◼️লেখক পরিচিতি;
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, সমাজবিজ্ঞানী, সংস্কৃতি-গবেষক ও সাহিত্যসমালোচক বিনয় ঘোষ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ছদ্মনাম 'কালপ্যাঁচা'। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাপ্তাহিক অরণি, দৈনিক বসুমতী, যুগান্তর-সহ বহু পত্রপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। কলকাতার কালচার, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, বাংলার নবজাগৃতি, লোকসংস্কৃতি ও সমাজতত্ত্ব, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, কালপেঁচার নকশা প্রভৃতি তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়।
◼️নাম করণ;
মুরশিদাবাদের একটি প্রাচীন উৎসব হল খোজা খিজির উৎসব। এই উৎসবের ঐতিহ্য সেই মোগল আমলের। ভাদ্র মাসে ভরা ভাগীরথী নদীতে আলোয় সাজানো ভেলা ও ছোটোবড়ো জলযান ভাসিয়ে এই উৎসব পালিত হয়। জলদেবতা খাজা খিজিরকে স্মরণ করে এই উৎসবের আরম্ভ । তাঁকে উদ্দেশ্য করেই এই উৎসবের নাম হয় খাজা খিজির উৎসব। আবার লোকমুখে সেই নামটিই হয়ে গেছে খোজা খিজির উৎসব। তাই সেই উৎসবটি সম্পর্কে রচিত নিবন্ধের নাম হিসেবে 'খোজা খিজির উৎসব' নামটি যথাযথ ও সার্থক হয়েছে বলা চলে।
◼️সারমর্ম:
মোগল আমলের একটি জনপ্রিয় উৎসব হল খোজা খিজির উৎসব। এই উৎসবকে বেরা উৎসব ও ভেলা ভাসান পরবও বলা হয়। এই উৎসব হয় ভাদ্র মাসে। মুরশিদাবাদই এই উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। সদ্য পেরোনো বর্ষায় ভরা ভাগীরথী টে। নদীকে আলোর ভেলা ও ছোটোবড়ো জলযান দিয়ে সাজানো হয়। জলদেবতা খাজা খিজিরকে স্মরণ করে চলে এই উৎসব। ভেলা, জলযান নির্মাণ ও সাজানোর কাজ চলে অনেক আগে থেকে। বাঁশ-বাখারি-ছেঁচা-চাটাই-কলাগাছ ইত্যাদি দিয়ে নানা আকারের জলযান তৈরি করে তার ওপরে অভ্রের তৈরি আলোয় কোরানের বাণী, মসজিদ, গাছপালা ও নানারকমের মূর্তি আঁকা হয়। রুপোলি আবরণে ঢাকা কৃত্রিম ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়।
প্রাচীন আমল থেকেই হাজারদুয়ারিতে তোপ দেগে ভাসানের সময় সূচিত হত। আজও তোপখানা থেকে তোপ দাগা হলে ভেলার দড়ির বাঁধন কাটা হয় । নৌবহরের সঙ্গে সঙ্গে মতিমহল থেকে হাতি, ঘোড়া, উট, অশ্বারোহী ও পদাতিকের পদযাত্রা চলে। কয়েকটি মকরমুখী নৌকোও সঙ্গে যোগ দেয় ।
◼️ নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও:
১. কী দিয়ে জলযান ও ভেলা তৈরি হয় ?
উত্তর: জলযান ও ভেলার প্রধান উপাদান হল বাঁশ ও কলাগাছ । বাঁশ থেকেই জাফরি, ছেঁচা, চালি ইত্যাদি তৈরি হয় ।
২. খোজা খিজির উৎসবে কী কী বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়?
উত্তর: খোজা খিজির উৎসবে নাগরা, ঢোল, কাড়ানাকাড়া, শিঙা, সানাই ইত্যাদি বাজানো হয় ।
৩. খোজা খিজির উৎসব কোথায় হয় ?
উত্তর: খোজা খিজির উৎসব মুরশিদাবাদে হয় ।
৪. কোন্ নদীতে খোজা খিজির উৎসব পালিত হয় ?
