আদাব
সমরেশ বসু
👉(শিকল পরার গান কাজী নজরুল ইসলাম প্রশ্ন উত্তর )
লেখক পরিচিতিঃ
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান লেখক সমরেশ বসু । আধুনিক সাহিত্যের জনপ্রিয় এই লেখক জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৪ সালে ঢাকার বিক্রমপুরে । আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ছোটো গল্পকার ও ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু তাঁর ক্ষুরধার কলমের সাহায্যে সকলের মন জয় করে নিয়েছেন । জীবনযাপনের বিভিন্ন পর্বে তিনি বিচিত্র পেশা অবলম্বন করে । নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন । ফেরিওয়ালা থেকে চটকলের শ্রমিক , বস্তির এঁদো ঘর থেকে সুরম্য দালান — সর্বত্রই ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ । তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল বি.টি. রোডের ধারে , ' গঙ্গা ' , ' শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে ' , ' জগদ্দল ' , ' মহাকালের রথের ঘোড়া ' ইত্যাদি । তিনি স্বনামে ও কালকূট ছদ্মনামে বহু গল্প উপন্যাস রচনা করেছেন । এছাড়াও তিনি প্রচুর ভ্রমণ সাহিত্য রচনা করেছিলেন । ' মহানগর ' নামে একটি মাসিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতেন । ১৯৮৮ সালে এই প্রখ্যাত সাহিত্যিকের জীবনাবসান হয় ।
(অষ্টম শ্রেণীর ভূগোল বিষয়ের প্রশ্ন উত্তর পড়তে ক্লিক করো)
👇
( প্রথম অধ্যায় পৃথিবীর অন্দরমহল )
সারসংক্ষেপঃ
সমরেশ বসু রচিত একটি অসাধারণ ছোটোগল্প ‘ আদাব ' । এটি একটি বিদায় সম্ভাষণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে । দেশ বিভাগের পটভূমিতে রচিত এই গল্পটির মূল ঘটনা হলো — সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে । শুরু হয়েছে ' রায়ট ' — প্রত্যক্ষ সংগ্রাম , ধর্মের নামে ধ্বনি দিতে দিতে দুটি সম্প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে একে অপরের উপর । এই পটভূমিতে রচিত আদার কাহিনিটি হৃদয় ছুঁয়ে যায় । নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটা পাক খেয়ে গেল । শহরে ১৪৪ ধারা আর কারফিউ অর্ডার জারি হয়েছে । দাঙ্গা বেঁধেছে হিন্দু আর মুসলমানে , মুখোমুখি লড়াই চলছে দা , সড়কি , ছুরি , লাঠি নিয়ে । তা ছাড়া চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে গুপ্তঘাতকের দল — চোরাগোপ্তা আঘাত হানছে তারা অন্ধকারকে আশ্রয় করে । বস্তিতে বস্তিতে জ্বলছে আগুন । মৃত্যুকাতর নারী ও শিশুর চিৎকার আবহাওয়াকে বীভৎস করে তুলেছে । তার উপর ঝাপিয়ে পড়ছে সৈন্যবাহী গাড়ি । আইন - শৃঙ্খলা বজায় রাখার নামে তারা গুলি ছুঁড়ছে দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে । জীবনের কি ট্র্যাজেডি ? দুটি গলি দুদিক থেকে এসে যেখানে মিশেছে , সেখানে ভাঙাচোরা এক ডাস্টবিন উল্টে পড়েছে ।
