👉(গড়াই নদীর তীরে প্রশ্ন উত্তর জসীমউদ্দীন)
কবি - পরিচিতিঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিদের মানসপটে একটা চিত্র ভেসে ওঠে । বাঙালি মাত্রই সেই চিত্রটির সঙ্গে পরিচিত । বিশ্ববরেণ্য এই কবির জন্ম হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে । পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথ । শিশুকাল থেকেই তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ দেখা যায় । তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ভারতী ও বালক পত্রিকায় নিয়মিতভাবে লিখতেন । বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভার বিকাশ দেখা যায় । সাহিত্যের এমন কোনো বিভাগ নেই যেখানে তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যাননি ।
তবে কবিরূপেই তাঁর পরিচিতি সর্বাধিক । তাছাড়া প্রবন্ধ , নাটক , উপন্যাস , ছোটোগল্প এবং গান ও চিত্রাঅঙ্কনে তিনি অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন । তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে প্রভাত সঙ্গীত , সন্ধ্যাসঙ্গীত , ক্ষণিকা , চিত্রা , কথা ও কাহিনি ; শিশু , শিশু ভোলানাথ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য । ডাকঘর , চিরকুমার সভা , প্রভৃতি নাটক , গোরা , চোখের বালি , যোগাযোগ , চার অধ্যায় , নৌকাডুবি , প্রভৃতি উপন্যাস এবং মধ্যবর্তিনী , গুপ্তধন , মুসলমানীর গল্প , প্রভৃতি ছোটো - গল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে শিক্ষা , শান্তিনিকেতন , চরিত্র পূজা সর্বাপেক্ষা উল্লেখের দাবি রাখে । এছাড়া তিনি প্রায় দু'হাজারের ওপর গান রচনা করেছেন যা রবীন্দ্রসংগীত নামে জনপ্রিয় । তাঁর ভ্রমণ কাহিনিগুলিও অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক । এ বিষয়ে জাপানযাত্রীর ডায়রি , য়ুরোপপ্রবাসীর পত্র , রাশিয়ার চিঠি প্রভৃতির নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় । এছাড়াও তিনি সারাজীবনে অজস্র ছবি এঁকেছেন । তাঁর সাহিত্য প্রতিভার নিদর্শন স্বরূপ ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে Song Offerings- এর জন্য তিনি এশিয়ার মধ্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন । তাঁর অসাধারণ প্রতিভার জন্য ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘ নাইট ’ উপাধি দেন । কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ওই উপাধি ত্যাগ করেন । তাঁর রচিত ' জনগণমন অধিনায়ক এবং ‘ সোনার বাংলা ’ যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত । তিনি সারা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে গিয়েছেন এবং সর্বত্র পেয়েছেন অনন্য সম্মান । ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয় ।
সারসংক্ষেপঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে স্বাদেশিকতার একটি সভা বসেছিল । কলকাতার এক গলির মধ্যে পোড়ো বাড়িতে এই সভা বসত । গোপনীয়তাই ছিল এই সভার মূল বিষয় , কিন্তু তাদের এই সতর সভ্যদের ব্যবহারে রাজা বা প্রজার কোনো ভয়ের কারণ ছিল না । এই সভায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সদস্য । এই সভার সভ্যদের মধ্যে খ্যাপামির একটা ভাব ছিল । এই সভায় লেখকের প্রধান কাজ ছিল উত্তেজনার আঁচ পাওয়া । বীরত্ব বিষয়টা কখনো কখনো সুখকর কখনো কখনো অস্বস্তিকর কিন্তু এর প্রতি মানুষের যে একটি গভীর শ্রদ্ধা থাকে তা লেখক এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন । মানুষ চিরকালীন কোনো কাজে যদি কোনো পথ আটকে দেয় তবে একটা বিষম বিকার তৈরি হয় । বীরধর্ম যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মানবধর্ম । দুটির একটি না হলে মানবধর্মের পক্ষে পীড়াদায়ক হয় ।
