◼️লেখক পরিচিতি;
রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতার জগতে একটি স্মরণীয় নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম ১৯১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। ১৯৪০ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে অগ্নিকোণ, চিরকুট, ফুল ফুটুক, যত দূরেই যাই, কাল মধুমাস ইত্যাদি। তাঁর গদ্য রচনার দৃষ্টান্ত— কাঁচা-পাকা, ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন, হাংরাস প্রভৃতি গ্রন্থে ছড়িয়ে আছে। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয় ।
◼️নামকরণ;
মরশুম কথাটির অর্থ হল ঋতু। এই পাঠ্যাংশটিতে বাংলার গ্রামজীবনে বিভিন্ন ঋতুর প্রভাব কীভাবে এসে পড়ে সে কথাই আলোচনা করা হয়েছে। গ্রামজীবন কৃষিভিত্তিক। আর ফসলের জন্য পরিমিত পরিমাণে বৃষ্টি অত্যন্ত প্রয়োজন । তাই বৃষ্টির ওপরেই নির্ভর করে বীজ বোনা, ধান রোয়া বা ফসল তোলার মতো কাজ। বৃষ্টি তাই পল্লিজীবনে নিয়ে আসে আনন্দের বান ।
বসুধারা ব্রত করে, মেঘরানির কুলো নামানোর গান গেয়ে মেয়েরা এই সময় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। আবার খুব বৃষ্টির সময় তারা প্রিয়জনের মঙ্গলকামনায় ভাদুলি ব্ৰত করে। পুরো পাঠ্যাংশে এই বৃষ্টির মরশুম এবং গ্রামজীবনের ওপরে তার প্রভাব বর্ণিত হয়েছে। তাই এই পাঠ্যাংশের নাম হিসেবে ‘মরশুমের দিনে' নামটি যথোপযুক্ত।
◼️সারমর্ম;
ছোটো মফস্সল শহরে ডিপোয় দাঁড়িয়ে থাকা বাসে করে গ্রামের বহু যাত্রী শহরে আসেন নানা কাজে। মাঠে ফসল ফললে মানুষের হাতে অর্থের সমাগম হয়। তাদের উপার্জিত অর্থের বেশিরভাগটাই আসে ফসল, প্রধানত, ধান থেকে । বৃষ্টি হলে ধান ভালো হয়। তাই বৃষ্টির জন্য ঋতুর ওপরেই গ্রামীণ জীবন নির্ভর করে থাকে সারাটা বছর। শরতে আবার নীল আকাশে ওঠে কাঁচা সোনা রঙের রোদ । সবুজ ধানে জমি ছেয়ে থাকে। দূরে দূরে দু-একটা তালখেজুর অথবা শিশুপলাশ দেখা যায়।
ধান কেটে নেওয়ার পর প্রকৃতির চেহারা রুক্ষ, শুষ্ক হয়ে ওঠে। রোদের তেজে জল শুকিয়ে যায় । আকাশের জল প্রার্থনা করে এই সময়ে মেয়েরা বসুধারা ব্রত করে । কখনও বা ‘মেঘারানির কুলো” নামানোর প্রথা পালন করে। বৃষ্টি পড়লে আবার হইহই করে ওঠে কর্মব্যস্ত গ্রাম্যজীবন | বৃষ্টির শেষে মেয়েরা ভাদুলি ব্রত করে। এই ব্রতের মধ্যে প্রাচীন বাংলার বাণিজ্যকেন্দ্রিক ছবিটি ধরা পড়েছে।
◼️নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও:
১.সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থটির নাম কী ?
উত্তর: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থটির নাম হল পদাতিক।
২. তাঁর লেখা একটি গদ্যের বইয়ের নাম লেখো ।
উত্তর: সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি গদ্যগ্রন্থ হল হাংরাস।
৩. ধান শব্দটি কোন্ শব্দ থেকে এসেছে?