তার দুই পাশে আশ্রয় নিয়েছে দুটি বিপরীত শ্রেণির মানুষ । ডাস্টবিন নড়তেই দুটি প্রাণী নিশ্চল , দুজনের মধ্যেই প্রশ্ন কে ও ? অবশেষে ভয় সন্দেহের দোলাচল থাকলেও জাতি ধর্মের পরিচয় না দিলেও বোঝা গেল একজন সুতাকলের শ্রমিক , অন্যজন মাঝি , নাও বাওয়া তার কাজ । দুজনের বাড়ি বুড়িগঙ্গার হেই পারে । একজনের সুবইডায় অন্যজনের চাষাড়া নারাইণগঞ্জের কাছে । আতঙ্ক আর সন্দেহের পরিবেশ নিয়ে একে অপরের সাথে গড়ে ওঠে আলাপচারিতা । কথার মধ্যে মধ্যে ফুটে ওঠে আতঙ্ক । সুতাকলের মানুষটি ভাবে মাঝি তার দলবল ডেকে এনে মারবার ধান্দা করছে নাতো । কিন্তু দুজনেই একবারে সাধারণ মানুষ , দাঙ্গা - স্বাধীনতা রাজনীতি তাদের কাছে মূল্যহীন । মাঝি জানায় কাল যেমন করে হোক গ্রামে পৌঁছতে হবে । বিবি ছেলে - মেয়ে ইদের চাঁদ দেখেছে । তারা আশা করে বসে আছে বাপজান আসবে , নতুন পোশাক পাবে । তবু সন্দেহ যায় না । সুতাকলের শ্রমিক মাঝির পুঁটলিটা নেড়েচেড়ে দেখে । সুতামজুর কিছু খবরাখবর জানে , সে উয়কণ্ঠে জানায় - ‘ দোষ তো আমাগো ওই লিগওয়ালোগোরই মাঝি বলে ওসব জানি না । হ্যালয় মারামারি কাটাকাটি কইরা হইব কি ? দ্যাশের মানুষের কি উপকার হইব ।
এইসময় শোনা যায় ভারি বুটের শব্দ রাস্তা থেকে গলির দিকে এগিয়ে আসছে । পুলিশের হাতে মার খেতে কেউ রাজি নয় । বাদামতলির ঘাটে গিয়া উঠতে পারলেই তাদের ভর কমে । ভাগ্যকে সঙ্গে নিয়ে মাথা নীচু করে ঊর্ধ্বশ্বাসে তারা ছুটল সোজা এসে উঠল একেবারে পটুয়াটুলি রোডে । নিস্তব্ধ রাস্তায় ইলেকট্রিকের আলো ঝলমল করছে । চারিদিক দেখে শুনে নিয়ে তারা সোজা ছুটল পশ্চিম দিকে । অশ্বারোহী দেখে আবার দিয়ে ঢুকল পাশের গলিতে । সুতা মজুরের হাত ধরে মাঝি তাকে নিয়ে গেল একটা পানবিড়ির দোকানের আড়ালে । দেখাল ওই দিকে ইসলামপুরের ফাঁড়ি । ওর বাঁদিকের গলি দিয়ে গেলে বাদামতলির ঘাট । ঘাটে গিয়ে সুতা মজুরের লাভ হবে না এটা হিন্দুদের আস্তানা সে রাতটা এখানে কাটিয়ে যেন সকালে বাড়ির দিকে রওনা দেয় — আর তুমি ? সুতা মজুরের গলায় উদ্বেগ ঝরে পড়ে । আমি যাইগা , বাড়ির কি হইল আল্লাই জানে । আট দিনে বাড়ির খবর জানে না , নৌকা পেলে সে সাঁতরে পার হবে বুড়িগঙ্গা – কেমন করে যাবে ? যদি ধরইয়া ফেলায় ! না ভাই — আর থাকুম না - নসিবে থাকলে আবার মোলাকাত হবে— “ আদাব ” । শোনা যায় হলট্ শব্দ । ধক্ করে ওঠে সুতা মজুরের বুক । গুড়ুম গুড়ুম শব্দ করে নীলচে আগুনের ঝিলিক দেখা যায় । ডাকু মারার আনন্দে পুলিস ছুটে আসে । — আর সুতা মজুরের চোখে ভেসে ওঠে — মাঝির বুকের রক্তে তার পোলামাইয়ার ও বিবির শাড়ি - জামা রাঙা হয়ে উঠেছে পারলাম না ভাই , দুশমনেরা যেতে দিল না , তাগোর কাছে ।
