👉(প্রশ্ন উত্তর স্বাধীনতা ল্যাংস্টন হিউজ)
কবি পরিচিতিঃ
ভারতের মুক্তি আন্দোলনের আকাশে অনেক নেতা ছিলেন , কিন্তু নেতাজি বলতে সারা পৃথিবী একজনকেই বোঝে তিনি হলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসু । ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা ছিলেন জানকীনাথ বসু ও মাতা প্রভাবতী দেবী । সুভাষচন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় উড়িষ্যার কটক শহরে , স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে তিনি দর্শনশাস্ত্রে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আটমাস সময়ের মধ্যে তিনি ( সিভিল সার্ভিস ) আই.সি.এস. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন । প্রথম জীবনে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের গুরু । ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি পদে নির্বাচিত হন । গৃহে অন্তরীণ থাকার সময় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে তিনি কাবুল হয়ে রাশিয়ায় পৌঁছান । পরে রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজ - এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ' তরুণের স্বপ্ন ' , সিপাহী বিদ্রোহ ’ , ‘ An Indian Pilgrim ' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । স্বনামধন্য এই স্বাধীনতা সংগ্রামী বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে প্রচারিত হয় । কিন্তু ভারতবাসী সেকথা অবশ্য বিশ্বাস করেনি । এই দেশবরেণ্য নেতা তাই ভারতবাসীর কাছে আজও অমর ।
সারসংক্ষেপঃ
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ইংরেজদের তাস । তাঁকে শেষপর্যন্ত মান্দালয়ের জেলে নির্বাসনে পাঠিয়ে কিছুটা শাস্তি পেতে চেয়েছেন ইংরেজ কর্তৃপক্ষ । মান্দালয় জেলে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্র চিঠি লিখেছেন , তাঁর প্রিয়বন্ধু দিলীপকে । কয়েদিদের পাঠানো লেখা কর্তৃপক্ষ পড়ে দেখে তারপর বাড়ির লোকের হাতে পাঠান । রাজনৈতিক বন্দিদের অবশ্য একটু আলাদাভাবে একাকী নির্জনে রাখা হয় । প্রতিটি পত্রই এককথায় বলা যায় Censor হয় । তাই লেখককে তাঁর বক্তব্য লিখতে হয় খুব সাবধানে কথার কৌশলে । নির্জন একাকীত্ব সুভাষকে দিয়েছে চিন্তাশক্তি ও পর্যবেক্ষণ শক্তি । লৌহদ্বারের অন্তরালে বসে তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যৎকাল সম্পর্কে অনেক কিছুই অনুভব করতে শিখেছেন । তিনি মনে করেন কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে জেলে থাকা সম্ভব নয় ।
জেলের সমস্ত আবহাওয়াটা মানুষকে যেন বিকৃত ও অমানুষ করে তোলার পক্ষে উপযোগী । তিনি বিশ্বাস করেন জেলে যারা থাকে তাদের সকলের পক্ষে একথা খাটে । তিনি আরো মনে করেন জেলে থাকলে কারোর নৈতিক উন্নতি তো হয় না বরং তারা আরো হীন হয়ে পড়ে । এতদিন জেলে বাস করার পর সুভাষের উপলব্ধি কারা - সংস্কারের দিকে নজর দিয়ে তার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে । আর এ ব্যাপারে আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেটস্ - এর মতো উন্নত দেশগুলির ব্যবস্থাই অনুসরণ করতে হবে । এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে যেটা দরকার তা হচ্ছে একটা নতুন প্রাণ বা একটা নতুন মনোভাব এবং অপরাধীর প্রতি একটা সহানুভূতি । অপরাধীদের প্রবৃত্তিগুলিকে মানসিক ব্যধি বলেই ধরতে হবে এবং সেইভাবেই তাদের ব্যবস্থা করা উচিত । তাই তিনি লিখেছেন আমি নিজে কারারাস না করলে হয়তো কোনো অপরাধীকে সহানুভূতির চোখে দেখতে পারতাম না । এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন ' আমি মনে করি আমাদের আর্টিস্ট বা সাহিত্যিকগণের যদি কিছু কিছু কারা জীবনের অভিজ্ঞতা থাকত তাহলে আমাদের শিল্প ও সাহিত্য আরো উন্নত হতো । কাজী নজরুলের কবিতা যে তার জেলের অভিজ্ঞতার কাছে কতখানি ঋণী সে কথা তিনি বোধহয় ভেবে দেখেননি । তিনি বলেছেন সাধারণত একটি । ভাব বন্দিদশায় মানুষের অন্তরে শক্তি সঞ্চার । আমিও সেইখানেই আমার দাঁড়াবার ঠাঁই করে নিয়েছি এবং দর্শন বিষয়ে যতটুকু পড়াশুনো করা গেছে সেটুকু এবং জীবন সম্বন্ধে আমার যে ধারণা আছে তাও আমার বেশ কাজে লেগেছে । মানুষ যদি তার নিজের অন্তরে ভেবে দেখবার যথেষ্ট বিষয় খুঁজে পায় । তবে বন্দি হলেও তার কষ্ট নেই । অবশ্য যদি তার স্বাস্থ্য অটুট থাকে ।
