❐ কমবেশি ১৫টি শব্দের মধ্যে উত্তর দাও :
1. 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটি কার লেখা?
উত্তরঃ 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটি কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা।
2. কোন্ কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাটি সংকলিত হয়েছে?
উত্তরঃ কবিতাটি 'রূপসী বাংলা' নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে।
3. 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটির মূল সুর কী বলে তোমার মনে হয়?
উত্তরঃ কবিতাটিতে কবি সন্ধ্যার আঁধারের বিভিন্ন অনুষঙ্গের মধ্যে দিয়ে বঙ্গপ্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যের বিষাদকে তুলে ধরেছেন।
4. আকাশে কয়টি তারা উঠেছে?
উত্তরঃ আকাশে সাতটি তারা ফুটে উঠেছে।
5. কবি আকাশে সাতটি তারার উল্লেখ করেছেন কেন?
উত্তরঃ কবি সন্ধ্যার পরিপূর্ণ রূপকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সাতটি তারার উল্লেখ করেছেন।
6. আকাশে সাতটি তারা ওঠার সময় কবি কোথায় বসেছিলেন?
উত্তরঃ আকাশে সাতটি তারা ফুটে ওঠার মুহূর্তে কবি ঘাসের ওপর বসেছিলেন।
7. কাকে মৃত মনিয়ার মতো মনে হয়েছে?
উত্তরঃ কামরাঙা-লাল মেঘকে মৃত মনিয়ার মতো মনে হয়েছে।
8. গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে কে ডুবে গেছে?
উত্তরঃ গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে কামরাঙা-লাল মেঘ ডুবে গেছে।
9. কবি কাকে শান্ত অনুগত বলেছেন?
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার নীল সন্ধ্যাকে শান্ত অনুগত বলেছেন।
10. কবি বাংলার সন্ধ্যাকে 'নীল' বলে মনে করেছেন কেন?
উত্তরঃ কবি সান্ধ্য আঁধারের আবছায়া অস্পষ্টতাকে মায়াবী সৌন্দর্যের রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সচেতনভাবে 'নীল' শব্দটি প্রয়োগ করেছেন।
11. বাংলার সন্ধ্যাকে কবি 'শান্ত অনুগত' বলেছেন কেন?
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ বঙ্গ-প্রকৃতির বুকে সন্ধ্যাকে নিঃশব্দে নেমে আসতে দেখে তাকে 'শান্ত অনুগত' বলেছেন।
12. 'কেশবতী কন্যা' বলতে কবি কাকে বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ 'কেশবতী কন্যা' বলতে বাংলার নীল সন্ধ্যাকে বুঝিয়েছেন।
13. বাংলার নিসর্গ প্রকৃতির বুকে নেমে আসা সন্ধ্যাকে কবি কীসের সঙ্গে তুলনা করেছেন?
উত্তরঃ বাংলার নিসর্গ প্রকৃতির বুকে নেমে আসা সন্ধ্যাকে কবি 'কেশবতী কন্যা'র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
14. কবির চোখ-মুখের উপরে কার চুল ভাসে?
উত্তরঃ কবির চোখ-মুখের উপরে কেশবতী কন্যার চুলের মতো নীল সন্ধ্যার লাবণ্যময় আঁধার ভেসে বেড়ায়।
15. 'পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখে নি কো'-এমন বলার কারণ কী?
উত্তরঃ বাংলার প্রকৃতির অতুলনীয় সান্ধ্যকালীন সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতেই কবি তাকে কেশবতী কন্যার রূপ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
16. 'এ কন্যাকে দেখে নি কো'-কবি এখানে কার কথা বলেছেন?
উত্তরঃ এখানে কবি জীবনানন্দ দাশ সান্ধ্য নীলিমায় আচ্ছন্ন বঙ্গ-প্রকৃতির কথা বলেছেন।
17. পৃথিবীর কোনো পথে কী নেই বলে কবি অনুমান করেছেন?
উত্তরঃ পৃথিবীর কোনো পথে রূপসী সন্ধ্যার ঘনায়মান আঁধারে এমন স্নিগ্ধ ও মধুর গন্ধ নেই বলে কবি অনুমান করেছেন।
18. 'হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত'-কী ঝরে পড়ে?
