একটা চড়ুই পাখি
তারাপদ রায়
👉(প্রশ্ন উত্তর দাঁড়াও শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
কবি - পরিচিতিঃ
বিশিষ্ট রম্যচনাকার ও বাংলা ভাষার অন্যতম বিশিষ্ট কবি তারাপদ রায় ১৯৩৬ সালে বর্তমান বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি আধুনিক কালের কবিদের মধ্যে অন্যতম । কবির রচনারীতির বৈশিষ্ট্য একটু আলাদা ধরনের । কথা , ভঙ্গি ও পরিহাস মিশ্রিত কাব্য ভাষায় তিনি স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছেন । তিনি ‘ পূর্বমেঘ ’ ও ‘ কয়েকজন ' পত্রিকা সম্পাদনা করতেন । বাংলার পাঠকমহলে মধ্যে তাঁর স্থান একটু আলাদা রকমের । তিনি ছোটো বড়ো সবার জন্য কলম ধরলেও সাহিত্যিক হিসাবে শিশুদের কাছে বড়ো প্রিয় , শিশু সাহিত্যে তিনি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন । তাঁর বিখ্যাত শিশুসাহিত্যের চরিত্র হলো ডোডো ও ভাতাই । তাঁর রচিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে , ' তোমার প্রতিমা ’ , ‘ নীলদিগন্তে এখন ম্যাজিক ' , ' কোথায় যাচ্ছেন তারাপদবাবু ? ' , ' দারিদ্র্যরেখা ' , ' জলের মতো কবিতা ' । ২০০৭ সালে তিনি পরলোকগমন করেন ।
সারমর্মঃ
একটি চড়ুই পাখি কবির ঘরে বাসা বেঁধেছে । সকালবেলা সে বের হয় , সন্ধ্যা যখন নামে সে তখন ফেরে । সারাদিন তার প্রচুর কাজ , এবাড়ি ওবাড়ি থেকে খড়কুটো বয়ে আনা , ধান ছড়ানো । ঘর জুড়ে তার কিচিমিচির গান শুনতে হয় । কখনো সে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে কবিকে দেখে হয়তো ভাবে এই লোকটা যখন চলে যাবে তখন এই ঘরের সবকিছু , চেয়ার টেবিল , বইপত্র , ফুলদানি , বইখাতা সব , সবই তার হবে । এই সমস্ত কিছু বিধাতা তাকেই দেবেন । যখন কার্নিসে বসে একটা তাচ্ছিল্যের চাহনি নিয়ে সে কবির দিকে দেখে তার ভাবটা তখন বেশ মজার — এই বাজে ঘরে আছি নিতান্ত দয়া করে , চলে যেতেই পারি — যদি চলে যাই তবে তুমি একলা । সেও ইচ্ছে হলেই চলে যেতে পারে — যেখানে খুশি , এপাড়া - ওপাড়া পালেদের , বোসেদের বাড়ি কিন্তু সে যায় না । কবির প্রতি দয়াই করে । রাত্রি নামে , আবার কবি ও চড়ুই পাখি নির্জন ঘরের মধ্যে একাকী বাস করে ।
নামকরণঃ
সাহিত্যে নামকরণ তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার । তারাপদ রায় অন্যতম বিশিষ্ট কবি , তাঁর রচনাশৈলী সম্পূর্ণ আলাদা , শিশুর মতন করে কলম ধরছেন তিনি । মানবজীবনের একটি সহজ সত্য কবি একটি চড়ুই পাখির মধ্যে তুলে ধরতে চেয়েছেন । আমাদের প্রত্যেকের গৃহের প্রতি একটা আকর্ষণ থাকে । দিনান্তে বিশ্রাম নিতে আমরা সেখানে ফিরে আসি । কবিতার চড়ুই পাখিটি কবির ঘরে বাসা বেঁধেছে । সকালে বেরিয়ে যায় সন্ধ্যেয় সে ফেরে । সারা দিন কিচিরমিচির করা , খড়কুটো বওয়া তার কাজ , ধানের খোলা ছড়িয়ে রাখা বিশেষ ধরনের কাজ । কবি বের হয়ে গেলে সে হয়তো ভাবে এই বাড়ি , বাড়ির সব জিনিস বিধাতা তাকে দেবে , মাঝে মাঝে সে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে কবিকে দেখে । কবির মনে হয় কবিকে পাখিটি দয়া করছে । পাখি ভাবে এই বাজে ঘরে দয়া করে আছি , যে কোনো সময় চলে যাবো , তবে দিন শেষ হয়ে রাত আসে কবি আর চড়ুই একত্রে একই ঘরে রাত কাটায় । সমস্ত কবিতাটি একটি ছোট্ট চড়ুই পাখিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে । তাই ‘ একটি চড়ুই পাখি ’ নামকরণটি সার্থক হয়েছে বলা যায় ।
১.১ তারাপদ রায় কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ?