নামকরণঃ
‘ ' আদাব ' — দেশ বিভাগের পটভূমিতে হিন্দু - মুসলমান - এর দাঙ্গার সময়ের ঘটনা অবলম্বনে রচিত । সাহিত্যের নামকরণ নানা ভাবে করা হয়ে থাকে । গল্পের বিষয়বস্তু অনুসারে , কখন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম অনুসারে । লেখক নিজেই এই গল্পের নামকরণ করেছেন “ আদাব ” –এখন আলোচনা করে দেখা যেতে পারে এই নামকরণ কতটা সার্থক হয়েছে । আদাব এখানে বিদায় সম্ভাবণ হিসাবে ব্যবহার হয়েছে । গল্পটি একটি রাজনৈতিক , সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত । দেশ বিভাগের বিষবাষ্প চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে — বাড়ছে মুখোমুখি লড়াই । বন্যজন্তুর মতো কেবল ধর্মের জিগির তুলে একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে । হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এই কাহিনিটি লেখক সুনিপুণ কৌশলে পাঠক সমাজে হাজির করেছেন । গল্পের মাঝে উঠে এসেছে দাঙ্গার ভয়াবহতা । গল্পের শেষে দেখা যায় যে দাঙ্গার আতঙ্ক , সন্দেহ সরিয়ে রেখে দুটো মানুষ মানসিকভাবে যখন মিলিত হয়েছে , ঠিক যখনই আদাব ধ্বনির মধ্যে দিয়ে তারা বিদায় নিচ্ছে । লেখক তখনই তাদের একজনের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু ঘটিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন । ' আদাব ' সেই দুটি মানুষেরই ভালোবাসা বিনিময়ের এক সূত্র । কেউ তাদের মূল্য দেয়নি । তারা নিজেরা তাদের মানবিকতাকে সম্মান জানিয়েছে । লেখক সাধারণ বিষয়কে এক মানবিক পর্যায়ে উন্নীত করে পরিবেশন করায় ' আদাব ' নামকরণটি সার্থক হয়েছে বলা যায় ।
১.১ সমরেশ বসুর ছদ্মনাম কী ?
উঃ । ১.১ সমরেশ বসুর ছদ্মনাম ‘ কালকূট ’ ।
১.২ তাঁর লেখা দুটি উপন্যাসের নাম লেখো ।
উঃ । তাঁর লেখা দুটি উপন্যাসের নাম ‘ বি টি রোডের ধারে ’ , ‘ গঙ্গা ।
২. নীচের প্রশ্নগুলির একটি বাক্যে উত্তর দাও :
২.১ কোন্ সময়পর্বের কথা গল্পে রয়েছে ?
উঃ । গল্পের বর্ণিত সময়কালটি হলো স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দের সময় ।
২.২ ' ডাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী ’ — প্রাণীদুটির পরিচয় দাও ।
উঃ । ডাস্টবিনের দুই পাশে দুটিমানুষের একজন সুতাকলের মজুর সে জাতিতে হিন্দু , আর একজন নৌকার মাঝি জাতিতে মুসলমান । দুজনেই ছিল দাঙ্গাপীড়িত ।
২.৩ ' ওইটার মধ্যে কী আছে ? ' — বক্তা কীসের প্রতি ইঙ্গিত করে ?
উঃ । মাঝির হাতে একটি জামা - কাপড়ে ভরা পুঁটলি ছিল । বস্তুা তার প্রতি ইঙ্গিত করেছে ।
২.৪ গল্পে কোন্ নদীর প্রসঙ্গ রয়েছে ?
উঃ । গল্পে বুড়িগঙ্গা নদীর প্রসঙ্গ রয়েছে ।
২.৫ সুতা - মজুরের ঠোটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠল ...'— তার এই হাসির কারণ কী ?