কিন্তু আমাদের কষ্টতো শুধু আধ্যাত্মিক নয় — সে যে শরীরের এবং প্রস্তুত থাকলেও দেহ সে সময় দুর্বল হয়ে পড়ে । তিনি মনে করেন লোকমান্য তিলকের দু - বছরের কারাবাস তাঁর অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী । যদিও তিলক কারাবাসে গীতার আলোচনা লিখেছিলেন । লেখক মনে করেন কারাবাসের নির্জনতা জীবনের চরম সমস্যাগুলি বোঝার সুযোগ করে দেয় , নিজস্ব চিন্তা ভাবনার বিকাশ ঘটায় । কারাবাসকে শহিদের সঙ্গে তুলনা করা যায় । কারাবাস অকাল বার্ধক্যের জন্ম দেয় । শরীরে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না । তাই জেলের পরিবেশ আমূল পাল্টাতে হবে । যখন জোর করা হয় কাউকে বন্দি করা হয় তখনই সে স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পারে । তাই যতদিন জেলগুলিকে স্বাস্থ্যকর করা ও সামাজিক বিধি ব্যবস্থার বন্দোবস্ত না হয় ততদিন কয়েদিদের সংস্কার হওয়া সম্ভব নয় । জেলগুলি উন্নতি নয় অবনতির কারণ হয়ে থাকবে । লেখক মনে করেন সাধারণ অপরাধী এবং রাজনৈতিক অপরাধীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে । রাজনৈতিক অপরাধীগণ মুক্তি পেলে সমাজ তাকে বরণ করে নেবে । কিন্তু সাধারণ অপরাধীদের তেমন কোনো সান্ত্বনা নেই । সে বোধহয় তার বাড়ি ছাড়া আর কোথাও কোনো সহানুভূতিই আশা করতে পারে না । তাই সমাজে মুখ দেখাতে সে লজ্জা পায় । লেখক চান সভ্য সমাজ অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি দেখাক । জেল দৈহিক কষ্ট নয় মানসিক কষ্টের জায়গা । কিন্তু আঘাত এখানেও আসে তাতে কর্তৃপক্ষেরও অনেক সময় হাত থাকে না । তবে বিনা দুঃখ কষ্টে যা লাভ করা যায় তার কোনো মূল্য থাকে না । শেষপর্যন্ত লেখক সুন্দর সুন্দর বই পাঠানোর জন্য বন্ধুকে পত্রে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ।
নামকরণঃ
বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য পত্রসাহিত্য । লেখক সুভাষচন্দ্র জেলের মধ্যে বসে খুব সুচিন্তিতভাবে নিজের মতামত ও উপলব্ধির কথা লিখেছেন । জেলের নির্জনতা , একাকিত্ব মানুষকে আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে সাহায্য করে । তবে জেলের পরিবেশ মানুষকে সংশোধন করে না । তাঁর অপরাধীত্ববোধকে আরো বাড়িয়ে দেয় তাই জেলের আমূল সংস্কার প্রয়োজন । নেতাজি সুভাষচন্দ্র স্বভাবতই একজন রাজবন্দি রূপে এই পত্রে নিজের অনুভূতি , সাধারণ কয়েদিদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও মমত্ববোধ ফুটিয়ে তুলেছেন ।
তাঁর অভিজ্ঞতায় কীভাবে কারাগারে সংস্কার করা যায় সে প্রসঙ্গে নিজের ভাবনা চিন্তাতে তিনি পত্রের মাধ্যমে বন্ধুকে জানিয়েছিলেন । পুরো রচনাটি জেলখানা থেকে পাঠানো একটি চিঠি যা তিনি লিখেছেন তাঁর বন্ধু দিলীপকে । তিনি বন্ধুর পাঠানো বইগুলো ফেরত দিতে পারেননি । কারণ তার অনেকগুলি নতুন পাঠক জুটে ছিল । অন্যদিকে তাঁর প্রেরিত পত্রের censor এর বাধা সম্পর্কে তিনি পত্রে লিখেছেন । দেখা গেছে সমগ্র পত্রটিতে জেলবাস ও জেল সংক্রান্ত নানা প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে । তা ছাড়া রচনাটি জেল থেকে লেখা এবং অবশ্যই চিঠির আকারে লেখা । তাই রচনাটির নাম ‘ জেলখানার চিঠি ’ সুপ্রযুক্ত হয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই ।
১.১ সুভাষচন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন কেন ?
