ইতিহাস
প্রশ্ন উত্তর
অষ্টম অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর পড়তে নিচের লিঙ্ক এ ক্লিক করো
👉 ( অষ্টম অধ্যায় )
ভূমিকা : মধ্যযুগীয় সমগ্র সুলতানি ও মুঘল যুগের ইতিহাসে সামাজিক ধর্মীয়, অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভাষা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির অগ্রগতি এক অসাধারণ নজির। এইসময় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার পরিমাপ ছিল খুবই সাধারণ। বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে বাস করত ও কৃষিকাজ করত। আঙুর, খেজুর, জাম, কলা, কাঁঠাল, নানারকম ফুল, চন্দনকাঠ, ঘৃতকুমারী ইত্যাদি নানা ভেষজ উদ্ভিদ ও নানা প্রকার মশলা ছিল উৎপাদিত পণ্য, এই সময় কারিগরী শিল্প গড়ে ওঠে। বিনোদনের অঙ্গ হিসেবে খেলাধুলা, কুস্তি, তীরধনুক, বর্ষা ছোড়া ও সাঁতার জনপ্রিয় ছিল।
এইসময় ভারতে ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভক্তিবাদ ও সুফিবাদ দেখা দেয়। ভক্তিবাদের মূল কথা ছিল ভগবানের প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি। এতে ভগবানের প্রতি পুরোপুরি আত্মসমর্পণ ও ঈশ্বরলাভের জন্য জ্ঞান বা যোগ ছেড়ে ভক্তের ভক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। নামদেব, তুকারাম, রামানন্দ, মীরাবাঈ, তিলক, কবীর প্রমুখ ছিলেন ভক্তিবাদী সমর্থক। ষোড়শ শতকে শ্রী চৈতন্যদেবের বৈয়ব ভক্তিবাদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আন্দোলনের জোয়ার বহন করে আনে। নবদ্বীপ ছিল ভক্তিবাদের প্রাণকেন্দ্র।
খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকে ধর্মীয় আইন কানুনের বাইরে সুফি সন্তদের নির্দেশিত পথে মুসলমানরা ঈশ্বরকে নিজের মতো করে আরাধনা করতে অগ্রসর হন, যা সুফিবাদ নামে পরিচিত। সুফিরা চিশতি ও সুহরাবর্দি এই দুইভাগে বিভক্ত ছিল।
সুলতানি আমলে স্থাপত্যভাস্কর্যের অসামান্য নিদর্শন হলো কুতুবমিনার, ইলতুৎমিসের সমাধি, আলাউদ্দিনের আলাই দরওয়াজা, দৌলতাবাদ প্রভৃতি। স্থাপত্যশিল্পের ব্যাপারে পরিবর্তন সাধিত হয় মুঘল আমলে। বিভিন্ন সুন্দর বাগান নির্মান আজমেরগড়ে, লাহোরগড়, এলাহাবাদগড়, ফতেপুর সিক্রি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শাহজাহানের সময়ের তাজমহল, লালকেল্লা, জামা মসজিদ, আগ্রার দুর্গ প্রভৃতি অত্যন্ত স্মরণীয় স্থাপত্যকীর্তি।
সুলতানি ও মুঘল আমলে সংগীতচর্চা ও নৃত্যশিল্পেরও চর্চা হতো। সংগীতপ্রেমী আকবরের দরবারে গুণী সংগীতজ্ঞরাও ছিলেন যাদের মধ্যে অন্যতম তানসেন। এইসময় মণিপুরী নৃত্যশিল্প জনপ্রিয় রূপ পায়। সুলতানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবি ও ফারসি ভাষার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। সে সময় ফারসি সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমির খসরু।
বাংলা প্রশ্ন উত্তর পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করো
■ দু-এক কথায় উত্তর দাও :
১। ভক্তিবাদের মূল কথা কী ?
উত্তর। ভক্তিবাদের মূল কথা হল ভগবানের প্রতি ভক্তি।
২। গুরু গ্রন্থসাহেব কোন্ লিপিতে লেখা?
উত্তর। গুরু গ্রন্থসাহেব গুরুমুখি বা গুরমুখি লিপিতে লেখা।
৩। কবীর কার শিষ্য ছিলেন ?
উত্তর। কবীর রামানন্দের শিষ্য ছিলেন।
৪। দোহা কী ?
উত্তর। কবীরের দুই পক্তির কবিতা গুলিকে দোহা বলে।
৫। সুফিদের আশ্রমকে কী বলে?
উত্তর। সুফিদের আশ্রমকে দরগা বলা হয়।
৬। সুফিবাদে গুরুকে ও শিষ্যকে কী বলা হয় ?
উত্তর। সুফিবাদে গুরুকে পির শিষ্যকে মুরিদ বলা হয়।
৭। মধ্য যুগের কয়েকটি শিল্পের নাম লেখো।
উত্তর। এই সময়কালে চিনি শিল্প, সুগন্ধি আতর শিল্প, বস্ত্র শিল্প, ধতু শিল্প, কাগজ শিল্প প্রভৃতি গড়ে ওঠে।
৮। ভক্তি আন্দোলনের কয়েকজন সাধক-সাধিকার নাম লেখো।
উত্তর। নামদেব, জ্ঞানেশ্বর, তুকারাম, রামানন্দ, কবির, নানক, চৈতন্যদেব, মীরাবাঈ প্রমুখ।
৯। শিখ ধর্মের পবিত্র বাণীগুলি কোন্ ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে?