উঃ । সুতা - মজুর মাঝির ঘরে ফেরার দৃশ্যের কথা ভেবে হেসেছিল । সে ভেবেছিল মাঝি ঘরে ফিরলে তার বিবি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলবে মরণের মুখ থেকে তুমি ফিরে এসেছ । তার ছেলেমেয়েরা নতুন আশা নিয়ে নতুন জামা পরবে ।
৩. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় দাও ঃ
৩.১ শহরে ১৪৪ ধারা আর কারফিউ অর্ডার জারী হয়েছে ।'— লেখকের অনুসরণে গল্পঘটনার রাতের দৃশ্য বর্ণনা করো ।
উঃ । ‘ আদাব ’ গল্পের শুরুতে দাঙ্গা কবলিত একরাত্রির ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । রাজির নিস্তব্ধতা কে কাঁপিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়ি একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে পাক খেয়ে গেল । হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধেছে । লুটেরা - রা বেরিয়েছে অভিযানে । অন্যদিকে গুপ্তঘাতকের দলও শানিত অস্ত্র হাতে পথে নেমেছে । বস্তিতে বস্তিতে জ্বলছে আগুন । মৃত্যুকাতর নারী ও শিশুর চিৎকার আবহাওয়াকে বীভৎস করে তুলেছে । তার উপর ঝাপিয়ে পড়ছে সৈন্যবাহী গাড়ি । তারা আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দিক্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে গুলি ছুঁড়ছে ।
৩.২ “ হঠাৎ ডাস্টবিনটা একটু নড়ে উঠল । ” — ‘ ডাস্টবিন নড়ে ওঠা’র অব্যবহিত পরে কী দেখা গেল ?
উঃ । দেখা গেল নড়ে ওঠা ডাস্টবিনের দুইপাশে দুটি মানুষ অসহায় , প্রাণভয়ে ভীত , দুচোখে সন্দেহের দোলা , তার একজন হিন্দু – অন্যজন মুসলমান । উৎকণ্ঠায় তাদের চোখে ভয় , সন্দেহ মিলেমিশে আছে ।
৩.৩ হিন্দু - মুসলমান সম্প্রীতির আবহ গল্পে কীভাবে রচিত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করো ।
উঃ । সমরেশ বসু রচিত ‘ আদাব ’ গল্পটি স্বাধীনতার পূর্বের দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতা শহরের এক চিত্র । ভয়ংকর দাঙ্গা , খুন - আতঙ্ক - আর্ত চিৎকার— এইরকম পরিবেশে দুটি আতঙ্কিত প্রাণ একজান সুতা - মজুর ও অন্যজন নাওয়ের মাঝি একটি ভেঙে পড়া ডাস্টবিনের পাশে আশ্রয় নিয়েছে । সন্দেহের দোলায় দুলতে দুলতে একসময় তারা পরস্পরের কাছাকাছি আসে আর আতঙ্ক ভুলে একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে । দুই জাতির মানুষ একে অপরের জীবনের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে । মাঝি চলে যেতে চাইলে সুতা মজুর তাকে ধরে রাখতে চায় ।
তারা কেউ দাঙ্গা চায়না । মাঝি ইদের পরবে বাড়ি যেতে উদ্গ্রীব , ছেলে মেয়েরা বাবার ফেরার পথ চেয়ে বসে আছে । আটদিন ঘরের কোনো খবর নেই । দুজনে কোনক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে ইসলামপুর ফাঁড়ির কাছে আসে । মাঝি সুতা - মজুরকে বলে , তুমি ফেরির ঘাটের দিকে যেওনা ওদিকটা মুসলমান এরিয়া , এদিকে হিন্দুর বাস বেশি । রাতটা কোনক্রমে কাটিয়ে সকালে বাড়ি চলে যেও । মাঝি বিদায় নিলে সুতা - মজুর ভগবানের কাছে করুণাভিক্ষা করে — ভগবান তুমি মাঝিকে বাঁচিয়ে দাও । সে যেন বিবি - সন্তানের কাছে পৌঁছাতে পারে । গুলির আওয়াজ ও আর্ত চিৎকারে তার মনে ভেসে আসে রক্তে মাঝির পোলা মাইয়া ও বিবির জমা - শাড়ি রাঙা হয়ে উঠেছে , আর মাঝি বলছে দুশমনেরা আমাদের যাইতে দিল না — তাঁর মন ভারি হয়ে আসে । গল্পের শেষে পুলিশের গুলিতে মাঝির মৃত্যু হলেও একে অপরের প্রতি বিশ্বাস , মানবিকতা গল্পের মধ্যে ঘটা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্খার মাঝেও এক সম্প্রীতির পরিবেশ রচিত করে ।