উঃ । ভারত বিদ্বেষী ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন সাহেবকে প্রহারের অভিযোগে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন ।
১.২ রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে তিনি কোন্ দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন ?
উঃ । রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ - এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন ।
২. অনধিক তিনটি বাক্যে নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও :
২.১ তোমার পাঠ্য পত্রখানি কে , কোথা থেকে , কাকে লিখেছিলেন ?
উঃ । এই পাঠ্যখানি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বসু মান্দালয় জেল থেকে তাঁর পরমবন্ধু দিলীপ রায়কে লিখেছিলেন ।
২.২ কোন্ ব্যাপারটিকে পত্ৰলেখক আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে দেখার কথা বলেছেন ?
উঃ । ইংরেজ শাসিত পরাধীন ভারতের শৃঙ্খলমোচনের ভার লেখক নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার ফলস্বরূপ অকারণে ও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে তার জেলে বন্দি থাকার ব্যাপারটিকে লেখক আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে দেখার কথা বলেছেন ।
২.৩ বন্দিদশায় মানুষের মনে শক্তি সঞ্চারিত হয় কীভাবে ?
উঃ । সাধারণত একটা দার্শনিকভাব বন্দিদশায় মানুষের অন্তর শক্তির সঞ্চার করে । মানুষের অন্তরে যদি ভাবনাচিন্তার বিষয় থাকে তাহলে বন্দিদশাতেও তার মানসিক কষ্ট খুব একটা হয় না ।
২.৪ মান্দালয় জেল কোথায় অবস্থিত ?
উঃ । মান্দালয় জেল ব্রহ্মদেশে অর্থাৎ আজকের মায়ানমার - এ অবস্থিত ।
২.৫ ভারতীয় জেল বিষয়ে একটি পুস্তক সুভাষচন্দ্রের লেখা হয়ে ওঠেনি কেন ?
উঃ । লেখকের বেশি উদ্যম ও শক্তি থাকলে ভারতীয় কোনো বিষয়ে একখানা বই লিখে ফেলার চেষ্টা তিনি করতেন , কিন্তু সে চেষ্টার উপযুক্ত সামর্থ ও শক্তি লেখকের না থাকায় তাই একখানা বই তিনি লিখতে পারেননি ।
২.৬ সুভাষচন্দ্র কেন দিলীপ রায়কে প্রেরিত বইগুলি ফেরত পাঠাতে পারেননি ?
উঃ । লেখক সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর পরম বন্ধু দিলীপ রায়ের পাঠানো বইগুলি সব পেয়েছিলেন । কিন্তু ওই বইগুলি পড়ার জন্য জেলে অন্য অনেক পাঠক জুটে যাওয়ায় সেগুলি তিনি আর ফেরত পাঠাতে পারেননি ।
৩. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর কয়েকটি বাক্যে লেখো :
৩.১ নেতাজি ভবিষ্যতের কোন্ কর্তব্যের কথা এই চিঠিতে বলেছেন ? কেন এই কর্তব্য স্থির করেছেন ? কারা - শাসন প্রণালী বিষয়ে কাদের পরিবর্তে কাদের প্রণালীকে তিনি অনুসরণযোগ্য বলে মনে করেছেন ?