দেশের সাহিত্যে স্বাদেশিকতার যে আঁচ লেগেছিল রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রমুখরা এই স্বাদেশিকতাকে সভা ও বক্তৃতা প্রভৃতির দ্বারা সামলে রাখার চেষ্টা করছেন । রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বাদেশিকতাকে কার্যে পরিণত করতে উদ্গ্রীব ছিলেন । তাই ভারতবর্ষের সর্বজনীন পোশাক কী হওয়া উচিত তার নানাপ্রকার নমুনা তিনি উপস্থিত করতে লাগলেন । তিনি নিজের পোশাকটিকে সর্বজনীন করবার জন্য বিজাতীয় পায়জামার সঙ্গে আলগা মালকোঁচা লাগিয়ে মাথায় টুপি পাগড়ির মিশেলে অদ্ভূত একটি পোশাক তৈরি করে পরতেন । দেশের মঙ্গলের জন্য প্রাণ দিতে পারা মানুষ থাকতে পারে কিন্তু দেশের জন্য সর্বজনীন পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকসুলভ নয় ।
নামকরণঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোচ্য প্রবন্ধের নাম রেখেছেন ' স্বাদেশিকতা ' । স্বদেশিযুগের মানুষ নিজেকে স্বদেশি প্রমাণ করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল । তার জন্য দেশীয় সাহিত্য , শিল্পচর্চা তারা যেমন করত তেমনি অন্যান্যভাবেও নিজেদের স্বদেশি প্রমাণ করতে নিজেদের উদ্ভট খেয়ালকেও প্রশ্রয় দিত । যেমন এখানে রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজেকে স্বদেশি বলে প্রমাণ করতে নিজের পোশাকটিকেই অভিনব তৈরি করেছিলেন । ধুতি পায়জামার সম্মিলিত পোশাক .ও টুপি পাগড়ি সম্মিলিত মাথার ঢাকা দেবার বস্তুটি দেখতে অভিনব কিন্তু তা সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারেনি । কারণ পোশাকটি অদ্ভুত ধরনের । ফলে তা সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হবে না এটাই স্বাভাবিক । স্বাদেশিকতার স্পর্শ কেবল সাহিত্য , শিল্পে নয় । বিভিন্ন বক্তৃতায় , সভা সমিতিতে যেমন প্রকাশ পেতে থাকল তেমনি কিছু কিছু অত্যুৎসাহী অতিরিক্ত স্বাদেশিকতার ঝোঁকে উদ্ভট কিছু করতে উৎসাহী হয়ে পড়েন । রবীন্দ্রনাথ পাঠ্যাংশে সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন । তাছাড়া স্বাদেশিকতার অর্থ যে আরো ব্যাপক আরো মহৎ তাও রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে স্পষ্ট হয় । সব দিক থেকে বিচার করে এই রচনাটির ‘ স্বাদেশিকতা ’ নামকরণ নির্বাচন সঠিক হয়েছে ।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর
১. কার উদ্যোগে সভা গঠন হয়েছিল ?
উঃ রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদার উদ্যোগে সভা গঠিত হয়েছিল ।
২. জ্যোতিদাদা কে ছিলেন ?
উঃ । জ্যোতিদাদা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
৩. সভায় কোন্টি রক্ষা করা আবশ্যক ছিল ?
উঃ । সভায় গোপনীয়তা রক্ষা করার আবশ্যক্তা ছিল ।
৪. সভার সভাপতি কে ছিলেন ?
উঃ । সভার সভাপতি ছিলেন বৃদ্ধ রাজনারায়ণবাবু ।
৫. ফোর্ট উইলিয়াম কী ?
উঃ । ফোর্ট উইলিয়াম ইংরাজ আমলে নির্মিত একটি দুর্গা বা কেল্লা ।
৬. লেখক কোন্টিকে বিজাতীয় পোশাক বলেছেন ?
উঃ । পায়জামাকে বিজাতীয় পোশাক বলেছেন ।
৭. ধুতি কেমন পোশাক বলে লেখক বলেছেন ?
উঃ । ধুতি কর্মক্ষেত্রের উপযোগী পোশাক নয় বলে লেখক বলেছেন ।
৮. জ্যোতিদাদার তৈরি শিরোভূষণটি কেমন ?
উঃ । জ্যোতিদাদার তৈরি শিরোভূষণটি টুপি ও পাগড়ির মিশেল ।
৯. স্বদেশি সভার সভ্যরা কীসে দীক্ষিত ছিল ?
উঃ । স্বদেশি সভার সভ্যরা ঋকমন্ত্রে দীক্ষিত ছিল ।
১০. বৃহৎ রাজব্যবস্থায় কী কী থাকা আবশ্যক ?
উঃ । বৃহৎ রাজব্যবস্থায় বীরধর্ম ও মানবধর্ম দুটি থাকাই আবশ্যক বলে লেখক মন্তব্য করেছেন ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর
১. কার উদ্যোগে কীসের সভা হয়েছিল ? এতে সকলের রোমহর্ষন হতো কেন ?
উঃ । লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে একটি স্বাদেশিক সভা হয়েছিল । লেখক ও তার সঙ্গীরা মধ্যাহ্নে কোথায় কী করতে যেতেন তা তাঁদের আত্মীয়রাও জানতে পারতেন না । সভার দ্বার বন্ধ থাকত । ঘর অন্ধকার এবং কথা হতো চুপিচুপি । এতেই সকলের রোমহর্ষন হতো ।
২. স্বাদেশিকতার সভাগৃহটি কীরূপ ছিল ?
উঃ । কলকাতার একটি গলির মধ্যে এক পোড়োবাড়িতে স্বাদেশিকতার সভা বসত্ব সাধারণত দুপুরবেলাতেই । সভাঘরের দরজা বন্ধ থাকত এবং ঘর অন্ধকার করে রাখা হতো । সেই সভার সভ্যদের ঝকমন্ত্রে দীক্ষা দেওয়া হতো । সভ্যরা অভ্যস্ত চুপি চুপি বাক্যালাপ করতেন । সব মিলিয়ে সভাগৃহের পরিবেশ ছিল রোমহর্ষক । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. বীরত্ব জিনিসটা কীরূপ বলে লেখক বলেছেন ? তাকে কীভাবে জাগিয়ে তোলা হয় ?
