কবি - পরিচিতিঃ
কবি , ঔপন্যাসিক , ছোটো গল্পকার , নাট্যকার , প্রাবন্ধিক , শিশু সাহিত্যিক ও সমালোচক হলেন বহু প্রতিভার অধিকারী বুদ্ধদেব বসু । আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র তিনি । সাহিত্যের সমস্ত শাখায় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে । এই সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৮ সালে । বুদ্ধদেব বসু রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ বন্দীর বন্দনা ’ , ‘ কঙ্কাবতী ’ , ‘ দ্রৌপদীর শাড়ি ’ , ‘ যে আঁধার আলোর অধিক ’ , শীতের প্রার্থনা ’ , ‘ বসন্তের উত্তর ’ । তিনি ‘ কবিতা ' পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন । ' কল্লোল ' ও ' প্রগতি ' পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন । শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন কান্তিকুমারের পণ্যকাণ্ড , ঘুমপাড়ানি , এলোমেলো প্রভৃতি রচনা । রবীন্দ্রনাথের পর এমন বহুমুখী প্রতিভা বাংলা সাহিত্যে বিরল । ১৯৭০ সালে তিনি ‘ পদ্মভূষণ ’ পুরস্কারে সম্মানিত হন । ১৯৭৪ সালে কবির জীবনাবসান হয় ।
সারমর্মঃ
হাওয়া এমন একটা জিনিস যাকে ধরা যায় না , ছোঁয়া যায় কিন্তু দেখা যায় না , অনুভব হয় । ধরে রাখা যায় না । তাই হাওয়াদের কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই । দিনরাত বিভিন্ন বস্তুর উপর দিয়ে তারা বয়ে যায় । কবির ভাষায় হাওয়া সারাদিন রাত্রি বুক চাপা কান্নায় কেঁদে মরে । পৃথিবীতে যত জল আছে , যত তীর আছে সব ছুঁয়ে গেছে তারা , সমস্ত জল , পাহাড় একেবারে স্থির , শহর - নগর - বন্দর , অরণ্য শূন্য তেপাত্তর সব পথে তারা বৃথা ঘোরে । বাতাসের গতিতে সবাই অস্থির , পার্কের বেঞ্চে পাতা ঝরে পড়ে , কাচের জানলায় শার্সিতে কেঁপে ওঠা দেয়ালের পাঁজর , চিমনির নিস্বনে ও কাননের ক্রন্দনে তারা প্রশ্ন করে চলে যায় । শুধু তারা যথার্থ জিজ্ঞাসা করে মিষ্টি ছেলে যখন দোলনায় ঘুমায় , আবছায়া কার্পেটে কুকুর তন্ত্রায় ব্যস্ত , ঘরে ঘরে জ্বলে যায় স্বপ্নের মৃদু মোম সেই শুধু থাকে না ।
তারা খোঁজে যাকে তারই দেখা নেই । আঁধার রাতে জাহাজ চলে , মান্ডুলে দীপ জ্বলে , যাত্রীরা কেউ নাচে কেউ গান গায় । হাওয়া তখন বিপুল বিক্রমে গতি সঞ্চয় করে তরঙ্গের বুকে আঘাত হেনে প্রশ্নের উত্তর খোঁজে । অবশেষে সব থেমে গিয়ে ডেক নির্জন হয়ে পড়ে , সমুদ্র দুলে ওঠে বাঁকা চাঁদ ঝুলে পড়ে , সে কোথায় কিন্তু হাওয়ার বিশ্রাম নেই । হাওয়া সেই সব আশ্রয়হীন চির - দুঃখীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায় । আশ্রয়হীন আশ্রয় খুঁজে যায় , কিন্তু কোথাও তা মেলে না ।
নামকরণঃ
' হাওয়ার গান ’ একটি জনপ্রিয় কবিতা । এই কবিতার মূল বক্তব্য হলো , সংসারে যারা কর্মী তারা নিঃস্বার্থভাবে দান করে যায় । কখনো নিজের জন্য ভাবে না , তাদের স্থান কোথায় ? বাতাস বয়ে চলে , বিশ্বের বুক জুড়ে চলে একই গান , কোথায় গেলে তাদের পাই , কোথাও তাদের স্থান নেই রে । কখনও পার্কে , কখনও সমুদ্রে সে বয়ে চলে । হাওয়ার শব্দে কবি প্রশ্ন করা খুঁজে পেয়েছেন । তিনি অনুভব করেছেন তাদের গৃহ খুঁজে না পাওয়ার এবং অবিরাম ছুটে চলার বেদনা । হাওয়ার শব্দে বেদনার সুর বেজে ওঠে । তাই বাতাসের ছুটে চলা ও প্রশ্ন করাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত কবিতাটির ' হাওয়ার গান ' নামকরণ যথার্থ হয়েছে ।
১.১ বুদ্ধদেব বসু রচিত দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো ।
উঃ । বুদ্ধদেব বসু রচিত দুটি কাব্যগ্রন্থ হলো ' বন্দীর বন্দনা ' এবং ' কঙ্কাবতী ।
১.২ তিনি কোন পত্রিকা সম্পাদনা করতেন ?