উত্তর। গুরুগ্রন্থ সাহেব-এ।
১০। মীরাবাঈ রচিত একটি ভক্তিগীতির অর্থ লেখো।
উত্তর। আমার প্রভু গিরিধর গোপাল ছাড়া আর কেউ নয়। যাঁর শিরে (মাথায়) ময়ূরের পাখার মুকুট তিনিই যে আমার পতি।
১১। সুফি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব কোথায় হয়েছিল?
উত্তর। মধ্য এশিয়ায় ।
১২। সুফি কথাটির অর্থ কী ?
উত্তর। সুফি কথাটি এসেছে 'সুফ' শব্দ থেকে। আরবি ভাষায় সুফি কথার অর্থ উলের তৈরি এক টুকরো কাপড়।
১৩। ভারতে চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার নাম কী?
উত্তর। মইনউদ্দিন চিশতি।
১৪। চিশতি সম্প্রদায়ের অন্যতম সাধক-এর নাম লেখো।
উত্তর। শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া বা বখতিয়ার কাফি। ১৫। শ্রীচৈতন্যদেবের বৈয়ববাদী ভক্তি আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র কোথায় ছিল? উত্তর। নবদ্বীপ।
১৬। কৃয়দাস কবিরাজ চৈতন্যদেবের সম্পর্কে লেখা বইটির নাম কী?
উত্তর। ‘চৈতন্য চরিতামৃত'।
১৭। কত খ্রিস্টাব্দে কে কুতুবমিনার তৈরি শুরু করেন ?
উত্তর। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক এটি তৈরি শুরু করেন।
১৮। 'চার মিনার' স্থাপত্যটি কোথায় অবস্থিত ?
উত্তর। হায়দরাবাদে।
১৯। মুঘল আমলে কয়েকজন চিত্রশিল্পীর নাম লেখো।
উত্তর। পারস্যের মীর সইদ আলি, খোয়াজা আবদুল সামাদ, দসবন্ত বসওয়ান প্রমুখ।
■ অতি-সংক্ষিপ্ত / সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর :
১। গুরু নানক কে ছিলেন?
উত্তর। গুরু নানক ছিলেন মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা। তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে এক করে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সকল ধর্মের মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার কথা বলেছেন। তাঁর সময়কালেই শুরু হয় লঙ্গরখানা বা একসাথে সমস্ত ধর্মের মানুষের খেতে বসার প্রথা। গুরু নানক কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে যাননি। তবে তাঁর প্রচলিত বাণী ও মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে শিখ ধর্ম। তার বাণীগুলি শিখগ্রন্থে উল্লেখিত আছে।
২। বখতিয়ার কাকি কে ছিলেন?
উত্তর। শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া বা বখতিয়ার কাকি ছিলেন সুফি আন্দোলনের অন্যতম প্রচারক। তিনি ছিলেন চিশতি সুফি সম্প্রদায়ের একজন নেতা। বখতিয়ার কাকি দিল্লিতে চিশতি সিলসিলার সুফিদের জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। বখতিয়ার কাফির ধর্ম পরিচালনায় সুহরাবর্দি সম্প্রদায়রা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি অ-ইসলামীয় আচার-আচরণ পালন করতেন। তিনি খোলামেলা জীবনযাপনেই বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি প্রচার করেন ধর্ম, অর্থ, ক্ষমতার দ্বারা মানুষকে বিচার করা উচিত নয়। তার এই মতবাদ তাকে সুফি আন্দোলনের একজন মহান সাধক করে তুলেছিল।
৩। আমির খসরু কে ছিলেন ?
উত্তর ৷ দিল্লি সুলতানি আমলে আমির খসরু তাঁর সংগীত প্রতিভার জন্য মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসে তোতাপাখি নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন সুলতানি আমলে সংগীতের এক বিখ্যাত সম্প্রদায়। তিনি তার সংগীত ভাবনায় ভারতীয় বা হিন্দুস্থানি এবং ইরানি সংগীতের মিলন ঘটিয়ে ছিলেন। দিল্লি সুলতানি রাজসভায় বা সুফি পীর সমস্ত ক্ষেত্রেই খসরুর জনপ্রিয়তা ছিল সর্বত্রই। আমির খসরু কর্ণাটকী সংগীত শিল্পীদের থেকে ভারতের প্রাচীন সংগীত চর্চার বৈশিষ্ট্য ও ব্যাকরণ শিখেছিলেন। শাস্ত্রীয় সংগীত বিষয়ে তার অনেক রচনা আমরা ইতিহাসে পাই। খেয়াল, তরানা, বাওয়ালি প্রভৃতি সংগীতরীতি আমির খসরুরই সৃষ্টি। এমনকি মনে করা হত সেতার, তবলা, পাখোয়াজ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রগুলি তারই বানানো। আমির খসরু অনেক গজল ও গীতিকাব্যও লিখেছিলেন।
◾ সংক্ষেপে (৩০-৫০টি শব্দের মধ্যে) উত্তর দাও (পূর্ণমান-৩) :
(ক) সুলতানি ও মুঘল যুগে ভারতে কোন কোন ফল, সবজি, শস্যের চাষ সবচেয়ে বেশি হত ?