উত্তর: ধান শব্দটি ‘ধান্য” শব্দ থেকে এসেছে।
৪.‘অগ্রহায়ণ' বলতে কী বোঝায় ?
উত্তর: ‘অগ্রহায়ণ' বলতে বোঝায় বছরের আরম্ভ |
৫. এদেশের সমস্ত পালাপার্বণ, আনন্দ-উৎসব—এসবের মূলে কী রয়েছে ?
উত্তর: এদেশের সমস্ত পালাপার্বণ, আনন্দ-উৎসবের মূলে রয়েছে কৃষি বা চাষবাস।
৬. বসুধারা ব্রত কোন্ ঋতুতে হয় ?
উত্তর: গ্রীষ্মকালে বসুধারা ব্রত হয় ।
৭. মেঘকে নামাবার জন্য মেয়েরা দল বেঁধে ছড়া করে তাকে কী কী নামে ডাকে?
উত্তর: মেঘকে নামাবার জন্য মেয়েরা দল বেঁধে ছড়া করে তাকে ‘কালো মেঘা’, ‘ফুলতোলা মেঘা’, ‘ধুলোট মেঘা’, ‘তুলোট মেঘা’, ‘আড়িয়া মেঘা’, ‘হাড়িয়া মেঘা’, ‘কুড়িয়া মেঘার নাতি’, ‘বার মেঘার ভাই’– ইত্যাদি নামে ডাকে।
৮. ক্ষেত্রব্রতের ব্রতীদের কী খেতে হয়?
উত্তর: ক্ষেত্রব্রতের ব্রতীদেরকে মাঠে বসে চিঁড়ে-গুড়, মুড়ি- খই আর দই দিয়ে ফলার খেতে হয় ।
৯.‘মেঘারানির কুলো' নামাবার গান গেয়ে মেয়েরা কী পায় ?
উত্তর: মেয়েরা বাড়ি বাড়ি থেকে চাল-তেল-সিঁদুর, কখনও দু-চারটে পয়সা আর পান-সুপারি পায় ।
◼️ নীচের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাভিত্তিক প্রশ্নগুলির উত্তর দাও:
১. ক্ষেত্রব্রতের অনুষ্ঠানটির বর্ণনা দাও।
উত্তর: সাধারণত গ্রামাঞ্চলের চাষিবউরা ক্ষেত্রব্রত করে থাকে । নিজেরা ঘট প্রতিষ্ঠা করে তার গায়ে সিঁদুরের পুতুল এঁকে ঘটের জলে তারা আমের পল্লব ডুবিয়ে দেয়। সাধারণত একটু বয়স্কা কোনো মহিলা মূলব্রতীর ভূমিকা পালন করেন। হাতে ফুল আর দূর্বা নিয়ে ব্রতীর দল তার মুখ থেকে ব্রতকথা শোনে। সন্ধ্যা নাগাদ উলু দিয়ে ব্ৰত শেষ করে সকলে মিলে মাঠে বসেই চিঁড়ে-গুড়-মুড়ি খই আর দই দিয়ে ফলার খায়। চাষিরা ওইদিন ভোরে মাঠে গিয়ে জমিতে লাঙল দিয়ে বীজধান পুঁতে জমিতে জল ছড়িয়ে আসে।
২. গ্রামাঞ্চলে কালবৈশাখী ঝড়ের বর্ণনা দাও ৷
উত্তর: দারুণ গ্রীষ্মের শেষদিকে কখনো কখনো বিকেলবেলায় ওঠে কালবৈশাখী ঝড়। আকাশ কালো হয়ে আসে। কালো মেঘের গায়ে বিদ্যুতের চমকানি দেখা যায় । তারপর নারকেল-তাল-খেজুর প্রভৃতি উঁচু উঁচু গাছের মাথাগুলোকে হাওয়ার দাপটে একেবারে শুইয়ে দিয়ে আচমকা ছুটে আসে ঝড়। সঙ্গে বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা। সেই বৃষ্টি তেতে ওঠা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টি হলে মুহূর্তেই তপ্ত দিন তার শীতলতা ফিরে পায়। ছেলেরা হইহই করে আমবাগানে ছোটে আম কুড়োতে। সব মিলিয়ে, গ্রীষ্মের অসহ্য কষ্টের ছবিটি নিমেষেই মুছে যায়।
৩.বাস-ডিপোয় অপেক্ষমান যাত্রীদের ছবি কীভাবে পাঠ্যাংশে ধরা পড়েছে ?