উঃ তারাপদ রায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ।
১.২ তাঁর রচিত দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো ।
উঃ । তাঁর রচিত দুটি কাব্যগ্রন্থ হলো দারিদ্র্যরেখা , জলের মতো কবিতা ।
২। নীচের প্রশ্নগুলির একটি বাক্যে উত্তর লেখো :
২.১ কবিতায় চড়ুই পাখিকে কোথায় বাসা বাঁধতে দেখা গেছে ?
উঃ । কবির ঘরের মধ্যে চড়ুই পাখিটিকে বাসা বাঁধতে দেখা গেছে ।
২.২ চড়ুই পাখি এখান - সেখান থেকে কী কী সংগ্রহ করে আনে ?
উঃ । চড়ুই পাখিটি এ বাড়ি থেকে খড়কুটো , ও বাড়ি থেকে ধান প্রভৃতি সংগ্রহ করে আনে ।
২.৩ কবির ঘরের কোন্ কোন্ জিনিস চড়ুই পাখিটির চোখে পড়ে ?
উঃ । কবির ঘরের জানালা , দরজা , টেবিল , ফুল - দানি , বই - খাতা এ সবই চড়ুই পাখিটির চোখে পড়ে ।
২.৪ ইচ্ছে হলেই চড়ুই পাখি কোথায় চলে যেতে পারে ?
উঃ । ইচ্ছে হলেই চড়ুই পাখিটি বাড়ি বা এ পাড়ায় ওপাড়ায় , বোসেদের , পালেদের বাড়ি চলে যেতে পারে ।
৩. নীচের প্রশ্নগুলি কয়েকটি বাক্যে উত্তর লেখো :
৩.১ ‘ চতুর চড়ুই এক ঘুরে ফিরে আমার ঘরেই বাসা বাঁধে ' — চড়ুই পাখিকে এখানে চতুর বলা হলো কেন ?
উঃ । কবির মনে হয়েছে চড়ুই পাখিটি খুবই চতুর । সে জানে কবি তার ঘরে একা থাকেন । সকালে বের হলে সে তো সন্ধেবেলা ফেরে । ঘরে থাকে খুব কম সময়ের জন্য , ফলে গোটা ঘরে তার অবাধ রাজত্ব । তাই কবির ঘরটি তার বাসা বাধার উপযুক্ত মনে করেছিল । যদিও সে এমনভাব করে যেন সে দয়া করে কবির ঘরে আশ্রয় নিয়েছে । ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারে তবে যায় না । সে যেন বোঝে কবির একাকীত্ব , তাই ইচ্ছে করলেও কবি তাকে তাড়িয়ে দেবেন না । তাই কবি তাকে চতুর বলেছেন ।
৩.২ কবিতার বিধৃত চিত্রকল্পগুলি দৃষ্টান্তসহ আলোচনা করো ।
উঃ । কবির বিবৃত উল্লেখযোগ্য চিত্রকল্পগুলো হলো—
( ১ ) কার্নিশে বসে চাহনিতে তাচ্ছিল্য মজার ভাব , যেন এই বাজে ঘরে দয়া করে আছি , কারণ দয়ার শরীর ।
( ২ ) কখনো কবিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখে ভাবে এই লোকটা চলে গেলে এই ঘর - দোর - জানালা - টেবিলের ফুলদানি - বইপত্র সব বিধাতা তাকে দেবে ।
( ৩ ) সন্ধ্যা ফেরে - সন্ধ্যাকাল আসার চিত্র ফুটে উঠেছে ।
৩.৩ হয়তো ভাবে ... – চড়ুই পাখি কী ভাবে বলে কবি মনে করেন ?