উত্তর। সুলতানি ও মুঘল আমলে কৃষি ব্যবস্থা ছিল অর্থনীতির অন্যতম অঙ্গ। তাই এই সময়ে কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখা দেয়। এই সময়কালে আঙুর, খেজুর, জাম, কলা, কাঁঠাল, নারকেল প্রভৃতি ফলের চাষ ছিল প্রধান। সবজির মধ্যে বেশি পরিমাণে হত বিভিন্ন প্রকার শাক, লংকা, আদা, ইত্যাদি। সুলতানি ও মুঘল আমলে খারিফ ও রবি শস্য উভয় প্রকার শস্যের চাষই হত। উৎপন্ন শস্যের মধ্যে প্রধান ছিল ডাল, গম, যব, চাল, তিল, তৈলবীজ, জোয়ার, ইক্ষু, তুলা, . তামাক, রেশম প্রভৃতি।
(খ) মধ্য যুগের ভারতে ভক্তি সাধক সাধিকা কারা ছিলেন?
উত্তর। ভক্তিবাদের মূলে ছিল ভগবানের প্রতি ভক্তের ভালোবাসা বা ভক্তি। এই ভক্তির দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল। একটি হল ভগবানের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করা। অন্যটি হল ঈশ্বরলাভের জন্য জ্ঞান বা যোগ ছেড়ে ভক্তের ভক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া। দক্ষিণ ভারতের অলকার ও নয়নার সাধকদের দ্বারা সূচিত ভক্তিবাদ পরবর্তী খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে উত্তর ভারতে জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। উত্তর ভারতে ভক্তি আন্দোলনের সাধক-সাধিকা হলেন—নামদেব, জ্ঞানেশ্বর, তুকারাম, রামানন্দ, কবির, নানক, চৈতন্যদেব, মীরাবাঈ প্রমুখ। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে এদের লেখা, কথা, গান ও কবিতা জনপ্রিয় হয়ে পড়ে।
(গ) সিলসিলা কাকে বলে? চিশতি সুফিদের জীবনযাপন কেমন ছিল?
উত্তর। সুফিবাদের প্রচারকারী সম্প্রদায়গুলিকেই সিলসিলা বলা হত। সুফি আন্দোলনের প্রথম যুগে এই সিলসিলা বা সম্প্রদায়গুলি এই আন্দোলনকে দিয়েছিল স্থিতিশীলতা, রক্ষণশীলদের আক্রমণ প্রতিরোধের শক্তি এবং আধ্যাত্মিক প্রচার বিস্তারের সুযোগ।
চিশতি সুফিদের জীবন ছিল খোলামেলা। তারা ধর্ম আর ক্ষমতার মাপকাঠিতে মানুষকে বিচার করত না। চিশতি সুফিরা রাজনীতি ও রাজ-দরবারে থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে রাজ্য পরিচালনার কাজে জড়িয়ে পড়লে কোনোভাবেই ঈশ্বর সাধনা সম্ভব নয়। ভারতে চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মইনউদ্দিন চিশতি। শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়া বা বখতিয়ার কাফি ছিলেন এই গোষ্ঠী বা সিলসিলার অন্যতম সাধক।
(ঘ) দীন-ই-ইলাহি'র শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান কেমন ছিল ?
উত্তর। ১৫৮০ এর দশকের মাঝামাঝি আকবর দিন-ই-ইলাহি নামক নতুন মতাদর্শ চালু করেন। দীন-ই-ইলাহি আসলে ছিল আকবরের প্রতি চূড়ান্ত অনুগত কয়েকজন অভিজাতদের মধ্যে প্রচারিত এক আদর্শ। আকবর নিজে তাদের বেছে নিতেন। বেশ কিছু অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির মধ্যে দিয়ে তারা বাদশাহের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থাকার শপথ নিত। যিনি দীন-ই-ইলাহি গ্রহণ করতেন, তিনি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের শুরুতে তার জীবন (জ্ঞান), সম্পত্তি (মাল), ধর্ম (দিন) ও সম্মান (নামুস), বিসর্জন (কুরবান) দেওয়ার শপথ নিতেন। শিষ্যকে (মুরিদ) যেমন তার সুফি গুরুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে হত, তাঁকেও তেমনই বাদশাহের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে হত। এরপর অনুষ্ঠান শেষ হলে বাদশাহ তাকে দিতেন একটি নতুন পাগড়ি, সূর্যের একটি পদক ও পাগড়ির সামনে লাগাবার জন্য থাকে বাদশাহের নিজের একটি ছবি ও একটি মুক্ত।
(ঙ) স্থাপত্য হিসাবে আলাই দরওয়াজার বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর। আলাউদ্দিন খলজির আমলে তৈরি আলাই দরওয়াজা মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এটি ইন্দো ইসলামীয় স্থাপত্যশিল্পের অসাধারণ নমুনা, যেটি ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে যুগান্তর আনে। অবশ্যই দরওয়াজাটি লাল বেলেপাথরে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই দরওয়াজাটির গায়ে কোনো রূপ ধর্মীয় বাণী খোদাই করা ছিল না। এর গায়ে খোদাই ছিল সুলতানের প্রশংসা। যা ছিল সে যুগের নির্মাণশৈলীর মধ্যে বিরল।
(চ) ক্যালিগ্রাফি এবং মিনিয়েচার বলতে কী বোঝায় ?