উঃ । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর প্রিয়বন্ধু দিলীপ রায়কে লিখেছেন ভবিষ্যতে কারা সংস্কার করা হবে তাঁর একটা কর্তব্য । লেখকের মতে জেলখানার সমস্ত আবহাওয়াটা মানুষকে যেন বিকৃত ও অমানুষ করে তোলারই উপযোগী এবং এই কথাটা সকল জেলের পক্ষেই প্রযোজ্য । কারবাসে অধিকাংশ অপরাধীদের কোনো নৈতিক উন্নতি হয় না বরং তারা যেন আরোও হীন হয়ে পড়ে । তাই লেখক ভবিষ্যতে কারাবাসের সংস্কার করার কর্তব্য স্থির করেছেন । কারা শাসন প্রণালী বিষয়ে , তিনি ব্রিটিশ প্রণালীর পরিবর্তে আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেটস্ - এর মতো উন্নত দেশগুলির ব্যবস্থাই অনুসরণ করতে চান । কারণ তাঁর মতে কারা শাসনে ব্রিটিশ প্রণালী একটি খারাপ আদর্শের অনুসরণ মাত্র ।
৩.২ ' সেজন্য খুবই খুশি হয়েছি ।'— বৰ্ত্তা কে ? তিনি কীজন্য খুশি হয়েছেন ?
উঃ । এই উদ্ভিটির বস্তা হলেন লেখক সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং । লেখকের বন্ধু দিলীপ রায়ের ২৪/০৩/১৯২৫ তারিখের চিঠি পেয়ে লেখক খুব আনন্দিত হয়েছিলেন । বন্ধু দিলীপ আশঙ্কা করেছিলেন যে মাঝে মাঝে যেমন হয় তেমনি চিঠিখানাকে double distillation- এর ভিতর দিয়ে আসতে হবে কিন্তু এবার তা হয়নি , তাই লেখক খুবই খুশি হয়েছেন ।
৩.৩ ' আমার পক্ষে এর উত্তর দেওয়া সুকঠিন ।'— কে , কাকে এ কথা বলেছেন ? কীসের উত্তর দেবার কথা বলা হয়েছে ?
উঃ । এই উত্তিটির বস্তুা হলেন লেখক সুভাষচন্দ্র বসু । তিনি এই কথা তাঁর পরম মিত্র দিলীপ রায়কে বলেছিলেন । দিলীপ রায়ের লেখা চিঠি তাঁর হৃদয়তন্ত্রীকে এমনই কোমলভাবে স্পর্শ করে চিন্তা ও অনুভূতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল যে , লেখকের পক্ষে এর উত্তর দেওয়া সুকঠিন ব্যাপার
৩.৪ ' পরের বেদনা সেই বুঝে শুধু যেজন ভুক্তভোগী ।'— উদ্ধৃতির সমার্থক বাক্য পত্রটি থেকে খুঁজে নিয়ে লেখো । সেই বাক্যটি থেকে লেখকের কোন মানসিকতার পরিচয় পাও ?
উঃ । উদ্ধৃতিটির একটি সমার্থক বাক্য হলো আমার মনে হয় না । আমি যদি স্বয়ং কারাবাস না করতাম তাহলে একজন কারাবাসী বা অপরাধীকে ঠিক সহানুভূতির চোখে দেখতে পারতাম । লেখক একজন মানবতাবাদী মানুষ । অপরাধীদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল , তাদের প্রবৃত্তিগুলিকে মানসিক ব্যাধি বলেই তিনি ধরতে চান এবং সেইভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন ।
৩.৫ ' আমার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে , অনেকখানি লাভবান হতে পারব ।'— কোন্ প্রসঙ্গে বক্তার এই উক্তি ? জেলজীবনে তিনি আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে কীভাবে লাভবান হবার কথা বলেছেন ?
উঃ । ব্রিটিশ ভারতে মান্দালয় জেলে সুভাষচন্দ্র দীর্ঘকাল বন্দি ছিলেন । জেলের মধ্যে যে নির্জনতায় মানুষকে বাধ্য হয়ে দিন কাটাতে হয় সেই নির্জনতাই তাঁকে জীবনের চরম সমস্যাগুলি তলিয়ে বোঝবার সুযোগ করে দেয় । লেখক নিজের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেন , যে আমাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের অনেক জটিল প্রশ্নই বছরখানেক আগের চেয়ে এখন যেন অনেকটা সমাধানের দিকে পৌঁছে দিচ্ছে — এই প্রসঙ্গেই বস্তুার এই উক্তি । লেখক সুভাষচন্দ্র মনে করেছেন কারাবাস তাঁকে আধ্যাত্মিক দিক থেকে লাভবান করবে । যে সমস্ত মতামত এক সময়ে নিতান্ত ক্ষীণভাবে চিন্তা বা প্রকাশ করা যেত , যে সমস্যাগুলির সঠিক সমাধান তিনি করতে পারছিলেন না । জেলজীবনের নির্জনতার মধ্যে তা যেন সমাধানের পথে এগিয়েছে বলে লেখক মনে করেছেন । আজ যেন সেগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । অন্য কারণে না হলেও শুধু এই জন্যই লেখক মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে অনেকখানি লাভবান হতে পারবেন ।
৩.৬ ' Martyrdom ' শব্দটির অর্থ কী ? এই শব্দটি উল্লেখ করে বক্তা কী বক্তব্য রেখেছেন ?