উত্তরঃ হিজলে, কাঁঠালে, জামে 'অজস্র চুলের চুমা' অর্থাৎ সান্ধ্য অন্ধকারের গভীর আন্তরিক স্পর্শ ঝরে পড়ে।
19. 'এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে'-স্নিগ্ধ গন্ধ কোথায় ঝরে পড়ে?
উত্তরঃ রূপসীর চুলের বিন্যাসে বঙ্গ-প্রকৃতির অখণ্ড নৈসর্গিক আবহ জুড়ে স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে পড়ে।
20. 'কলমী' কী?
উত্তরঃ কলমি হল এক ধরনের শাক, যা নদীমাতৃক বাংলার পুকুর বা বিভিন্ন জলা জায়গায় জন্মায়।
21. 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় কবি গ্রাম-বাংলার অনুষঙ্গে কোন্ কোন্ বিশেষ ঘ্রাণ বা গন্ধের কথা বলেছেন?
উত্তরঃ 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় কবি নরম ধান ও কলমির গন্ধ এবং পুকুরের জলে চাঁদা-সরপুঁটিদের ঘ্রাণের কথা বলেছেন।
22. 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় কোন্ কোন্ মাছের প্রসঙ্গ এসেছে?
উত্তরঃ জীবনানন্দের লেখা পাঠ্য কবিতায় চাঁদা, সরপুঁটি মাছের উল্লেখ করা হয়েছে।
23. 'শীত হাতখান'- বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ এক্ষেত্রে যত্ন-মমতা, আন্তরিকতা ও বিষন্নতার মতো ভাবগুলি ফুটিয়ে তুলতে রূপকার্থে শব্দগুচ্ছটি ব্যবহৃত হয়েছে।
24. 'কিশোরের পায়ে-দলা মুথাঘাস' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ এখানে কবি চঞ্চল, চপল কিশোরের পায়ের আঘাতে মুথাঘাসের দলিত, অবিন্যস্ত ছবি কবি ফুটিয়ে তুলেছেন।
25. 'ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা'-কার ব্যথিত গন্ধের কথা বলা হয়েছে?
উত্তরঃ লাল লাল বট ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতার কথা বলা হয়েছে।
26. বট ফলের গন্ধ ব্যথিত কেন?
উত্তরঃ লাল বট ফল পেকে মাটিতে পড়ে থেঁতলে যায়। তার ঝরে যাওয়ার বেদনাজনিত আভাস টের পেয়ে সেই গন্ধকে কবির 'ব্যথিত' বলে মনে হয়েছে।
27. 'এরই মাঝে বাংলার প্রাণ'-কবি কোথায় বাংলার প্রাণের স্পর্শ খুঁজে পেয়েছেন?
উত্তরঃ কবি নরম ধান, কলমি, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে শীতল হাত, পায়ে দলা মুথা ও ব্যথিত বটফলের ক্লান্ত নীরবতার মাঝে বাংলার প্রাণের স্পর্শ খুঁজে পান।
28. 'আমি পাই টের'-কে, কী টের পান?
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ যখন আকাশে যখন সাতটি তারা ফুটে ওঠে, তখন বঙ্গ-প্রকৃতির প্রাণময় উপস্থিতি টের পান।
29. আকাশে সাতটি তারা ফুটে ওঠার পর কবি কী অনুভব করেন?
উত্তরঃ আকাশে সাতটি তারা ফুটে ওঠার পর কবি বাংলার প্রাণ টের পান বা অনুভব করেন।
30. 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটি কী ধরনের কবিতা?