উত্তর: ভাগীরথী নদীতে খোজা খিজির উৎসব পালিত হয় । ভাসান পরব নামে ডাকা হয় ।
৫. খোজা খিজির উৎসবকে আর কী নামে ডাকা হয়?
উত্তর: খোজা খিজির উৎসবকে বেরা উৎসব ও ভেলা-
৬ .খোজা খিজির উৎসবে জলে কী ভাসানো হয় ?
উত্তর: খোজা খিজির উৎসবে জলে আলোয় সাজানোভেলা ও জলযান ভাসানো হয় ।
৭. ভেলা ও জলযানের নির্মাণকেন্দ্র কোথায় রয়েছে ?
উত্তর: মুরশিদাবাদ নগরের কাছে জাফরগঞ্জ হল ভেলা ও জলযানের একটি বড়ো নির্মাণকেন্দ্র |
৮. অভ্রের আলোয় কী কী ছবি ফুটিয়ে তোলা হত ?
উত্তর: অভ্রের আলোয় কোরানের বাণী, মসজিদ, গাছপালা ও নানারকম মূর্তি ফুটিয়ে তোলা হত ।
৯.কবে খোজা খিজির উৎসব শুরু হয়?
উত্তর: ভাদ্রমাসের শেষে বৃহস্পতিবার খোজা খিজির উৎসব শুরু হয়।
১০. কোথায় খোজা খিজির উৎসবের ভেলা সাজিয়ে রাখা হত?
উত্তর: হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সামনে তোপখানার ঘাটে নবাববাড়ির উত্তরে প্রায় দুই মাইল দূরে মহীনগরের নীচে ভাগীরথীর জলে খোজা খিজির উৎসবের ভেলা সাজিয়ে রাখা হত।
১১. নবাবি আমলে কতদূর পর্যন্ত গঙ্গার তীর সাজানো হত ?
উত্তর: নবাবি আমলে লালবাগ থেকে মহীনগর পর্যন্ত গঙ্গার তীর সাজানো হত ।
◼️নীচের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাভিত্তিক প্রশ্নগুলির উত্তর দাও:
১. নবাবি আমলে কীভাবে খোজা খিজির উৎসবের ভেলা ও জলযান সাজানো হত ?
উত্তর: বিনয় ঘোষ রচিত খোজা খিজির উৎসব গদ্যাংশ থেকে নবাবি আমলে মুরশিদাবাদের একটি জনপ্রিয় খোজা খিজির উৎসবের কথা আমরা জানতে পারি । সেই আমল থেকেই খোজা খিজির উৎসব উপলক্ষ্যে কুশলী শিল্পীদের নিয়োগ করা হত অভ্রের পাত দিয়ে তৈরি আলো চিত্রিত করার জন্য।
এইসব অভ্রের তৈরি আলোয় কোরানের বাণী, মসজিদ, গাছপালা ও নানারকমের মূর্তি চিত্রিত করার প্রথা ছিল। এই কাজে শত শত শিল্পীকে নিয়োগ করা হত। ভেলা ও জলযানগুলিকে বহুবর্ণের দীপালোকে সাজানোটা ছিল বেশ উঁচু দরের শিল্পীদের কাজ। কলাগাছ জলে ভাসিয়ে তার উপর বাঁশ-বাখারি-ছেঁচা-চাটাই দিয়ে মিনার, তোরণ, গম্বুজ, নিশান, দুর্গ ইত্যাদি কাঠামো তৈরি করে সাজানো হত। কয়েকটি জলযানকে দোতলা, তিনতলা যুদ্ধজাহাজের মতো করে সাজিয়ে নানারকম রঙিন কাগজ, অভ্র, রাংতা ইত্যাদি দিয়ে জলযানগুলিকে মুড়ে দেওয়া হত এবং রুপোলি ঝারোখায় ঢাকা কৃত্রিম ঝাড়লণ্ঠন জলযানে ঝোলানো হত। জলদেবতা খাজা খিজিরের স্মরণ উৎসবই ছিল এই বেরা উৎসব বা ভেলা ভাসান পরব।
No comments:
Post a Comment