৩.৪ ‘ মুহূর্তগুলিও কাটে যেন মৃত্যুর প্রতীক্ষার মতো ।'— সেই রুশ উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলির ছবি গল্পে কীভাবে ধরা পড়েছে তা দৃষ্টান্তসহ আলোচনা করো ।
উঃ । দাঙ্গায় বিধ্বস্ত শহর কলকাতার এক বীভৎস চিত্র লেখক সমরেশ বসু তাঁর আদাব গল্পে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । সময় ও পরিবেশ যে ভয়াবহতা নিয়ে এসেছে তার সঙ্গে মৃত্যুর তুলনা চলে । সেখানে ডাস্টবিনের দুপাশে প্রাণভয়ে ভীত দুটি মানুষ । বিপদের মধ্যে থেকেও সুতা মজুর ও নাওয়ের মাঝির মধ্যে নির্ভরতা গড়ে ওঠে । কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না । হঠাৎ করে শোরগোলটা মিলিয়ে যায় দূরে — মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধ হয়ে আসে সব । মুহূর্তগুলিও কাটে যেন প্রতীক্ষার মতো । নিস্তব্ধতার মাঝে দেশলাই জ্বলে ওঠার পর ‘ সোহান আল্লা ' শব্দটি এক উত্তেজক মুহূর্ত তৈরি করে । সুতা মজুর ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে । আবার মাঝি মুসলমান জেনে সুতা মজুর যখন মাঝির পুঁটলিটিতে কী আছে প্রশ্ন করে তখন উত্তেজনা দানা বেঁধে ওঠে । অন্ধকার গলির মধ্যে ডাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী ভাবে নিজেদের বিপদের কথা , ঘরের কথা , মা - বউ - ছেলেমেয়েদের কথা তাদের কাছে কি আর তারা প্রাণ ১৬১ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে , না তারাই থাকবে বেঁচে ? কোথা থেকে এল দাঙ্গা ? হাটে বাজারে এত কথা — দোকানে এত হাসাহাসি , কথা কওয়া কওরি — আবার পরমুহূর্তেই মারামারি , কাটাকাটি — রক্তগঙ্গা বয়ে গেল । এমনভাবে মানুষ নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে কী করে ? সুতা - মজুর ও মাঝির দুজনেই এক দীর্ঘশ্বাস পড়ে । নিঃশব্দ ও শ্বাসরুদ্ধ করে বসে থাকার এই চিত্র যেন বেঁচে থাকবার জন্য নয় তা যেন মৃত্যুর প্রতীক্ষার মতো ভয়ংকর ।
৩.৫ এমনভাবে মানুষ নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে কী করে ? ' — উদ্ধৃতিটির আলোকে সেই সময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি আলোচনা করো ।
উঃ । উপরের উদ্ধৃতিটি সমরেশ বসু রচিত ' আদাব ' গল্পটি থেকে নেওয়া । ভারতবর্ষে দাঙ্গার ইতিহাসকে ফিরে দেখলে দেখা যাবে দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও যখন সফল হতে পারছে না , সেই সময় তারা বিভেদ নীতির প্রয়োগ করে দেশের দুই প্রধান শক্তি হিন্দু ও মুসলমানকে রাজনৈতিকভাবে লড়িয়ে দিয়ে জনগণের ঐক্য ও সংহতি ভেঙে দিতে চায় । এর পরিণতি রূপে দেশে সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকে মানুষ নেমে পড়ে মারণযজ্ঞে । এই যজ্ঞে বলি হয় নিরীহ সাধারণ মানুষ , দাবি ওঠে দেশভাগের । শহরে জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা , আর কারফিউ অর্ডার । মুখোমুখি লড়াই চলে দা , সড়কি , ছুরি , লাঠি নিয়ে । তাছাড়া চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে দাঙ্গাবাজ ও গুপ্ত ঘাতকদের দল , তারা চোরাগোপ্তা আঘাত হানে অন্ধকারকে কেন্দ্র করে । এই নারকীয় হত্যালীলা থেকে নারী , বৃদ্ধ , বৃদ্ধা , শিশু কেউ বাদ পড়েনি । এই হানাহানির প্রেক্ষাপটেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত স্বাধীন হয় ।
৪. নিম্নলিখিত বাক্যগুলির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো :
৪.১ ' রাত্রির নিস্তবন্ধতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে পাক খেয়ে গেল । '
উঃ । সমরেশ বসু রচিত ' আদাব ' গল্পের অংশ এটি ।