উত্তরঃ 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটি কবিতার প্রকার অনুসারে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা।
❐ কমবেশি ৬০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও :
1. 'আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে'-কবির চোখে বাংলার সন্ধ্যার প্রকৃতিগত রূপটি কেমন ? এই সৌন্দর্যকে কবি কার সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখো। অথবা, বঙ্গ-প্রকৃতির বুকে ঘনায়মান সন্ধ্যার পটভূমি ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় গ্রাম বাংলার প্রকৃতির বুকে যে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল কবির চোখে তা ছিল নীল, শান্ত ও অনুগত।
অস্তগামী সূর্যের আভায় পশ্চিম আকাশের মেঘ লাল হয়ে উঠে সুদূর দিগন্তকে রাঙিয়ে গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে যেন বিলীন হয়ে যায়। তারপর প্রকৃতির বুকে নেমে আসে শান্ত, নীল অনুগত সন্ধ্যা, যে সন্ধ্যা আচ্ছন্ন করে হিজল-কাঁঠাল-জাম সহ বাংলায় মাঠ-ঘাট-প্রান্তরকে। আর স্পর্শ করে যায় কবির চোখ-মুখকেও।
2. 'আমি এই ঘাসে বসে থাকি'-আমি কে? তিনি এই ঘাসে বসে থাকেন কেন? ১+২ = ৩
উত্তরঃ এক্ষেত্রে 'আমি' বলতে 'আকাশের সাতটি তারা'র লেখক জীবনানন্দ দাশকে বোঝানো হয়েছে।
পশ্চিম আকাশের অস্তগামী সূর্যের আভায় রঞ্জিত রাঙা মেঘ যখন অপূর্ব বর্ণচ্ছটায় দিগন্তকে রাঙিয়ে গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে বিলীন হয়ে যায়, যখন প্রকৃতির বুকে কেশবতী কন্যার ঘন কালো চুলের মতো অন্ধকার নেমে আসে, হিজল-কাঁঠাল জাম সহ কবির মুখের পরে সে আঁধার এসে পড়ে, ঠিক তখনই আকাশে ফুটে ওঠে সাতটি তারা যা প্রত্যক্ষ/করার জন্য কবি ঘাসের ওপর বসে থাকেন।
3. 'কামরাঙা লাল মেঘ' বলবার কারণ কী?
উত্তরঃ কবি সন্ধ্যার আকাশে অস্তগামী সূর্যের আলোয় রাঙা মেঘপুঞ্জকে পাকা কামরাঙার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কামরাঙা এক ধরনের পঞ্চশিরাযুক্ত ভাঙাচোরা গঠনের ফল। নানান আদলের মেঘ সূর্যের অস্তায়মান আলোয় হলদে বা লালচে পাকা কামরাঙার বর্ণ ধারণ করে যেন জ্বলে উঠে গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ের গাঢ় আঁধারে অদৃশ্য হয়ে যায়। দিনান্তের এই গতিশীল দৃশ্যান্তরকে ফুটিয়ে তুলতে কবি এমন উপমা ব্যবহার করেছেন।
4. 'আসিয়াছে শান্ত অনুগত'-কে এসেছে? তাকে 'শান্ত অনুগত' বলবার কারণ কী? ১+২=৩
উত্তরঃ 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতা থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশে কবি জীবনানন্দ দাশ বঙ্গ-প্রকৃতির বুকে 'নীল সন্ধ্যা' নেমে আসবার কথা বলেছেন।
রহস্যময় আবছায়ায় আচ্ছন্ন সন্ধ্যার মুহূর্তে কবির মনে হয়েছে সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি যেন এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্যে পূর্ণ। সমস্ত দিগন্তজুড়ে এক অদ্ভুত নীরবতাকে সাক্ষী রেখে দৃশ্যপটের স্বয়ংক্রিয় বদল ঘটতে থাকে। এই সন্ধ্যা একান্তই বাধ্য, নিয়ন্ত্রক নির্দেশিত মুহূর্ত-পরম্পরা। তাই সন্ধ্যাকে কবি 'শান্ত অনুগত' বলে মনে করেছেন।
5. কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে'— 'কেশবতী কন্যা' বলতে কবি কাকে বুঝিয়েছেন? তাকে 'কেশবতী কন্যা' বলার কারণ কী? ১ + ২ = ৩
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় 'কেশবতী কন্যা' বলতে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারকে বুঝিয়েছেন।