উঃ । কবি মনে করেন যে চড়ুই পাখিটি হয়ত ভাবে কবি চলে গেলে কবির ঘর , জানলা , দোর , টেবিলের ফুলদানি , বইখাতা সব চড়ুই পাখিটির হবে । বিধাতা তাকেই কবির সব জিনিস দিয়ে দেবেন ।
৩.৪ ‘ আবার কার্নিশে বসে চাহনিতে তাচ্ছিল্য মজার .. --- তাচ্ছিল্য ভরা মজার চাহনিতে তাকিয়ে চড়ুই কী ভাবে ?
উঃ । কার্নিশে উড়ে এসে বসে একটি ছোটো চড়ুই পাখি । তাচ্ছিল্য ভরা চাহনিতে তাকিয়ে চড়ুই ভাবে সে একটা বাজে ঘরে আছে নিতান্ত তার মায়ার শরীর বলে । ইচ্ছে করলেই সে আজকেই এ পাড়ায় ও পাড়ায় ‘ পালেদের ’ ‘ বোসেদের ’ বাড়ি চলে যেতে পারে । কবির নিঃসঙ্গতা অনুভব করেই যেন সে চলে যায় নি ।
৩.৫ চড়ুই পাখিকে কেন্দ্র করে কবির ভাবনা কী ভাবে আবর্তিত হয়েছে তা কবিতা অনুসরণে আলোচনা করো ।
উঃ । ছোট্ট একটি চড়ুই পাখি , তাকে কেন্দ্র করে কবি মেলে ধরেছেন তাঁর কল্পনার জাল । সারাদিন পাখিটি কবির ঘরে । কতো কি না বয়ে আনে খড়কুটো , ধান , আর কবিকে দেখে ভাবে এই লোকটা চলে গেলে ঘরের সবকিছুই আমার হবে । কখনো সে দয়ার দৃষ্টিতে দেখে কবিকে , ভাবে যেন দয়া করে আছি এই ঘরে , যখন ইচ্ছা হবে উড়ে চলে যাব । তবু সে যায় না , কবির প্রতি সে যেন এইটুকু দয়া করে । দিন শেষে রাত্রি নামে কবি ফিরে আসেন , দেখেন রাত্রে চড়ুই পাখি তার ঘরেই আশ্রয় নিয়েছে । নির্জন রাত বেড়ে চলে ঘরে কবি ও পাখি একাকী অথচ পাশাপাশি বাস করেন ।
৩.৬ । ' তবুও যায় না চলে এতটুকু দয়া করে পাখি ' — পঙ্ক্তিটিতে কবি মানসিকতার কীরূপ প্রতিফলন হয়েছে ?
উঃ । কবি খুব রসিক প্রকৃতির মানুষ , কবিতায় তাঁর কথার ভঙ্গি , পরিহাসপ্রিয়তা সর্বত্রই ফুটে উঠেছে । কবি বুঝতে পারেন যে চড়াই পাখিটি ইচ্ছে করলেই এ পাড়ায় ও পাড়ায় পালেদের বোসেদের বাড়ি চলে যেতে পারে তবুও সে কবির প্রতি মমতা অনুভব করে সেখানে থেকে যায় । কবি বুঝতে পারেন সেও নির্জন ঘরে নিঃসঙ্গ কবিকে পছন্দ করে । তাই কবি মনে মনে চড়ুইটির প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন ।
৩.৭ ছোট্ট চড়ুই পাখির জীবনবৃত্ত কিভাবে কবিতার ক্ষুদ্র পরিসরে আঁকা হয়েছে তার পরিচয় দাও ।
উঃ । চড়ুই পাখি লোকালয়ে থাকতে ভালোবাসে । গাছ গাছালিতে বাসা না বেঁধে ঘরের কার্নিশে , চালে বাসা বাঁধে । সারাদিন খড়কুটো বয়ে বয়ে বেড়ায় , ধানের খোসা ছাড়িয়ে ধান খায় । সে গোটা ঘরময় কিচমিচ শব্দ করে গান গায় নানা শব্দের জাল বোনে । কখনো সে কবির কাছাকাছি এসে কৌতূহল । নিয়ে দেখে আর ভাবে লোকটা চলে গেলে তার সবই চড়ুইটির নিজের হবে । আবার কবির নিঃসঙ্গ জীবনেও পাখিটি বৈচিত্র্য নিয়ে এসে কবিমনকে ভরিয়ে রাখতে পেরেছে । কবির ঘরেই শুধু নয় কবির মনেও সে স্থান করে নিয়েছে ।
৩.৮ ' কৌতূহলী দুই চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে দেখে ' — চড়ুই পাখির চোখ , কৌতূহলী , কেন ? তার চোখে কবির সংসারের কোন্ চালচিত্র ধরা পড়ে ?