উত্তর৷ ইংরাজি শব্দ ক্যালিগ্রাফি (calligraphy)-র বাংলা অর্থ হল হস্তলিপি বিদ্যা বা হস্তলিপি শিল্প। মধ্যযুগের ইতিহাসে ছাপাখানার রেওয়াজ আসেনি এবং তার অস্তিত্ব এই সময় ছিল না। তাই এই সময়ে সুন্দর হাতের লেখার শিল্প ভীষণ ভাবে চর্চা হত। এযুগে হাতে লেখা বইগুলিই ছিল শিল্পের নমুনা। অন্যদিকে ইংরেজি শব্দ মিনিয়েচার (Miniature) কথাটার বাংলা অর্থ হল অনুচিত্র। সম্রাট আকবরের সময় তুতিনামা, রাজমনামা (মহাভারতের ফারসি অনুবাদ) প্রভৃতি বই-এর মিনিয়েচার দেখা যায়। বইগুলিতে অলংকরণের জন্য সোনার রং ও অন্যান্য রঙের ব্যবহার হত। ফলে জ্বলজ্বল করত পৃষ্ঠাগুলি। লেখার চারপাশে নানারকম অলংকরণ করা হত।
(ছ) শিবায়ন কী? এর থেকে বাংলার কৃষকের জীবনের কী পরিচয় পাওয়া যায় তা লেখো।
উত্তর। মঙ্গলকাব্যে শিবকে নিয়ে যে সাহিত্য লেখা হয়েছে সেই লেখাকেই শিবায়ন বলা হয়। পুরাণে শিব বিষয়ে যে কাহিনি বা গল্প তার সঙ্গে শিব-দুর্গার ঘর সংসারের কথা যুক্ত করে শিবায়ন কাব্য লিখিত হয়েছে। এই লেখাগুলিতে গরিব শিব-দুর্গার জীবন যাত্রার কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে। এই কাহিনি অনুসারে শিব চাষাবাদ করে রোজগার করে। তৎকালীন বাংলার চাষি-পরিবার যেন শিবদুর্গার পরিবারেরই প্রতিচ্ছবি। এর থেকে বাংলার কৃষকের সহজ সরল জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়।
(জ) কাগজ কোথায় আবিষ্কার হয়েছিল? মধ্যযুগের ভারতে কাগজের ব্যবহার কেমন ছিল?
উত্তর। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে চিনে প্রথম কাগজ আবিষ্কৃত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতে কাগজ তৈরি করার প্রযুক্তি চিন থেকে প্রথম নিয়ে আসে মধ্য এশিয়ার মঙ্গলরা; অল্প কিছু কালের মধ্যে ভারতে কাগজের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যযুগের লেখকরা তাদের বর্ণনা এই কাগজে তুলে রাখতেন যা গুরুত্বপূর্ণ নথিতে পরিণত হয়। এই সময় কাগজ লেখালেখির কাজেই ব্যবহৃত হতে থাকে। যার ফলে শিক্ষার প্রসার ঘটে। তবে চতুদর্শ শতক নাগাদ কাগজ এতটাই সস্তা হয়ে পড়েছিল। যে মিঠাই বিক্রেতারাও মিষ্টি দেবার জন্য কাগজ ব্যবহার করত। যা কাগজের বহুল অপচয় ঘটিয়েছিল।
◾ বিশদে (১০০-১২০টি শব্দের মধ্যে) উত্তর দাও (পূর্ণমান-৫) :
(ক) মধ্যযুগের ভারতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিল তা লেখো।
উত্তর। মধ্যযুগের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ গ্রামেই বাস করত। এদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। এরা সারা বছর পরিশ্রম করে ও শ্রম দিয়ে যে ফসল ফলাতো তার একটা মোটা অংশে ভাগ বসাত শাসক শ্রেণি। বদলে প্রশাসন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করত। কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভর করে গ্রামীণ সাধারণ মানুষ বিভিন্ন শিল্প এছাড়া বস্ত্রশিল্প, ধাতুর কাজ, পাথরের কাজ প্রভৃতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।
সাধারণ গরিব জনগণ বসতির জন্য সামান্য কিছু উপকরণ, যেমন— পাতকুয়া, ডোবা, ঘর করার জন্য খুঁটি ও চাল ছাইবার জন্য কিছু খড় পেলেই বসতি নির্মাণ করে নিত।
সরকারি খাজনা ও নানা পাওনা মিটিয়ে ফসলের কিছু অংশই কৃষকের বেঁচে থাকত যা ছিল তার রোজকারের ব্যবহারের সম্বল। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময়ে একজন ওলন্দাজ বণিক লিখেছিলেন যে, প্রধান খাবারই ছিল একঘেয়ে খিচুড়ি। তাই দিয়েই দিনের শেষে পরিশ্রমের পর তারা পেট ভরাত। পোশাক-পরিচ্ছদ যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না। একজোড়া খাটিয়া ও রান্নার দু-এক খানা বাসনই ছিল গৃহস্থালির সম্বল। বিছানার চাদর ছিল বড়ো জোর একটা বা দুটো যা পেতে তারা শুত ও গায়ে দেবার জন্য ব্যবহার করত। চরম শীতে ব্যবহারের মতো কোনো গরম কাপড় তাদের ছিল না। পালা-পার্বণে আনন্দ উৎসবই ছিল তাদের বিনোদনের একমাত্র অঙ্গ। যা ছিল এদের জীবনের কিছুটা ব্যতিক্রমী চিত্র।
(খ) কবিরের ভক্তি ভাবনায় কী ভাবে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল তা লেখো।