'কেশবতী কন্যা' কথাটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আলুলায়িত কেশদামবিশিষ্ট এক রূপসী কিশোরীর ছবি। তার ঘন কালো চুলের আচ্ছন্নতা সমস্ত দৃশ্যপট আড়াল করে। সেই কিশোরীর গাঢ় কালো চুলের মতো লাবণ্যময় আঁধার বঙ্গ-প্রকৃতির সর্বত্র সঞ্চারমান। সান্ধ্য অন্ধকারের নরম সজীব পেলবতা, একমাত্র চুলের সঙ্গে তুলনীয় বলেই কবি এমন মন্তব্য করেছেন।
6. 'জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে'-রূপসীর চুলের বিন্যাসে স্নিগ্ধ গন্ধ কীভাবে ঝরে যায় তা বুঝিয়ে বলো। 'অথবা, 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় সন্ধ্যার অনুষঙ্গে যে বিভিন্ন গন্ধের প্রসঙ্গ এসেছে তার পরিচয় দাও।
উত্তরঃ 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ 'রূপসী' বলতে গ্রাম-বাংলার বুকে নেমে আসা লাবণ্যময়ী সন্ধ্যাকে বুঝিয়েছেন। এই ঘন কালো অন্ধকারের অনির্বচনীয় গন্ধের কথা কবি বলেছেন। গন্ধ কোনো দৃশ্যগত ব্যাপার নয়। আমরা নানান ঘ্রাণ অনুভব করি। কবি সেই অনুভবের বিষয়টিকে দৃশ্যগত উপমার মাধ্যমে অনুভূতিগম্য করে তুলেছেন। আসলে অন্ধকার নামার পর নরম ধান, কলমি, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জলে চাঁদা-সরপুঁটিদের শারীরিক অস্তিত্বের মৃদু আবেশ জড়ানো গন্ধ ভেসে আসে, যা সন্ধ্যার রহস্যময় আবছায়াকে মাধুর্যে স্নিগ্ধ করে তোলে। কবি সেই গন্ধ অনুভব করেছেন সন্ধ্যা নামক রূপসীর চুলের বিন্যাসে।
7. 'কিশোরের পায়ে-দলা মুথা ঘাস'- আলোচ্য পঙ্ক্তিটির মতো বহু অসাধারণ চিত্রকল্প 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় আছে। এই ধরনের কয়েকটি চিত্রকল্পের কথা লেখো। ৩
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দের কবিতা চিত্ররূপময়। 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটিও এর ব্যতিক্রম নয়। অসামান্য কিছু চিত্রকল্প আমাদের এই পাঠ্য কবিতায় আছে। যেমন- 'কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো', 'কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে', 'আমার চোখের 'পরে আমার মুখের 'পরে চুল তার ভাসে', 'অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে', 'হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা-সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ', 'কিশোরীর চালধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান' প্রভৃতি। এইসব চিত্রকল্পের সমন্বয়ে কবি রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শময় সান্ধ্য-নিসর্গের বিষণ্ণতায় ভরা স্মৃতিমেদুর ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন।
❐ কমবেশি ১৫০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও :
1. 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটির নামকরণ কতদূর সার্থক হয়েছে আলোচনা করো।
উত্তরঃ 'আকাশে সাতটি তারা' একটি নিসর্গ প্রেমের কবিতা। তবে এ নিসর্গ প্রেম শুধু প্রকৃতি-মুগ্ধতাতেই থমকে থাকেনি, তা একটি লক্ষ্যেও পৌঁছেছে। কবিতাটিতে কবি ঘাসের ওপর বসে ঘনায়মান সন্ধেয় লাল মেঘকে গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে অন্ধকারে ডুবে যেতে দেখেছেন, দেখেছেন কেশবতী কন্যার মতো নীল সন্ধ্যার লাবণ্যপ্রভ আঁধার ছড়িয়ে যাচ্ছে দিকে দিকে। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে কবি অনুভব করেছেন প্রকৃতির ইঙ্গিতময় ক্লান্তিকেও। এই সঙ্গে তিনি টের পেয়েছেন হাঁসের পালক, শর, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত, কিশোরের পায়ে-দলা মুথাঘাস ও বট ফলের ক্লান্ত নীরবতা। পুরো কবিতাটি সান্ধ্যনীলিমার ছায়াময় অন্ধকার আর অস্ফুট ক্লান্তির পদচ্ছাপের মায়াময় সম্মোহনে পরিপূর্ণ। হিজল, কাঁঠাল, জাম এমনকি নরম ধানের গন্ধও এই আচ্ছন্নতায় আকুল। তাই পারিপার্শ্বিক সমস্ত অনুষঙ্গের হৃদয়ে এক আশ্চর্য ব্যথিত গন্ধ ও ক্লান্তিময় নীরবতা টের পান কবি। আর ঠিক তখনই কবি আকাশের বুকে সাতটি তারাকে ফুটে উঠতে দেখেন। পাঠ শেষে সন্ধ্যার আঁধারে মথিত পাঠকের। মনের পর্দাতেও যেন এই সাতটি তারার ছবিই হীরকখণ্ডের মতো অমলিন উজ্জ্বলতায় স্পষ্ট হয়ে জ্বলে ওঠে। তাই সংকলকদের দেওয়া নামকরণ সার্থক ও যথাযথ হয়েছে বলেই আমরা মনে করি।
2. জীবনানন্দ দাশের 'আকাশে সাতটি তারা কবিতায় নিসর্গ প্রকৃতির মধ্যে যে অপরূপ চিত্রময়তা ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
উত্তরঃ 'রূপসী বাংলা'র স্রষ্টা জীবনানন্দ বাংলার বুকে যে সন্ধ্যা নেমে আসে সেই নৈসর্গিক মুহূর্তের এক অপরূপ চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর 'আকাশের সাতটি তারা' কবিতার মাধ্যমে। অস্তগামী সূর্যের আভায় পশ্চিম আকাশের রাঙা মেঘ ক্রমশ পশ্চিম আকাশকে রাঙিয়ে গঙ্গা সাগরে ডুব দেয়। আর তখন প্রকৃতির বুকে একটু একটু করে ঘনিয়ে আসে শান্ত অনুগত নীল সন্ধ্যা। এই সন্ধ্যার অন্ধকারকে কবি কেশবতী কন্যার কেশের রূপকে প্রকাশ করেছেন। এই অন্ধকারের লাবণ্য কবির চোখে-মুখে ছুঁয়ে যায়। ভাসমান সেই অন্ধকার হিজল, কাঁঠাল ও জামের ডালে ডালে, পাতায় পাতায় দিয়ে যায় স্নেহ চুম্বন। পৃথিবীর কোথাও কবি রূপ ঐশ্বর্যে স্বতন্ত্র এমন সন্ধ্যা দেখেনি। এই অন্ধকারময় দৃশ্যের মধ্যে কবি খুঁজে পান মানবীয় ভালোবাসা-বেদনার স্পর্শ। এখানেই কবি টের পান নরম ধান, কলমি, হাঁসের পালক, শর, পুকুকের জল, ও চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ। কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাতের শীতলতার সঙ্গে মানবহৃদয়ের মমতা, ভালোবাসা ও উয়তার আঁচকে কবি সঞ্চারিত করেছেন। কিশোরের পায়ে দলা মুথা ঘাস ও খসে পড়া বটের পরিণতির মধ্যে দিগন্তের ক্লান্ত নীরবতা খুঁজে পান কবি। কবিতাটিতে কবি শুধু পাঠকের সামনে অনাস্বাদিত রূপলোক তৈরি করেনি বরং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গে মানুষের ভালোবাসা বিষাদ ও অনুরোগের আশ্চর্য বন্ধনকে উন্মোচিত করেছেন।
3. কবি জীবনানন্দের প্রকৃতি-মুগ্ধতার পরিচয় দিয়ে 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় কোন্ কোন্ গাছপালা এবং প্রাণীর উল্লেখ রয়েছে তা আলোচনা করো। ৫
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ একজন প্রকৃতিমুগ্ধ কবি। তাঁর নৈসর্গিক ভাবনা সম্প্রসারিত হয়েছে সন্ধ্যাতারা, আকাশ থেকে গাছপালা, ফল, ফুল, জল এমনকি পশুপাখি থেকে মানুষের জগতেও। আসলে তাঁর মনে হয়েছে জীবনের প্রেক্ষাপটেই প্রকৃতি পূর্ণতা পায়। জীবন না থাকলে অর্থহীন হয়ে যায় এই আকাশ, মাটি, তারা, নক্ষত্র, জলসহ সমস্ত প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ। তাই এ কবিতায় হয়তো কবির অজ্ঞাতসারেই উঠে এসেছে নানা গাছপালার নাম, - যেমন-কামরাঙা, হিজল, কাঁঠাল, জাম, বট। আমরা পেয়েছি কিছু -শস্য-গুল্ম বা শাকের নাম, যেমন-ধান, ঘাস, কলমি, শর ইত্যাদি। কয়েকটি প্রাণীর নামও উল্লেখ করেছেন কবি। যেমন মনিয়া (মৃত মনিয়ার মতো), চাঁদা-সরপুঁটি। সেই সঙ্গে কবিতায় 'কিশোর', 'কিশোরী'র উপস্থিতিও কবির প্রকৃতি-ভাবনাকে পূর্ণতা দিয়েছে। কবি যখন বলেন 'কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান' কিংবা উচ্চারণ করেন 'কিশোরের পায়ে-দলা মুথাঘাস তখন প্রকৃতি আর লোকজীবন একাকার হয়ে গিয়ে প্রকৃতিমুগ্ধ জীবনানন্দের প্রকৃতি-ভাবনার একটি কল্পরূপ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে।
