রিটিশ প্রশাসন স্বীকার করে নিয়েছিলেন ।
৩. ভারতের রাজনীতিতে আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযানের কী প্রভাব পড়েছিল ?
উঃ । আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান সফল না হলেও ভারতের রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়েছিল । ওই ফৌজের বহু সেনাকে আত্মসমর্পনের পরে ভারতে আনা হয় এবং দিল্লির লালকেল্লায় তাঁদের বিচার শুরু হয় । এদের মধ্যে পি . কে . সেহগাল , জি . এস ধিলো ও শাহনওয়াজ খানকে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার অভিযুক্ত করে । আজাদ হিন্দ ' ফৌজের লড়াইয়ের প্রভাব ভারতীয় সেনাদের ওপর পড়েছিল । অনেক সৈনিক আজাদ হিন্দ ত্রাণ তহবিলে অর্থদান করেন । ব্রিটিশ সরকারের চোখে আজাদ হিন্দের সেনারা দেশদ্রোহী হলেও জনমানসের চোখে তাঁরা দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন । তাঁদের বিচার বন্ধের দাবীতে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্য জনসভা ও মিছিল হয় । ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি বা ব্রিটিশ নৌবাহিনী প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । আজাদ হিন্দ সেনাদের শাস্তি ঘোষিত হলেও গণঅভ্যুত্থানের আশঙ্কায় ব্রিটিশ সরকার তিন বিচারাধীন বন্দিকে মুক্তি দেয় ।
৪. আইন অমান্য আন্দোলনের বিবরণ দাও ।
উঃ । ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ অর্জনের কথা ঘোষণা করে এবং গান্ধির নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয় । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল আইন অমান্য কর্মসূচির লক্ষে গান্ধিজি গুজরাটের সবরমতী আশ্রম থেকে দীর্ঘ পদযাত্রা করে ডান্ডির সমুদ্রতীরে পৌঁছান । সমুদ্রের তটভূমি থেকে লবণ তৈরি করে গান্ধিজি লবন আইন ভঙ্গ করেন এবং প্রতীকীভাবে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনকে অস্বীকার করেন । এরপর অতি দ্রুত দেশজুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে । সাধারণ মানুষ হরতাল ও বিক্ষোভে যোগ দিতে থাকেন । বিদেশি দ্রব্য বয়কট করার পাশাপাশি সরকারকে কর দেওয়া বন্ধ করে । কৃষকরা রাজস্ব দিতে অস্বীকার করে । ব্যাপক সংখ্যায় নারীরা আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেন । ভারতের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে খান আবদুল গফফ্ফর খানের নেতৃত্বে পাঠানরা আইন অমান্য আন্দোলনে সামিল হন । আইন অমান্য আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার প্রবল দমননীতির সাহায্য নেয় । রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয় । জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলির ওপর কঠোর বিধিনিষেধ চাপানো হয় । পাশাপাশি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার একটি বৈঠক ডাকে । কংগ্রেস এই বৈঠক বয়কট করে ।
এর ফলে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ৪ মার্চ গান্ধি ও লর্ড আরউইনের মধ্যে একটি চুক্তি হয় । সেই চুক্তিতে ঠিক হয় অহিংস সত্যাগ্রহী বন্দিদের ব্রিটিশ সরকার মুক্তি দেবে । দমনমূলক আইনগুলি সরকার তুলে নেবে । এর বদলে কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলন তুলে নেবে । পাশাপাশি লন্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গান্ধিজিকে উপস্থিত থাকাতে রাজি করায় ব্রিটিশ সরকার । কিন্তু দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় হতাশ গান্ধিজি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের প্রথম থেকে আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন । ১৯৩২ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য জেলে যান । ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে আইন অমান্য আন্দোলন নিঃশর্ত ভাবে তুলে নেওয়া হয় । তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের আইন অমান্য আন্দোলন বিশেষ সফল হয় নি । হিন্দু মুসলিম ঐক্যও তেমনভাবে দেখা যায় নি । পাশাপাশি এই আন্দোলনে শহুরে শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত মানুষের যোগদান কম ছিল । শ্রমিকরা কম যোগ দিয়েছিলেন । তবে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা এই আন্দোলনে বেশি সংখ্যায় যুক্ত হয়েছিলেন । পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেস গান্ধির স্বরাজের আদর্শ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল । রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস ধীরে ধীরে সংবিধানিক অধিকার পেতে বেশি উৎসাহী হয়ে পড়েছিল ।
৫. সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযানের বিবরণ দাও ।
উঃ । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন মোহন সিং ও রাসবিহারী বসু জাপানে যুদ্ধবন্দি ব্রিটিশ বাহিনীর ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি করেন । রাসবিহারী বসুর অনুরোধে সুভাষচন্দ্র জাপানে গিয়ে এই বাহিনীর দায়িত্ব নেন । ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ বা স্বাধীন ভারতের যুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেন । তিনি নিজেই এই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও প্রধানমন্ত্রী হন । তিনি এক নির্দেশনামায় বলেন এই সৈন্যবাহিনীর লক্ষ্য হইবে মাত্র একটি — ভারতের স্বাধীনতা লাভ , এবং ইচ্ছাও হইবে একটি — ভারতের স্বাধীনতার জন্য কাজ করা কিংবা মৃত্যুবরণ করা ।.... ” জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে জাপান অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর ` দ্বীপপুঞ্জ তুলে দেন । ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রথম ব্যাটেলিয়ন রেঙ্গুন থেকে ভারত অভিমুখে যাত্রা করে । ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ ভারতের মাটিতে তাঁরা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন । এপ্রিল মাসে আজাদ হিন্দ বাহিনী কোহিমা অবরোধ করে । কিন্তু আজাদ হিন্দের দুই রেজিমেন্টসহ জাপানের সেনাবাহিনীর ইম্ফল অভিযান বিপর্যস্ত হয় । ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান কোণঠাসা হয়ে পড়ার ফলে বার্মা সীমান্ত থেকে জাপান তার বিমানবাহিনী যুদ্ধরত এলাকায় সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় । প্রবল বর্ষার ফলে খাদ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । এছাড়া রোগ , শীত , ম্যালেরিয়া প্রভৃতির জন্য প্রচুর সৈনিক মারা যান । নানা সমস্যা ও বাধার ফলে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযান সফল হয়নি । তবু সুভাষচন্দ্র নিরাশ হননি । তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্যের আশা করেন । জাপান সরকার সুভাষচন্দ্রকে রাশিয়া চলে যাওয়ার জন্য মাঞ্চুরিয়া পর্যন্ত ব্যবস্থা করে দেয় । কিন্তু যাত্রাপথে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তাইওয়ানের তাইহোকু বিমানবন্দরে এক দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয় বলে প্রচারিত হয় । তবে খবরটির সত্যতা সম্পর্কে সংশয় তৈরি হয় । ভারতবাসী এই সংবাদ বিশ্বাস করেননি তাঁরা মনে করেন সুভাষচন্দ্র বসু আজও জীবিত আছেন ।
No comments:
Post a Comment