উত্তর। মধ্যযুগে ভারতে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সাধক ছিলেন কবির। তিনি ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা রামানন্দের শিষ্য ছিলেন। ইসলামের একেশ্বরবাদের সাথে বৈয়ব, নাথ, যোগী এবং তান্ত্রিক বিশ্বাস এসে মিলেছিল কবিরের চিন্তাভাবনায়। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে প্রচার করেছিলেন সব ধর্মই এক। সব ভগবানই এক। তার মতে রাম, হরি, আল্লাহ্ ইত্যাদি সবই ছিল একই ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম। মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ নেই। কবিরের এই ভক্তি দর্শন তখনকার সমাজে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও বিরোধ মেটাতে খুবই সফল হয়েছিল।
কবির মনে করতেন যে মানুষ তার ভক্তি দিয়ে নিজের মনেই ঈশ্বর খুঁজে পাবে। তার জন্য তাকে মন্দির মসজিদে গিয়ে মূর্তি পূজা বা গঙ্গা স্নান বা নামাজ পড়ার কোনো দরকার নেই। তখনকার সামাজিক জীবনে কবিরের ভাবাদর্শের গুরুত্ব অপরিসীম। কবির তাঁর দোহাগুলির মাধ্যমে ধর্মের বহু জটিল তত্ত্ব অনেক সহজ ও সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছিলেন। কবিরের একটি দোহায় লিখিত আছে যে— 'তিলের মধ্যে যেমন তেল আছে, চকমকি পাথরের মধ্যে যেমন আগুন আছে, তেমনি তোর ভগবান (সাঁই) তোর মধ্যে আছে। যদি ক্ষমতা থাকে তো জেগে ওঠ। কবিরের এই রূপ ভক্তিভাবনাই সকল ধর্মনির্বিশেষে মানুষকে এক করে দিয়েছিল।
(গ) বাংলায় বৈয়ব আন্দোলনের ফলাফল কী হয়েছিল বিশ্লেষণ করো।
উত্তর। কবির, নানক ও নামদেবের অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছাড়াও উত্তর ভারতে রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে ভক্তিবাদের তথা বৈয়ব ধর্মের বিকাশ হয়। বৈয়ব ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে চৈতন্যদেব ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। নগর সংকীর্তনের মাধ্যমে চৈতন্য ও তাঁর ভক্তরা হিন্দু, অহিন্দু, পণ্ডিত, মূর্খ, উচ্চনীচ নির্বিশেষে বৈয়ব ধর্মের প্রচার শুরু করেন। বাংলায় এই বৈয়ব আন্দোলনের ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী। এর ফলে ধর্মীয় ভেদাভেদ অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিল। তবে চৈতন্য ও তাঁর ভক্তি আন্দোলনের সবচেয়ে গভীর প্রভাব পড়েছিল বাংলার সংস্কৃতিতে। সাধারণ মানুষের বাংলা ভাষাকে সম্মান জানিয়ে সেই ভাষাতেই ভক্তি প্রচার করেন চৈতন্য। তার ফলে বাংলাভাষার বিকাশের পথ তৈরি হয়। চৈতন্যকে কেন্দ্র করেই বাংলা ভাষায় জীবনীসাহিত্য লেখার ধারা বিকশিত হয়েছিল। বহু মুসলমান কবি বৈয়ব গান কবিতা লেখেন।
বাংলা সাহিত্যের বিকাশে চৈতন্য ও তাঁর ভক্তি আন্দোলনের গভীর ছাপ রয়ে গেছে। রাধা-কৃয়কে নিয়ে পদ রচনা রা পদাবলি লেখার বিকাশ হয়। ভক্তির মাধ্যমেই চৈতন্য লাভ হয় এই মতবাদ বাংলায় বহুকাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।
(ঘ) বাদশাহ আকবরের দীন-ই-ইলাহি সম্বন্ধে একটি টীকা লেখো।
উত্তর: ভারতের ইতিহাসে আকবরের সবচেয়ে কালজয়ী অবদান হল উদার ও বিচক্ষণ ধর্মনীতি। তিনি ভারতে এক জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের রূপকার ছিলেন। ভারতের জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল ধর্মের সারবস্তু নিয়ে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দীন-ই-ইলাহি নামে এক একেশ্বরবাদী ধর্মমত প্রবর্তন করেন। এই ধর্মমত সুলতানি শাসকের প্রচলিত হিন্দু বিদ্বেষী নীতির পরিবর্তে সম্প্রীতি ও গ্রহণযোগ্যতার নীতি গ্রহণে সচেষ্ট হয়। এই ধর্ম নিরামিষ ভোজন, দান, সম্রাটের জন্য সম্মান, জীবন, সম্পত্তি ত্যাগের অধিকার প্রভৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
আকবরের সমকালীন ঐতিহাসিক বদাউনি দীন-ই-ইলাহিকে বাদশাহ আকবর প্রচলিত নতুন এক ধর্মমত বলে প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। কেন না আকবর কখনও ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেননি। ইসলাম ধর্মের নানা ব্যাখ্যার মধ্যে থেকে তিনি সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য মতটি মেনে নিতেন।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক মনে করেন যে দীন-ই-ইলাহি আসলে ছিল আকবরের প্রতি চূড়ান্ত অনুগত অভিজাতদের মধ্যে প্রচারিত এক আদর্শ। আকবর নিজে তাঁদের বেছে নিতেন। ফলে এই ধর্মমত দরবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যা জনগণের মনে কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। ফলে 'দীন-ই-ইলাহির উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল।