4. 'কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো'- 'কামরাঙা লাল মেঘ' কোথায় ডুবে যায়? কবি লাল মেঘকে নীল সন্ধ্যায় বিলীয়মান হতে দেখে যে অসামান্য ছবি এঁকেছেন তার তাৎপর্য বুঝিয়ে দাও। অথবা, মেঘকে কবি 'মৃত মনিয়ার মতো' বলেছেন কেন? ৫
উত্তরঃ 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় কবি বলেছেন, পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়া পাখির মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে যায়।
কবি জীবনানন্দ দাশ ঘাসের ওপর বসে বাংলার সান্ধ্য সৌন্দর্যের মায়াময়তাকে লক্ষ করেছেন। অস্তমিত আলো যেন দিগন্তকে গাঢ় লাল আলোয় আলোড়িত করে। ভাসমান ঘন লালের প্রতিফলনে নানান আকারের মেঘ পাকা কামরাঙার বর্ণ ধারণ করে। এই অস্থির খন্ড খন্ড লাল মেঘের দলকে কবি তুলনা করেছেন ছটফটে মনিয়া পাখির সঙ্গে। মৃত মনিয়া যেমন জীবন থেকে মৃত্যুর মুখে খসে পড়ে, তেমনি এই কামরাঙা লাল মেঘেরাও সন্ধ্যার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় গঙ্গাসাগরের জলে। অর্থাৎ জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বকে ফুটিয়ে তুলতেই কবি জৈবনিক লালের বিপ্রতীপে রহস্যময় নীলের বিস্তারকে তীব্র করে তোলেন। মেঘ-ভাঙা রোদের আলোয় দেখা বর্ণময় মেঘের সৌন্দর্যও মৃত মনিয়ার মতো আসন্ন সন্ধ্যার ব্যাপ্তিতে গ্রস্ত হয়, শেষ হয়ে যায়। এভাবেই দৃশ্যগত ও অর্থগত সাদৃশ্যকে ব্যক্ত করতেই কবি মেঘকে 'মৃত মনিয়ার মতো' বলে অভিহিত করেছেন।
5. 'বাংলার নীল সন্ধ্যা কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে'- বাংলার নীল সন্ধ্যা প্রকৃতিগতভাবে কেমন বলে কবি মনে করেন? সন্ধ্যার সৌন্দর্য প্রসঙ্গে কেশবতী কন্যার - তুলনা কতটা তাৎপর্যবাহী তা কবিতা অনুসরণে লেখো। ১+৪ = ৫
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দের 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় গ্রাম-বাংলার বুকে ঘনায়মান নীল সন্ধ্যা প্রকৃতিগতভাবে শান্ত । ও অনুগত। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় , 'কেশবতী কন্যা' বলতে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারকে বুঝিয়েছেন। । 'কেশবতী কন্যা' কথাটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আলুলায়িত কেশদামবিশিষ্ট এক রূপসী কিশোরীর ছবি। তার ঘন কালো চুলের আচ্ছন্নতা সমস্ত দৃশ্যপট আড়াল করে। সেই কিশোরীর গাঢ় কালো চুলের মতো লাবণ্যময় আঁধার বঙ্গ-প্রকৃতির সর্বত্র সঞ্চারমান। সান্ধ্য অন্ধকারের নরম সজীব পেলবতা একমাত্র চুলের সঙ্গে তুলনীয় বলেই কবি এমন মন্তব্য করেছেন।
ঘন কালো চুলের মতো ঘনিয়ে আসা এই সন্ধ্যার তরল অথচ সর্বগ্রাসী পদসঞ্চার অমোঘ ও সর্বত্রগামী। দিগন্তজুড়ে অন্ধকারের এই নেমে আসাকে বোঝাতেই কবি 'আমার' শব্দটি দু-বার ব্যবহার করেছেন। 'আমার চোখের 'পরে' বলেও, আবার তিনি বললেন 'আমার মুখের 'পরে' অর্থাৎ তাঁর সমস্ত শরীরে অন্ধকার নামছে। অন্ধকারের এই চরাচরজোড়া ব্যাপ্তি বোঝাতেই কবি শব্দটিকে দু-বার ব্যবহার করেছেন। কবির মতে, সন্ধ্যার এই আঁধারময়। স্পর্শ যেন এই চুলের স্নেহ-চুম্বন ও স্নিগ্ধ গন্ধরূপে যেন কবির মুখের ওপরে, চোখের ওপরে এবং বঙ্গ-প্রকৃতির হিজল-কাঁঠাল জামের ওপরে অবিরত ঝরে পড়ে।