উঃ Martyrdom শব্দটির অর্থ হলো ' আত্মবলিদান ' । লেখকের পরমবন্ধু দিলীপ রায় , কারাবাসকে একটা Martyrdom বলে অভিহিত করেছেন । প্রসঙ্গে লেখক সুভাষচন্দ্রের বক্তব্য হলো — এটা বন্ধুর গভীর অনুভূতি ও প্রাণের মহত্ত্বেরই পরিচায়ক । কিন্তু লেখকের সামান্য কিছু humour ও Proportion এর জ্ঞান আছে ( অন্তত লেখকের আশা তা আছে ) তাই নিজেকে Martyr বলে মনে করবার মতো স্পর্ধা তার নেই । স্পর্ধা বা আত্মম্ভরিতা জিনিসটা তিনি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে চান , অবশ্য সে বিষয়ে কতখানি তিনি সফল হয়েছেন তা শুধু লেখকের বন্ধুরাই বলতে পারেন । তাই Martyrdom জিনিসটা লেখকের কাছে বড়োজোর একটা মহৎ আদর্শই হতে পারে ।
৩.৭ ' যখন আমাদিগকে জোর করে বন্দি করে রাখা হয় তখনই তাদের মূল্য বুঝতে পারা যায় ।'— কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছে ? ' তাদের মূল্য ' বিষয়ে লেখকের বক্তব্য আলোচনা করো ।
উঃ । আলিপুর জেলে ইউরোপীয় কয়েদিদের জন্য বিভিন্ন মনোরঞ্জনমূলক ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ করেছেন । কিন্তু ভারতীয়দের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই । ফলে ভারতীয় কয়েদিরা নীরস রুক্ষ্ম প্রকৃতির হয় , তাদের মনে বিকৃতিভাব দেখা দেয় । সবাইকে ছেড়ে নির্জনে থাকার অনুভূতি কেমন তা তখনই বোঝা যায় যখন কাউকে জোর করে বন্দি রাখা হয় । ফলস্বরূপ দীর্ঘদিন কারাবাস মানুষকে ধারে ধীরে দেহে ও মনে অকালবৃদ্ধ করে তোলে । তখনই স্বাধীনতার মূল্য বোঝা যায় । এই প্রসঙ্গে লেখক এইরকম উক্তি করেছেন । 189 এখানে ' তাদের মূল্য ' বলতে লেখক সেই বস্তুগুলিকে বুঝিয়েছেন । যা মানুষ বন্দিজীবনে পায় না । জেলে বন্দিত্ব মানুষকে দেহে ও মনে মৃতপ্রায় করে তোলে । পিকনিক , বিশ্রালাভ , সংগীতচর্চা , সাধারণ বক্তৃতা , খেলার জায়গায় খেলাধুলা করা , মনোমত কাব্য সাহিত্যের চর্চা এই সব মানুষের জীবনকে কতখানি সরস করে তোলে তা আমরা বুঝতে পারি না । কিন্তু আমাদের যখন বন্দি করে রাখা হয় তখনই তাদের মূল্য আমরা বুঝতে পারি ।
৩.৮ ‘ মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কী কঠোর ও নিরানন্দময়।— যে ঘটনায় লেখকের মনে এই উপলব্ধি ঘটে তার পরিচয় দাও ।
উঃ । লেখক সুভাষচন্দ্র মনে করেন জ্বেলে ' দৈহিক কষ্ট অপেক্ষা মানসিক কষ্ট সবচেয়ে বেশি । যেখানে অত্যাচার ও অপমানের আঘাত যথাসম্ভব কম আসে সেই বন্দি জীবনটা ততটা যন্ত্রণাদায়ক হয় না । এই সমস্ত সুক্ষ্ম ধরনের আঘাত উপর থেকেই আসে , জেলের কর্তাদের এ বিষয়ে কিছু হাত থাকে না । অন্তত লেখকের সেইরকম অভিজ্ঞতা । এই যে সব আঘাত , উৎপীড়ন এগুলো আঘাতকারীর প্রতি মানুষের মনকে আরো বিরূপ করে তোলে । সেই দিক দিয়ে দেখলে মনে হয় এইগুলোর উদ্দেশ্য ব্যর্থ , কিন্তু পাছে আমরা আমাদের পার্থিব অস্তিত্ব ভুলে যাই এবং নিজেদের অন্তরের মধ্যে একটা আনন্দের জগৎ গড়ে তুলি , তাই এই সব আঘাত আমাদের উপর বর্ষণ করে স্বপ্নাবিষ্ট আত্মাকে জাগিয়ে বলে দেয় মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কী কঠোর ও নিরামন্দময় ।
