👉(নাটোরের কথা প্রশ্ন উত্তর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কবি - পরিচিতিঃ
বিজয় সরকার ‘ কবিয়াল ' রূপেই অধিক পরিচিত । তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত কবিয়াল , গীতিকার , সুরকার এবং বাউল - ফকিরি গানের নায়ক । ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নড়াইলের ডাম্বিতে তাঁর জন্ম হয় । তাঁর আসল নাম বিজয় অধিকারী । তিনি ভাবরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন । পরে খাজনা সংগ্রাহক হিসেবে চাকরি করেন । লোকসংগীতের গায়ক হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন । ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কবিয়াল মনোহর সরকার যিনি গোপালগঞ্জের অধিবাসী ছিলেন মূলত এবং রাজেন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় । দুই বাংলায় তাঁর গানের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অপরিসীম । তিনি অনেক জনপ্রিয় সংগীত রচনা করেন । ওইসব সংগীতের মধ্যে ' তুমি জানো না প্রিয় ’ ‘ তুমি মোর জীবনের সাধনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । সারাজীবনে তিনি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন । ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান | হয় । বর্তমান গানটি বাংলাদেশ লালন একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘ স্বকণ্ঠে বিজয় ' অ্যালবাম থেকে নেওয়া হয়েছে ।
সারমর্মঃ
করি সমগ্র গানটিতে বলেছেন , আষাঢ়ের ভেজাপথে শ্রাবণ এসেছে । ভরা শ্রাবণের বৃষ্টির মতোই কবির মনেও ভাঙনের আভাস । তাঁর মনও আজ ভেঙে গেছে । শ্রাবণ যেমন ঘর ভেঙে দেয় তেমনি কবির মনও আজ ভেঙে গেছে । চূর্ণিনদীর পাড়ে কবি যে ঘর বেঁধেছিলেন শ্রাবণের ঘূর্ণিতে তাঁর সেই ঘর ভেঙে খানখান হয়ে গেছে । দুরন্ত শ্রাবণ এসে একদিকে কবির ঘর অন্যদিকে কবির মন দুই - ই ভেঙে দিল । কবি অত্যন্ত দুঃখিত হলেন । হিজলগাছে কবি কল্পিত যে জলপরি থাকে তার চোখেও আজ অশ্রুধারা যেন বয়ে চলেছে । কবি যেন সেই জলপরির কান্নাই আজও কেঁদে চলেছেন । সে কান্না ঘরভাঙার কান্না সে কান্না শ্রাবণের ধ্বংসের কারণে । শ্রাবণের জলের ছিটে লেগে মাঠের আগুন নিভে যায় কিন্তু রাবণের চিতা কখনো নেভে না । শ্রাবণে প্রকৃতির দুরবস্থার সঙ্গে কবির মনের দুঃখ এক হয়ে গিয়ে রাবণের চিতার মতোই ধিকিধিকিভাবে জ্বলতে থাকে । তার কোনো শেষ হয় না । পরের বছর শ্রাবণ যখন ফিরে আসে তখন কিন্তু আর বন্যায় ভেসে যাওয়া সেই ঘরবাড়ি কোনোকিছুই ফিরে আসে না । কবি ভেবেছিল বিধাতার এমনই বিধান ।
নামকরণঃ
প্রত্যেক কবিতায় কবি নামকরণ করেন কবিতার বিষয়কে কেন্দ্র করে । এখানে এই কবিতাটি মূলত একটি গান । তাঁরা গানটির প্রথম পক্তিকে নামকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে । এটি শ্রাবণের গান । এখানে কবি একটি বিশেষ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন । অতিবৃষ্টিতে প্রকৃতি কীভাবে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে কবিতাধর্মী গানে সেটাই কবি ব্যক্ত করেছেন । কবির মনে শ্রাবণের ভাঙা বৃষ্টি । তিনি গানটিতে প্লাবনের এক অন্যরূপ তুলে ধরেছেন । অতিশ্রাবণে প্লাবন নেমে আসে । সেই প্লাবনে ঘরবাড়ি ভেসে যায় । মাঠের আগুন সেই শ্রাবণের বৃষ্টিতে নিভে যেতে পারে । কিন্তু রাবণের চিতা শ্রাবণের মেঘে নেভে না । প্রতি বছর যখনই শ্রাবণ আসে তখনই ঘরবাড়ি ভেসে যায় । জলে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় । সেই দুঃখের কথা , বেদনার কথা এই গানে ফুটে উঠেছে । পৃথিবীতে বহু জিনিসই হারিয়ে যায় আবার ফিরেও আসে কিন্তু শ্রাবণে ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ি , মানুষজন , সংসার কিছুই ফিরে আসে না । কবির এই মনোভাব গানের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে । তাই গানটির নাম ' আষাঢ়ের কোনো ভেজা পথে ’ দেওয়া হয়েছে এবং এই নামকরণটি যথাযথ হয়েছে বলেই মনে হয় ।
অতি - সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর
১. গানটিতে কোন্ দুই মাসের কথা বলা হয়েছে ?