উঃ । তিনি ' কবিতা ' নামক পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন ।
২. নীচের প্রশ্নগুলির একটি / দুটি বাক্যে উত্তর দাও :
২.১ দুর্বার ইচ্ছায় হাওয়া কী কী ছুঁয়ে গেছে ?
উঃ । পৃথিবীর সব জল সহ তীর হাওয়া তার দুর্বার ইচ্ছায় ছুঁয়ে গেছে ।
২.২ তার কথা হাওয়া কোথায় শুধায় ?
উঃ । পার্কের বেঞ্চিতে , ঝরা পাতায় , শার্শিতে , কেঁপে ওঠা দেওয়ালের পথ্বরে , চিমনির নিম্বনে ও কাননের ব্রুদনে হাওয়া তার কথা শুধায় ।
২.৩ মাণ্ডুলে দীপ জ্বলে কেন ?
উঃ । জাহাজ যখন রাতের আঁধারে সমুদ্র পথে চলে তখন দূর থেকে তা যাতে বোঝা যায় সেইজন্য মাণ্ডুলে দীপ জ্বলে ।
২.৪ পার্কের বেঞ্চিতে আর শার্সিতে কাদের উপস্থিতির চিহ্ন রয়েছে ?
উঃ । পার্কের বেঞ্চিতে ঝরাপাতার এবং শার্সিতে কেঁপে ওঠা দেয়ালের পাঁজরে হাওয়াদের উপস্থিতির চিহ্ন রয়েছে ।
২.৫ নিশ্বাস কেমনভাবে বয়ে গেছে ?
উঃ । নিশ্বাস উত্তাল ও অস্থিরভাবে বয়ে গেছে ।
৩. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর সংক্ষেপে লেখো :
৩.১ হাওয়ার চোখে ঘরের যে ছবি পাওয়া যায় তা কবিতা অনুসরণে লেখো ।
উঃ । ‘ হাওয়ার গান ’ কবিতায় হাওয়ার চোখে একটি ঘরের ছবি সুন্দরভাবে ধরা পড়ে । সেই ঘরে একটি মিষ্টি ছেলে দোলনায় ঘুমিয়ে রয়েছে । আবছা ঘরের মেঝেতে কার্পেটের ওপর কুকুরটি তন্দ্রামগ্ন হয়ে রয়েছে । ঘরের মধ্যে মোমবাতির জ্বলা আলোয় এক স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে । কিন্তু সেই ঘরে হাওয়া যাকে খুঁজে চলে সে বোধ হয় সেখান থেকে বিদায় নিয়ে গেছে ।
৩.২ সমুদ্রের জাহাজের চলার বর্ণনা দাও ।
উঃ । অন্ধকার সমুদ্রের মাঝে যখন জাহাজ চলে তখন মাণ্ডুলে দীপ জ্বলে । জাহাজে বিভিন্ন আমোদ অনুষ্ঠান হয় । কেউ সিনেমা দেখে , কেউ নৃত্য করে , বিশাল বিশাল তরঙ্গ ভেঙে জাহাজ এগিয়ে চলে । এক সময় সব থেমে যায় , ডেক নির্জন হয়ে যায় । চাঁদ অস্ত যায় এবং অকুল অন্ধকারে শুধু দুলে ওঠা সমুদ্রের ফেটে পড়া গর্জন শোনা যায় ।
৩.৩ পৃথিবীর কোন্ কোন্ অংশে হাওয়া ঘুরে বেড়ায় ?