(ঙ) মুঘল সম্রাটদের আমলে বাগান তৈরি ও দুর্গ নির্মাণ সম্বন্ধে আলোচনা করো।
উত্তর। মুঘলরা ষোড়শ শতকে (বাবরের সময়কালে) ভারতে বাগান তৈরির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন এক কৌশল ব্যবহার করতে থাকে। ফারসিতে এর নাম 'চাহার বাগ'। হিন্দিতে চার ভাগ বলে। একটি বাগানকে জল দিয়ে চারটি সমান আয়তনের বর্গে ভাগ করা হত। তারপর গোটা বাগানটিতে নানারকম ফুল ফলের গাছ লাগিয়ে এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করা হতো। পারস্য ও মধ্য এশিয়া থেকে এই বাগানরীতি মুঘল সম্রাট বাবর ভারতে নিয়ে আসেন। মুঘল বাদশাহদের মধ্যে বাগান করার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহ রাখতেন বাবর, জাহাঙ্গির ও শাহাজাহান। লাহোরের শালিমার বাগ, কাশ্মীরের নিসাত বাগ, দিল্লিতে হুমায়ুনের সমাধি ও আগ্রাতে তাজমহলে এই 'চাহার বাগে'র নিদর্শন পাওয়া যায়।
মুঘল শাসকদের আমলে সাম্রাজ্যের সুরক্ষার কারণে দুর্গ শহর নির্মাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই দুর্গ নির্মাণের ফলে সাম্রাজ্যের সুরক্ষার পাশাপাশি স্থাপত্য শিল্পেরও বিকাশ ঘটেছিল। আগ্রা দুর্গ এর অন্যতম উদাহরণ। আজমের গড় লাহোর গড়, কাশ্মীরের ডাল হ্রদের গড়, এলাহাবাদ গড়গুলি আকবরের সময়কালে তৈরি হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহান তাঁর নতুন শহর শাহজাহানাবাদের সুরক্ষা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে লালকেল্লা দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন আগ্রা দুর্গের অনুকরণে।
(চ) মধ্যযুগের বাংলার স্থাপত্যরীতির মূল বৈশিষ্ট্য কী ছিল ?
উত্তর। মধ্যযুগ বাংলার স্থাপত্য শিল্পের অগ্রগতির যুগ। এই সময় বাংলার স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসকে তিনটি মূল পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায় (১২০১-১৩৩৯) : এই সময় বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। এই পর্যায়ের বেশিরভাগ স্থাপত্য প্রকৃতির রোষে নষ্ট হয়ে গেছে। একমাত্র ত্রিবেণীতে জাফর খানের সমাধির ভগ্নাবশেষ এবং বসিরহাটে ছড়িয়ে থাকা কিছু স্তূপের নিদর্শন মেলে। দ্বিতীয় পর্যায় (ইলিয়াসশাহি শাসন-১৩৩৯-১৪৪২) : বাংলার স্থাপত্যের এটি উজ্জ্বলময় যুগ। এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য হল পান্ডুয়ায় সিকান্দর শাহের বানানো আদিনা মসজিদ। এ ছাড়া ছোটো পাণ্ডুয়ার মিনার ও মসজিদ এবং গৌড়ের শেখ আলি সিরাজের সমাধি। তৃতীয় পর্যায় : বাংলার ইন্দো-ইসলামি রীতির উন্নতির যুগ। এই সময় পান্ডুয়ায় সুলতান জালালুদ্দিন মামুদ শাহের একনামি সমাধি বিখ্যাত, বরাবক শাহের আমলে তৈরি হয় গৌড়ের দাখিল দরওয়াজা (১৪৭৪ খ্রি.), ১৫২৬-এ তৈরি হয় বড়ো সোনা মসজিদ এবং ১৪৮৮ সালে ফিরুজ মিনার।
বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের সূচনা পর্বে ইসলামীয় রীতির সাথে বাংলার লৌকিক রীতির সংমিশ্রণে স্থাপত্য শিল্প গড়ে উঠতে দেখা যায়। বাড়ি ও বেশিরভাগ মন্দির ঢালু ধাঁচে তৈরি করা হত। এই বিশেষ নির্মাণ পদ্ধতি 'বাংলা' নামে পরিচিত। পুরানো অনেক মন্দিরের কাঠামো এই ধাঁচেই নির্মিত হত। এমনই দুটি কাঠামো পাশাপাশি নির্মিত হলে তাকে “জোড়-বাংলা” বলা হত। চাল বা চালাভিত্তিক মন্দির বানানোর রীতিও বাংলায় দেখা যায়। মন্দিরের মাথায় কটি চালা আছে, সে হিসাবেই মন্দিরগুলি এক চালা, কখনো দো-চালা, কখনো আটচালা হত। যেমন—বাঁকুড়ার রাসমত্রুটি ছিল— চার চালা। ইসলামীয় স্থাপত্য রীতির ধাঁচে চালাগুলির মাথায় মাঝে মধ্যেই খিলান, গম্বুজ বানানো হত। সাধারণ আয়তাকার কাঠামোর উপর একাধিক চূড়া দিয়ে মন্দির নির্মাণ করার রীতিও এই সময়কালে বাংলায় ছিল। এই বিশেষ স্থাপত্য 'রীতির নাম 'রত্ন'। পোড়ামাটির তৈরি এই মন্দিরগুলি বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর ও বাংলার নানা অঞ্চলে বহু পরিমাণে ছড়িয়ে আছে।