উঃ । পাখির দুটি চোখ কৌতূহলী কারণ সে কবিকে দেখে তার বাড়িঘর পর্যবেক্ষণ করে আর ভাবে এই মানুষটি চলে গেলে , এই বাড়িঘর , দোর জানালা - টেবিলের ফুলদানি সব তার । পাখির চোখে ধরা পড়ে কবির সংসারের চালচিত্র । কবি একাকী শান্ত প্রকৃতির মানুষ । পাখি এতো নোংরা করলেও তাকে তাড়ান না । কবির বাড়ির গুছানো । পরিষ্কার টেবিল তাতে ফুলদানি পাশে বইপত্র । বাড়িটি অতি সাধারণ এবং কবি একলাই বাস করেন । কবির এই নিঃসঙ্গতা কখনও এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে চড়ুই পাখিটির কবির ঘরে না থাকা কবির মনকে উতলা করে তোলে । তাই কবি বলেছেন ইচ্ছা করলেই সে চলে যেতে পারে - কিন্তু কবির প্রতি কৃপাবশত চড়ুই পাখিটি কোথাও যায় না ।
৩.৯ ‘ রাত্রির নির্জন ঘরে আমি আর চড়ুই একাকী ’ — পঙ্ক্তিটিতে ‘ একাকী ’ শব্দটি প্রয়োগের সার্থকতা বুঝিয়ে দাও ।
উঃ । ‘ একাকী ’ কথাটির মধ্যে দিয়ে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে তিনি এই পৃথিবীতে একদম একা , তাঁর আপনজন বলতে কেউ নেই তাই তিনি একা । তিনি যেমন একা প্রিয়জনহীন তেমনি চড়ুইটিও একা থাকে । হয়তো সে কবির সঙ্গ পছন্দ করে কিন্তু তা তার ভাবভঙ্গীতে বোঝা যায় না । তাই একই ঘরে চড়ুই ও কবি একসাথে থাকলেও কবি মনের দিক দিয়ে একাই থাকেন । সেই অর্থে ‘ একাকী ’ শব্দটি কবির নিঃসঙ্গ জীবনের বেদনাকে আরও গভীর করে তুলেছে ।
৩.১০ ' একটি চড়ুই পাখি ’ ছাড়া কবিতাটির অন্য কোনো নামকরণ করো । কেন তুমি এমন নাম দিতে চাও , তা বুঝিয়ে লেখো ।
উঃ । কবিতাটির নামকরণ করা যেতে পারে — ' চড়ুই - এর ভাবনা ' । কবিকে লক্ষ্য করে চড়ুই পাখিটির ভাবনার অন্ত নেই । পাখিটি ভাবে এই লোকটি চলে গেলে এই ঘরদোর জানালা -টেবিলের ফুলদানি - বইপত্র সবই তার হবে । আবার কখনো কবির দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে সে তাকায় । ভাবখানা যেন সে ইচ্ছা করলেই কবির বাড়ি ছেড়ে যেতে পারে , যায় না কারণ তার দয়ার শরীর মনে হলেই সে পালেদের , বোসেদের বাড়ি যেখানে খুশি যেতে পারে , তাই কবিতাটির নামকরণ ' চড়ুই - এর ভাবনা ' অযৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না ।
No comments:
Post a Comment