উঃ । আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসের কথা গানটিতে বলা হয়েছে ।
২. গানটিতে উল্লিখিত নদীর নাম কী ?
উঃ । গানটিতে উল্লিখিত নদীটি হলো চূর্ণি ।
৩. গানটিতে কোন্ গাছের কথা বলা হয়েছে ?
উঃ । হিজল গাছের কথা বলা হয়েছে ।
৪. রাবণ কে ?
উঃ । রামায়ন মহাকাব্যে লঙ্কার রাজা ছিলেন রাবণ ।
৫. শ্রাবণ বছরে কতবার আসে ?
উঃ । শ্রাবণ বছরে একবার আসে ।
৬. গানটিতে কোন্ কাল্পনিক নারীর উল্লেখ আছে ?
উঃ । গানটিতে জলপরির উল্লেখ আছে )
৭. প্লাবনে কবির কী ক্ষতি হয়েছে ?
উঃ । প্রাবনে কবির ঘর ভেঙে গেছে ।
৮. কবির মনে কীসের দুরাশা ?
উঃ । বন্যায় ভেসে যাওয়া ঘর আর ফিরবে না এটাই কবির দুরাশা ।
৯. আলোচ্য গানটিতে কবি ভাৰণ সম্পর্কে কী বলেছেন ?
উঃ । গানটিতে কবি শ্রাবণকে ‘ ঘরভাঙা ’ ও দুরত্ত বলেছেন ।
১০. কোন্ চরে কবির বাড়ি ছিল ?
উঃ । কবির বাড়ি ছিল চূর্ণি নদীর চরে ।
১১. কবির কোথায় ভাঙন লেগেছে ?
উঃ । কবির মনের কূলে ভাঙন লেগেছে ।
১২. কে উদাসী চোখে কী দেখে ?
উঃ । জলপরি কন্যা উদাসী চোখে শ্রাবণের বন্যা দেখে ।
১৩. জলের ছিটে লেগে কী নেভে ।
উঃ । জলের ছিটে লেগে মেঠো আগুন অর্থাৎ মাঠের উত্তাপ নিভে যায় ।
১৪. রাবণের চিতা কী ?
উঃ । কথিত আছে , রাবণের চিতার আগুন কখনও নেভে না । এখানে কবির মনের আগুনের কথা বলা হয়েছে । সেই মনের আগুন কখনও নেভে না । তা রাবণের চিতার মতোই সদা জ্বলতে থাকে ।
১৫. কবি কোথায় বসতি বেঁধেছিলেন ? সে বসতির কী হয়েছিল ?
উঃ । চূর্ণি নদীর ঘূর্ণিপাকে জেগে ওঠা চরে কবি বসতি বেঁধেছিলেন । কবির সে বসতি স্থায়ী হয়নি , দুরস্ত এক শ্রাবণের বন্যায় কবির সে ঘর ভেসে গিয়েছে ।
১৬. ' তার কি নাই কাদন ' — এখানে তার বলতে কার কথা বলা হয়েছে ? সে কোথায় রয়েছে ?
উঃ । এখানে তার বলতে জলপরি কন্যার কথা বলা হয়েছে । কবির ছায়াভিটের হিজলে গাছে জলপরি কন্যা রয়েছে ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর
১. ' এমনি দিনে মনের কূলে লেগেছে ভাঙন ' — এই উত্তির মধ্য দিয়ে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন ?,
উঃ । ঋতুবৈচিত্র্যের নিয়মেই আষাঢ়ের ভেজা পথ ধরে শ্রাবণ এসেছে । আর সেই দুরন্ত শ্রাবণ ডেকে এনেছে বন্যাকে । এই বন্যাতেই কবির স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তোলা ঘর ভেসে গেছে । কিন্তু ঘর ভেসে যাওয়ার সাথে কবির মনেও এক আঘাত এসেছে । সেই আঘাতে কবির মনের কূলে ভাঙন লেগেছে অর্থাৎ কবির বিশ্বাস ভেঙে গেছে । বন্যা একদিন সরে যাবে কিন্তু কবির মনে সংশয় , তিনি কি আদৌ তার স্বপ্নের বসতি আবার নতুন করে গড়ে তুলতে পারবেন ।
২. রাবনের চিতা নেভে না বন্ধু’– প্রসঙ্গ নির্দেশ করে এর তাৎপর্য লেখো ।
উঃ । ' আষাঢ়ের কোন ভেজা পথ ’ গানটিতে কবি বলেছেন প্রবল গ্রীষ্মের তাপে মাঠ আগুনের মতো তেতে থাকে এবং বর্ষার জলের স্পর্শে সে তাপ নিভে যায় । কিন্তু কবির মনের যে তাপ , যে বেদনা তা সেই রাবণের চিতার মতো জ্বলতে থাকে । প্রবাদে আছে রাবণের চিতা কখনো নেভে না । শ্রাবণের মেঘে কবির মনের সেই আগুন আরও দ্বিগুণ বেগে জ্বলে ওঠে । সে দহনজ্বালা কবির কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে ।
No comments:
Post a Comment