প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকে দেশ জুড়ে শুরু হয়ে লড়াই - ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করতে হবে দেশকে – দা , সড়কি ও লাঠি ছুরি - গুলি বন্দুক নিয়ে লড়াইতে নেমে পড়ে মানুষ , মুখে তাদের “ আন্না হা আকবর ” আর ' বন্দে মাতরম্ ' ধ্বনি । নির্বিচারে নারী - শিশু , বৃদ্ধ - বৃদ্ধা বা তরুণ যুবক সবাই এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার । তাই আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে , রাত্রির নিঝুগ্ধতাকে বাঁপিয়ে দিয়ে মিলিটারি গাড়ি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে — যেটি ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ নিয়ে একটা পাক খেয়ে চলে যায় ।
৪.২ ' ডাস্টবিনের দুই পাশে দুটি প্রাণী , নিম্পদ , নিশ্চল । '
উঃ । উপরের উদ্ধৃতিটি সমরেশ বসু রচিত ' আদাব ' গল্পের অংশ । দেশ বিভাগের দাবিতে ১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে শুরু হয়েছে মুখোমুখি সংগ্রাম — সেই ভয়কের লড়াইব্রের ফাঁদে পড়েছে বিপরীত ধর্মীর ও গোষ্ঠীর দুটি মানুষ । আশ্রয় নিয়ে ডাস্টবিনের ধারে দুজনে ভয়ে নিশ্চল ও নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে । বাইরের শব্দ তাদের আতঙ্কিত করে তুলছে । ভয়ানক কিছু একটার প্রতীক্ষায় রয়েছে তারা । চরম অবিশ্বাস ও সন্দেহ নিয়ে তারা পরস্পরের অস্তিত্ব অনুভব করে । একজন হিন্দু মৃতা - কলের মজুর ও অপরজন মুসলমান মাঝি ।
৪.৩ স্থান - কাল তুলে রাগে - দুঃখে মাঝি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে ।
উঃ । সমরেশ বসু রচিত ' আদাব ' গল্প থেকে উপরের অংশটি নেওয়া হয়েছে । ভয়ংকর দাঙ্গার মুখোমুখি হয়ে মানুষ মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে । মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে ডাস্টবিনের ধারে আশ্রয় নিয়েছে এক হিন্দু মজুর আর একজন মুসলমান মাঝি।ত্যিকেই নিজেদের পরিচয় দিতে সে ' সোহান আল্লা ' পারস্পরিক ভয় পেয়েছে । কিন্তু বিড়ি ধরাতে গিয়ে দেশলাই কাঠি জ্বালতেই মাঝির মুখ দিয়ে বেরিে অবিশ্বাস এর বাতাবরনে দুজনের দুই জোড়া চোখ অবিশ্বাসে উত্তেজনায় আবার বড়ো বড়ো হয়ে ওঠে । তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারেনি । মাঝি তার মাঝেই চলে যেতে চার আর সুতা - মজুর তাকে যেতে দিতে চায় না । মাঝিরা জেদ দেখে সুতা মজুরের মনে হয় , খুন করার জন্য সে বোধহয় দলবল ডেকে আনতে যাচ্ছে । তাই স্থানকাল ভুলে মাঝি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে প্রতিবাদ করেছে ।
৪.৪ ‘ অন্ধকারের মধ্যে দুজোড়া চোখ অবিশ্বাসে উত্তেজনায় আবার বড়ো বড়ো হয়ে উঠল ।
উঃ । সমরেশ বসু রচিত ‘ আদাব ’ গল্প থেকে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে । দাঙ্গার পরিবেশে শহরের গলিপথে এক আতঙ্কতার মাঝে ডাস্টবিনের পাশে আশ্রয় নেওয়া । মাঝি ও সুতা মজুর দুজনের মধ্যেই প্রবল অবিশ্বাস সৃষ্টি হয় । তারা দুজনেই একে অপরকে খুনি ভাবে । অথচ স্পষ্ট করে কেউ কারোর পরিচয় চায় না । এই পরিস্থিতিতে সুতা - মজুর মাঝিকে একটা বিড়ি দেয় । কিন্তু ভিজে দেশলাই জ্বালাবার সময় মাঝির মুখ দিয়ে ‘ সোহান আল্লা ’ কথাটি বেরিয়ে আসতেই সুতা মজুর বুঝতে পারে মাঝি মুসলমান । সে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে । তার চোখে নেমে আসে অবিশ্বাসের ছায়া । তাই অন্ধকারের মধ্যে সুতা - মজুরের দুজোড়া চোখ অবিশ্বাস ও উত্তেজনায় যেন বড়ো হয়ে ওঠে । ..