উত্তর: বাস-ডিপোয় যাত্রীরা বাস ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করছে। বাসের ভিতরে যে যার নিজের জায়গায় হাতের মালপত্র রেখে দিয়ে তারা অনেকেই বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাসের ড্রাইভার যেখানে চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপরে বসে চা খাচ্ছে, সেদিকে নজর রেখে যাত্রীরা কাছেপিঠে ঘোরাফেরা করে। গরমের সময়ে গায়ে হাওয়া লাগায়, শীতের সময় রোদ পোহায় ।
৪.“গ্রামের সঙ্গে শহরের যে এখনও নাড়ির টান”- এই নাড়ির টানের প্রসঙ্গ রচনাংশে কীভাবে এসেছে?
উত্তর: গ্রামের মানুষ এখনও তাদের বিভিন্ন দরকারে শহরে আসে । শহরের সঙ্গে গ্রামের এই যোগাযোগটি আরও স্পষ্ট বোঝা যায় মাঠের ফসল তোলার সময়। কারণ, সেই সময়ে গ্রামের মানুষের হাতে পয়সা আসে। তখন তারা মেয়ে দেখতে, পুজো দিতে যায়। জিনিস কিনতে, সিনেমা দেখতে, মামলার তদবির তদারক করতে তারা শহরে যায়। এই সুযোগে উকিল-মোক্তার, বায়ুন- পুরুত, দরজি-দোকানিও অর্থ উপার্জন করতে পারে। গ্রাম ও শহরের এই জীবিকা f এবং অর্থের পারস্পরিক যোগাযোগের কথা বলতে গিয়েই নাড়ির টানের প্রসঙ্গটি এসেছে।
৫. “ধানের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু বৃষ্টি”— বৃষ্টির সময়ে ধানখেতের ছবিটি কেমন? অন্য যে যে সময়ে ধান চাষ হয়ে থাকে, তা লেখো ।
উত্তর: - বৃষ্টির সময়ে হোগলার তৈরি মাথালে মাথা পিঠ ঢেকে তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই গামছা পরে চাষিরা মাঠের কাজে বেরিয়ে পড়ে। বর্ষা থাকতে থাকতেই তারা ধান রোয়া ও আল বাঁধার কাজ সেরে নেয় । ধান খেতের দিকে তাকালে মনে হয়, কে যেন সবুজ গালিচা পেতে দিয়েছে। জমিতে ধান এই সময়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে। মাঝেমাঝে মাঠ পরিষ্কারও করে দিতে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই মাঠের কাজও শেষ হয়ে যায়।
• ধান মোট তিন প্রকার— আউশ, আমন এবং বোরো। আউশ ধান গ্রীষ্মে রোপণ করে শরতে তোলা হয়, আমন ধান বর্ষায় রোপণ করে শীতে তোলা হয় আর বোরো ধান শীতে রোপণ করে গ্রীষ্মে তোলা হয় ।
৬. “আগে বছর আরম্ভ হত অগ্রহায়ণে” –এর সম্ভাব্য কারণ কী ?
উত্তর: আগে বছর অগ্রহায়ণে আরম্ভ হওয়ার সম্ভাব্য কারণ হল, অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ফসল ঘরে তোলা হত। আর খাদ্যশস্য হিসেবে ফসলের অত্যন্ত গুরুত্ব ছিল মানুষের জীবনে। এর তাই অগ্রহায়ণ মাস দিয়েই বছরের শুরু বলে ধরে নেওয়া হত।
No comments:
Post a Comment