৩.৯ এই চিঠিতে কারাবন্দি অবস্থাতেও দুঃখকাতর , হতাশাগ্রস্ত নয় , বরং আত্মবিশ্বাসী ও আশাবাদী নেতাজির পরিচয়ই ফুটে উঠেছে । পত্রটি অবলম্বনে নিজের ভাষায় মন্তব্যটির যাথার্থ পরিস্ফুট করো ।
উঃ । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে একজন রাজনৈতিক বন্দি রূপে ব্রিটিশ কারাগারে বন্দি ছিলেন । তিনি ছিলেন একজন মহান চিন্তাবিদ । তাঁর কাছে হতাশা বলে কোনো বস্তু নেই । জেলে থাকাকালীন যে দীর্ঘ সময় তিনি পেয়েছেন সেটা তিনি অভিশাপ বলে মনে না করে বরং আশীর্বাদ হিসাবে দেখেছেন । জেলের নির্জন একাকীত্বের মধ্যে তিনি অনেক কঠিন সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন । আশ্চর্য মনোবল নিয়ে তিনি ভারতীয় কারা শাসন প্রণালীর সংস্কার সাধনের চিন্তা করেছেন । ভবিষ্যত পরিকল্পনা তৈরি করেছেন , যা তাঁর ব্যস্ত জীবনে সম্ভব ছিল না । তিনি জেলগুলির অবস্থা , কয়েদিদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে বুঝেছেন যে কারা সংস্কারের প্রয়োজন । দার্শনিক চিন্তা মানুষের অন্তরে শক্তি যোগায় বলে তিনি উপলব্ধি করেছেন । দুঃখের অশ্রুকে তিনি গুরুত্ব দেননি এবং তার মধ্যেই তিনি প্রেম ও করুণার প্রকাশ দেখেছেন । তা যে মহান ও উন্নততর জীবনে প্রবেশ করার প্রেরণা জোগায় সেকথাও সুভাষচন্দ্র বলেছেন । তাঁর মধ্যে কাতরতা ও হতাশাগ্রস্ততার পরিচয় পাওয়া যায়নি । বরং এই পথে তাঁকে চরম আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হয়েছে ।
৩.১০ । কারাগারে বসে নেতাজির যে ভাবনা , যে অনুভব , তার অনেকখানি কেন অকথিত রাখতে হবে ?
উঃ । ' জেলখানার চিঠিপত্রে ' র লেখক সুভাষচন্দ্র বসু , তাঁর লেখা চিঠিতে তাঁর কর্মজীবন কী হবে ভবিষ্যতে কী কী করতে চান সে সম্বন্ধে নানারকম আলোচনা করে চিঠিটি লিখেছেন । তাঁর পরমবন্ধু দিলীপ রায়কে সেগুলি জানাতে তিনি ভাষার কৌশলের সাহায্য নিয়েছিলেন । কারণ কয়েদিদের লেখা চিঠিপত্র জেল কর্তৃপক্ষ বারবার পড়ে দেখেন । সন্দেহের লেশমাত্র থাকলে সেই চিঠি censor এর বাঁধনে আটকে বাতিল হতে পারে । সুভাষচন্দ্রের লেখা চিঠিগুলি একটি মূল্যবান সম্পদ , তাতে রয়েছে বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা । তাঁর অন্তরের এই সব গভীরতম প্রবাহগুলি দিনের উপযুক্ত আলোতে প্রকাশ হয়ে পড়ুক তা তিনি কখনোই চাননি । তাই এই পাথরের প্রাচীর ও লৌহদ্বারের অন্তরালে বসে তিনি আজ যা ভাবছেন যা অনুভব করছেন তার অনেকখানিই কোনো এক অনাগত ভবিষ্যৎকাল পর্যন্ত অকথিতই রাখতে হবে ।
No comments:
Post a Comment