৪.৫ ‘ সুতো - মজুরের বুকের মধ্যে টনটন করে ওঠে ।
উঃ । সমরেশ বসু রচিত ' আদাব ' গল্পের অংশ এটি । দাঙ্গা হাঙ্গামাজনিত পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি হয়েছে । চারিদিকের পরিস্থিতি অশান্ত । এই অবস্থায় ডাস্টবিনের দুই ধারে আশ্রয় নিয়েছে ভিন্নধর্মী দুটি মানুষ । অনেক অবিশ্বাস ও সন্দেহের পথ পেরিয়ে 60 তারা চলে আসে পাশাপাশি , কাছাকাছি । প্রথমে তাদের মনে অবিশ্বাস ও ভয় ছায়া ফেললেও পরে বুঝেছে তারা কেউ কারোর শত্রু নয় । দুজনেরই পরিবার আছে । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাদের রুজি রোজগার কেড়ে নিয়েছে । ধীরে ধীরে তারা একে অপরের সহমর্মী হয়ে ওঠে । তাই মাঝি যখন তার বউ ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য উতলা হয়ে উঠল তখন সুতা - মজুর তাকে যেতে দিতে না চাইলে সে বলে বলে ঘরে তার ছেলেমেয়েরা আশা করে আছে । কাল ঈদের দিনে তারা বাপজানের কোলে চড়বে । তাঁর দুঃখে সুতা - মজুরের বুকও টন টন করে উঠল ।
৪.৬ ‘ ভুলুম না ভাই এই রাত্রের কথা ।
উঃ । এই অংশটি সমরেশ বসু রচিত ‘ আদাব ’ গল্পের অংশ । ডাস্টবিনের দুই পাশে আশ্রয় নিয়েছে মাঝি এবং সুতা - মজুর । অনেক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের পথ পেরিয়ে তারা কাছাকাছি আসে । কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না । কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্য মাঝি বড়োই উতলা । ঈদের পরবে স্ত্রী - পুত্রের কাছে পৌঁছানো বড়ো জরুরি । মাঝি আট দিন ঘর ছাড়া । বাদামতলিতে তার নাও কেউ ডুবিয়ে দিয়েছে । বাড়ির খবরও তার কিছুই জানা নেই । কিন্তু ১৪৪ ধারা ও কারফিউর মধ্যে যে সাংঘাতিক সময় ও পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখা যায় পরবর্তীক্ষেত্রে কিন্তু তাদের মধ্যে এক বিপরীত স্রোত জেগে ওঠে । একে অপরের প্রতি সহানুভূতির ও ভালোবাসার জন্ম হয় । যাবার আগে মাঝি সুতা - মজুরকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বলে ‘ আদাব ' । সুতা মজুরের সঙ্গে যে সময় সে কাটিয়েছে তা সে কোনদিনও ভুলবে না বলে মাঝি জানায় ।
No comments:
Post a Comment