উঃ । পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্টস্থানে হাওয়া থাকে না । সব জল সব তীর ছুঁয়ে সর্বত্র হাওয়া ঘুরে বেড়ায় । পাহাড় , বন্দর , নগরে , ঘন ভীড় , অরণ্য , তেপান্তরের মতো শূন্য প্রান্তরে হাওয়ারা ঘুরে বেড়ায় । এমনকি পার্কের বেঞ্চিতে , চিমনির নিশ্বনে , কাননের ফ্রন্দনেও তাদের অস্তিত্ব অনুভব করা যায় ।
৪. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর বিশদে লেখো :
৪.১ হাওয়াদের কী নেই ? হাওয়ারা কোথায় কীভাবে তার খোঁজ করে ?
উঃ । হাওয়াদের নিজস্ব ঘর নেই । তারা পৃথিবীর সব জল , তীর , পাহাড় বন্দর , বন্দর - নগর , তেপান্তর পার্কের বেঞ্চ , ঝরা পাতা , শার্সিতে , দেওয়ালের পঙ্গুরে , চিমনির নিস্বনে , কাননের ফ্রন্দনে সর্বত্র তার খোঁজ করেছে ।
৪.২ ' চিরকাল উত্তাল তাই রে ' — কে চিরকাল উত্তাল ? কেন সে চিরকাল উত্তাল হয়ে রইল ?
উঃ । কবি বলেছেন হাওয়া চিরকাল উত্তাল । হাওয়াদের কোনো বাড়ি নেই , তারা চিরকালই বাইরে কেঁদে যায় । পৃথিবীর সব জায়গা তারা ছুঁয়ে যায় তার সেই ঘরের খোঁজে , যে ঘর আর কোথাও নেই । যার খোঁজে হাওয়া উত্তাল হয়ে অস্থিরভাবে ছুটে বেড়ায় , তাকে সে পায় না । পৃথিবীর সব জল , তীর , বন্দর , নগর ছুঁয়ে সে বৃথাই বয়ে যায় । পার্কের ঝরাপাতা ঢাকা বেঞ্চিকে , দেয়ালের শাসিকে , চিমনিকে ও কাননের কান্নাকে সে প্রশ্ন করে । কিন্তু কোথাও তাকে পায় না । হাওয়া কোনো বিশ্রাম নেয় না । অন্তহীন সময় ধরে সারা বিশ্ব জুড়ে তারা এই অফুরন্ত সন্ধান চলতে থাকে । তাই সে চিরকাল উত্তাল হয়ে থাকে ।
৪.৩ কবিতাটির নাম ‘ হাওয়ার গাল ' দেওয়ার ক্ষেত্রে কী কী যুক্তি কবির মনে এসেছিল বলে তোমার মনে হয় ?
উঃ । হাওয়া উদ্দাম , উচ্ছ্বল , তীব্র তার গতি , তাকে আটকে রাখার সাধ্য কারো নেই । সে পৃথিবীর সর্বত্র প্রবাহিত , নানা শব্দের সৃষ্টি হয়েছে তার প্রবাহের মধ্যে । এলোমেলোভাবে নয় , একটি নির্দিষ্ট সুর কাজ করে হাওয়ার মধ্যে দিয়ে , কখনও সেটা করুণ কখনো বা উত্তাল । সময় অন্তহীন অফুরান সময় । তাই কবিতার নাম হয়েছে ‘ হাওয়ার গান ' । সম্পূর্ণ কবিতাটি হাওয়ার নিজের বক্তব্য দিয়ে বলা হয়েছে । তারা নিজেরাই জানায় কীভাবে সর্বত্র তারা বৃথাই খুঁজে চলেছে । সমগ্র বিশ্বকে জুড়ে অনন্তকাল ধরে তাদের সন্ধানে উজ্জ্বল হয়ে খুঁজে চলেছে । সে কোথায় সে কোথায় । কবিতাটির নামকরণ করার ক্ষেত্রে এইসব যুক্তিগুলিই কবির মনে এসেছিল বলে আমার মনে হয় ।
No comments:
Post a Comment