(ছ) মুঘল চিত্রশিল্পের উন্নতিতে মুঘল বাদশাহদের কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর। ভারতীয় চিত্রশিল্পে মুঘল শাসকরা এক গুরুত্বপূর্ণ নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। মুঘলরা পারসিক ও ভারতীয় চিত্ররসের সমন্বয়ে স্থাপত্যের মতোই এক স্বতন্ত্র চিত্রশিল্পের বিকাশসাধন করেন। মুঘল চিত্রশিল্পের উন্নতিতে প্রত্যেক মুঘল। বাদশাহের ভূমিকাই অনস্বীকার্য।
বাবর ও হুমায়ুন দুজনেই রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতির জন্য চিত্রকলা শিল্পে তেমন অবদান না রেখে যেতে পারলেও, বাবর যে সৌন্দর্য ও প্রকৃতির প্রেমিক ছিলেন তা তাঁর আত্মজীবনী 'বাবরনামা'তে, উল্লিখিত আছে। হুমায়ুন পারস্যে অবস্থান। কালেই মুঘল চিত্রশিল্পে পারসিক প্রভাবের ভিত নির্মাণ করে যান, যা ভারতবর্ষে মুঘল চিত্রশিল্পে এক নতুন যুগের সূচনা করে। হুমায়ুন প্রথম পারস্যের দুই শিল্পী সৈয়দ আলি ও আবদুস সামাদকে কাবুলে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। 'ইমজানামা' বই এর অলংকরণের কাজ হুমায়ুনের সময়ই শুরু হয়।
প্রকৃতপক্ষে আকবরের রাজত্বকালেই মুঘল চিত্রকলার যাত্রা শুরু হয়েছিল। জাহাঙ্গিরের আমলে তা বিকশিত হতে থাকে এবং সপ্তদশ শতকে বিকাশের সর্বোচ্চ শিখরের আরোহণ করে। এই সময়ে নিজস্ব চিত্রকরদের দিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতিকৃতি তিনি আঁকিয়েছিলেন। তাঁর দরবারে চিত্রকরদের মধ্যে বসাওয়ান ছিলেন প্রতিকৃতি অঙ্কনে সিদ্ধহস্ত। 'আকবর নামা' গ্রন্থের চিত্রায়ণে যে সুন্দরতম কিছু চিত্রের নিদর্শন পাওয়া যায়, তা বিশেষ এক বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। 'তুতিনামা', “রাজমনামা” (মহাভারতের ফারসি অনুবাদ) প্রভৃতি বইগুলি সুন্দর চিত্রকলা দিয়ে সাজানো ছিল।
জাহাঙ্গিরের আমলেই মুঘল চিত্রশিল্পের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। তিনি মুঘল চিত্রশিল্পে ইউরোপীয় ছবি আঁকার রীতি নিয়ে আসায় চিত্রশিল্পে ব্যাপক উন্নতি হয়। তিনি নিজেও একজন চিত্রকর ও চিত্রসংগ্রাহক ছিলেন যা চিত্রশিল্পীদের উৎসাহ প্রদান করেছিল। তাঁর আমলে বিশেণ দাস ছিলেন প্রতিকৃতি অঙ্কনে অদ্বিতীয়। এই ছবিতে বাস্তবতা ও প্রকৃতিবাদ-এর ছাপ স্পষ্ট হতে থাকে। জাহাঙ্গিরই প্রথম চিত্রশিল্পীদের স্বাক্ষর করার অনুমতি দেন। জাহাঙ্গিরের পুত্র শাহজাহানের সময় স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি চিত্রশিল্পের প্রভূত উন্নতিসাধন ঘটে। শাহজাহানের দরবারের বিখ্যাত অভিজাত আসফ খাঁর চিত্রশিল্প পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত হয়। শাহজাহানের রাজত্বকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রায়ণ হল 'শাহজাহাননামার' চিত্রায়ণ। শাহজাহানের পরে মুঘল চিত্রশিল্পের বড়ো একটা উন্নতি দেখা যায়নি। ঔরঙ্গজেবের সময়কালে অন্যতম চিত্রশিল্প হল ঔরঙ্গজেবের যুদ্ধ শিবিরে ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের চিত্রগুলি । প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ, অভিজাতরাই বিষয়বস্তু হিসাবে মুঘল দরবারি ছবিগুলিতে ছাপ রেখেছিল। তবে তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, তাদের কাজকর্মের ছবিও মুঘল চিত্রশিল্পে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছিল।
(জ) মধ্যযুগের ভারতে কীভাবে ফারসি ভাষার ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা বেড়েছিল তা বিশ্লেষণ করো।
উত্তর। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে ফারসি ভাষার ব্যবহার ও উন্নতি সাধনে সুলতানি শাসক ও মুঘল শাসকরা এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছিল। এদের হাত ধরেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ফারসি ভাষা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ভারতে ফারসি ভাষার প্রচলন ঘটে দশম শতাব্দীতে তুর্কিরা যখন ভারতে আসে। কুতবউদ্দিন আইবক ও ইলতুৎমিশ ফারসি ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সে সময়ে ফারসি ভাষা সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের মধ্যে আমির খসরুর রচনা ছিল বিখ্যাত। তুঘলক শাসনকালে ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রেও ফারসি হয়ে ওঠে অতি পছন্দের ভাষা। এই ভাষায় বিখ্যাত ঐতিহাসিকরা ছিলেন জিয়াউদ্দিন বারনি, মিনহাজ উস-সিরাজ ও ইমামি।