উঃ । লেখক রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ স্বাদেশিকতা ' প্রবন্ধে বীরত্ব সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন যে বীরত্ব কোথাও সুবিধার আবার কোথাও বা অসুবিধার কারণ হতে পারে কিন্তু তার প্রতি মানুষের একটি গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে । সেই শ্রদ্ধাকে জাগিয়ে রাখতে সব দেশের সাহিত্যেই প্রচুর আয়োজন দেখা যায় । লেখক ও তাঁর সঙ্গীগণ সভা করে , কথা বলে , কল্পনা করে , গান গেয়ে মানুষের মনে একটা ধাক্কা বা নাড়া দিয়ে সেই শ্রদ্ধার ভাবটাকে আরো জাগিয়ে তোলেন কারণ এটা মানুষের প্রকৃতিগত এবং চিরদিনই আদরণীয় , এর পথ বন্ধ করে দিলে মানুষের মধ্যে একটা বিকারের সৃষ্টি হয় বলে লেখক মনে করেন ।
৪. ' অভিনয় সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে ।'— কীসের অভিনয় সাঙ্গ হইয়াছে ? এই অভিনয় সম্বন্ধে লেখকের বিশ্বাস কী ছিল ?
উঃ । রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যোতিদাদার উদ্যোগে গঠিত স্বাদেশিক সভার কার্যক্রমকে অভিনয় বলেছেন । এই সভার মাধ্যমে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেশের মানুষের মধ্যে স্বদেশিকতাবোধ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন । কিন্তু এই সভা শুধুমাত্র কয়েকজনের কল্পনা এবং গোপন আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল । লেখকের মতে এই সভার যে কার্যক্রম চলত তা কেবলমাত্র উত্তেজনার আগুন পোহানো ছাড়া আর কিছু নয় । তাই এই সভায় স্বদেশের কাজ করার চেয়ে অভিনয় বেশি হয়েছে এবং সেই অভিনয় সাঙ্গ হয়ে গেছে এবং তা আসল উদ্যোগকে সফল করতে পারেনি ।
৫. সর্বজনীন পোশাক হিসেবে ধুতি ও পায়জামাকে জ্যোতিদাদা বাতিল করেছিলেন কেন ? সর্বজনীন পোশাক হিসেবে তিনি কোন নমুনা প্রকাশ করেন ?
উঃ । স্বাদেশিক সভায় জ্যোতিদাদা সর্বজনীন পোশাক হিসেবে ধুতি ও পাজামাকে ত্যাগ করেন । কারণ তিনি মনে করতেন ধুতি কর্মক্ষেত্রের উপযোগী পোশাক নয় আর পায়জামাটি বিজাতীয় পোশাক । জ্যোতিদাদা সর্বজনীন পোশাক হিসেব পাজামার ওপর একখণ্ড কাপড় পাট করে তাতে একটা আলাদা কৃত্রিম মালকোঁচা জুড়ে দিলেন । আর শোলার টুপির সঙ্গে পাগড়ির মিশেল করে একটি জিনিস তৈরি করেছিলেন যা তিনি মাথায় পরতেন । লেখকের বিশ্বাস সেই সভার বালকরা যে বীরত্বের প্রহসন অভিনয় করেছিল তা যদি সেই সময়ে ইংরেজ গর্ভমেন্টের কঠোর সন্দেহের সঙ্গে মুখে পড়ত তা হলে পরিণতি অত্যন্ত ট্রাজেডি অর্থাৎ করুণ হতে পারত ।
৬. ‘ ফোর্ট উইলিয়মের একটা ইষ্টকও খসে নাই ।'— এই উক্তিটির মধ্যে দিয়ে লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন ?
উঃ । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে কলকাতার এক পোড়ো বাড়িতে যে স্বাদেশিক সভা গড়ে উঠেছিল তার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মধ্যে স্বদেশচেতনা গড়ে তোলা । এই সভার সদস্যরা গোপন কল্পনা , বাক্যালাপ ও গানের মাধ্যমে দেশের হিতসাধনের চেষ্টা করতেন । ফোর্ট উইলিয়াম ছিল ইংরেজ সরকারের অন্যতম শাসন কেন্দ্র । একে কেন্দ্র করেই ইংরেজদের সামরিক শক্তির প্রয়োগ ঘটত । লেখক রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে স্বাদেশিক সভার সদস্যরা যতই মনে করুন এই গোপন আলোচনার মাধ্যমে তাঁরা ইংরেজ সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দেবেন কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি । প্রকৃতপক্ষে ইংরেজের শাসনকেন্দ্র ফোর্ট উইলিয়ামের একটা ইটও খসে পড়েনি অর্থাৎ তাঁদের এই সভা ইংরেজদের মনে সন্দেহের রেখাপাতই করেনি ।
No comments:
Post a Comment