ফারসিতে অনুবাদের এই রেওয়াজ সমানভাবে চলতে থাকে তুঘলক, সৈয়দ ও লোদি আমলেও। মহম্মদ-বিন তুঘলকের আমলে দৌলতাবাদের রাজধানী স্থানান্তরের ফলে দক্ষিণ ভারতে ফারসি ভাষা চর্চা ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ ভারতের বাহমনি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানী গুলবার্গও হয়ে উঠেছিল ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের এক নামী কেন্দ্র। ফারসির আরও কার্যকারিতা ও জনপ্রিয়তা বেড়েছিল মুঘল আমলে। সম্রাট বাবর ছিলেন ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত। তাঁর আত্মজীবনী 'বাবরনামা' ফারসি ভাষায় রচিত হয়। হুমায়ুনের রাজসভায় ফারসি ভাষার অনেক সাহিত্যিক ও কবি ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাসিন খান মৌজি। সম্রাট আকবরের আমলে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য ক্রমশ উন্নত হতে থাকে। আকবরের আমলে ফারসি ভাষায় ইতিহাস গ্রন্থ হল আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি' ও ‘আকবর নামা’ বদাউনির ‘মুস্তাখাব-উৎ-তওফারিখ ও নিজামউদ্দিনের 'তবাকাত-ই-আকবরি' ইত্যাদি। বদাউনি করেছিলেন রামায়ণের অনুবাদ।
আকবরের মতো সম্রাট জাহাঙ্গিরও ফারসি ভাষার অনুরাগী ছিলেন। তাঁর শাসনকালে ভারতের নামী কবি ছিলেন তালিব আমুলি। শাহজাহানের সময়েও এই চর্চা বিপুল ভাবে প্রচলিত ছিল। আবদুল হামিদ লাহোরি ছিলেন তাঁর আমলে বিখ্যাত ফারসি ভাষার লেখক। জাহাঙ্গির ফারসি ভাষা সম্পর্কে যথেষ্টই অবগত ছিলেন, যা আমরা তাঁর লেখা ফারসি চিঠিগুলি থেকে জানতে পারি ।
সবশেষে আমরা বলতেই পারি যে, মধ্যযুগে সুলতানি ও মুঘল শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফারসি ভাষার বিকাশ অন্য মাত্রা নিয়েছিল, যা মধ্যযুগের ইতিহাসে নান্দনিক।
(ঝ) সুলতানি ও মুঘল আমলে সামরিক ও কৃষি প্রযুক্তিতে কী কী পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর। সুলতানি ও মুঘল আমল সামরিক ও কৃষিপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের যুগ। যা এই সাম্রাজ্যগুলির সামাজিক ও অর্থনীতিকে বিশেষ দৃঢ়তা প্রদান করেছিল। চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধে বারুদব্যবহারকারী আগ্নেয়াস্ত্র চিন থেকে মোঙ্গলদের হাত ঘুরে প্রথমে ভারতে এসে পৌঁছায়। যা ভারতীয় সামরিক পদ্ধতিরও প্রকৃত উন্নতিসাধন ঘটায়। পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চীন ও মামেলুক-শাসিত ইজিপ্ট থেকে বন্দুকের প্রযুক্তি আসে। মুঘল সম্রাট বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় যে গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহার করেন তা লোদী সৈন্যবাহিনীকে ধংস করে দেয়। এ ছাড়া বাবর যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর কামান ও বন্দুকের ব্যবহার করে মুঘলদের জয়লাভ নিশ্চিত করে দিয়েছেন। এর পর থেকে ভারতীয় শাসকরা অশ্বারোহী, পদাতিক ও রণহস্তীর সাথে বন্দুকের ব্যবহার ঘটিয়ে যুদ্ধ— পদ্ধতিকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল।
ত্রয়োদশ শতক নাগাদ পারস্যদেশ থেকে ভারতে আসে পারসি চক্র বা সাকিয়া। যা জলসেচের কাজে বিশেষ উন্নতি সাধন ঘটিয়েছিল। বেল্ট ও গিয়ার লাগানো ছোট্ট নাগরদোলার মতো দেখতে কাঠের তৈরি এই যন্ত্রের মাধ্যমে পশুশক্তির সাহায্যে কুয়ো বা খাল থেকে জল তোলা যেত। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ভারতে জল তোলার জন্য 'আমহাট্টা' নামক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এই ব্যবস্থায় কাঠের চাকায় কলশি বেঁধে দড়ির সাহায্যে জল তোলা হতো। বাবরের আত্মজীবনীতে 'পিন ড্রাম-গিয়ারিং' ব্যবস্থার দ্বারা একটি চাকার সাথে ধাতুর কলশি বেঁধে গোরুর সাহায্যে চাকা ঘুরিয়ে অবিরাম জল তোলার ব্যবস্থার কথা জানা যায়। এ ছাড়া সপ্তদশ শতকে মুঘল শাসকরা বাগিচা কৃষির উন্নতি চাহার বাগ' কৌশলের ব্যাপক ব্যবহার করেন।
No comments:
Post a Comment