6. 'পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখে নি কো'-'এ কন্যা' বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? কবির এরূপ ভাবনার কারণ কী? অথবা, 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটির প্রথম অষ্টকে বা স্তবকে গ্রাম-বাংলার সন্ধ্যার যে ছবি ফুটে উঠেছে তা কবিতা অবলম্বনে লেখো।
উত্তরঃ জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় 'এ কন্যা' বলতে বাংলার বুকে ঘনিয়ে আসা নীল সন্ধ্যাকে বুঝিয়েছেন। সন্ধ্যার যে আঁধার প্রতিদিন প্রকৃতির বুকে নেমে আসে তার নৈসর্গিক সত্তাকে কবি তুলে ধরেছেন। অস্তগামী সূর্যের আলো পশ্চিম আকাশের মেঘকে কামরাঙার মতো লাল করে তোলে। -এই মেঘ ক্রমশ মৃত মনিয়ার দেহের বর্ণচ্ছটার মতো সমগ্র পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে পড়ে গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে শেষবারের নৈ মতো ডুব দেয়। এরপর আস্তে আস্তে আকাশ নদী প্রান্তর জুড়ে নেমে আসে কিশোরীর পেলব সজীব কেশদামের মতো সান্ধ্য অন্ধকারের লাবণ্য। হিজল-কাঁঠাল-জামের মতো গাছপালার ডালেডালে পাতায় পাতায় সেই অন্ধকার যেন তার এলোচুল মেলে দেয়, এবং অজস্র স্নেহচুম্বন করতে থাকে। এই অন্ধকার কবির চোখের পরে, তার মুখের পরেও ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। এরপরে অন্ধকারের বুক চিরে আকাশে ফুটে ওঠে এক একটি করে সাতটি তারা যা সন্ধ্যাকে আবাহন করে। তৈরি হয়। এক অনির্বচনীয় রূপলোক যা একমাত্র এই বাংলাতেই দেখা যায়। এমন সুনিবিড় সন্ধ্যা যার মধ্যে অনুভব করা যায় এক মানবীয় ভালোবাসা ও বেদনার ছোঁয়া তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। তাইতো কবি বলেছে 'পৃথিবীর কোনো পথে এ কন্যারে দেখেনি কো'।
7. 'কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান'-প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পঙ্ক্তিটির মূল ভাবটি বুঝিয়ে বলো।
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতি-মুগ্ধ কবি। তবে তাঁর সেই প্রকৃতি-মুগ্ধতা লৌকিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বাংলার প্রাণকে কবি তাই শুধু প্রকৃতির মধ্যে খুঁজে পাননি, লোকায়ত মানবজীবনের প্রেক্ষাপটেও তার অস্তিত্ব অনুভব করেছেন। আর এই প্রসঙ্গেই কবি পঙ্ক্তিটি ব্যবহার করেছেন। কবির মনে হয়েছে লোকজীবন সাহচর্যেই প্রকৃতির অন্তর্গত পূর্ণতা প্রকাশ পায়। তাই কিশোরীর চাল ধোয়ার দৃশ্যই তিনি শুধু দেখেননি, অনুভব করেছেন চালধোয়া ভিজে হাতটিকেও। কোনো প্রিয়জনের জন্য চালধোয়ার মতো তুচ্ছ ঘর-গেরস্থালির কাজেও কিশোরী-মনের যে মমতা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রকাশ পায়, 'শীত হাতখান' হৃদয়ের সেই দরদের চিহ্ন। সে হাত ভিজে হতে পারে, চাল ধোয়া জলে শীতলও হয়ে পড়ে, তবে শীতলতায় কোনো শীতার্ত অনুভূতি তার মধ্যে লক্ষ করা যায় না। বরং এই শীতলতার মধ্যে থাকে এক ধরনের মানসিক উন্নতা, যা শৈত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। ফলে 'শীত হাতখান' হৃদয়ের উত্তাপের আঁচ ছড়িয়ে দেয় মানুষের মনে। কবি জীবনানন্দ দাশ এইভাবে 'শীত' শব্দের আপাত শীতলতার আড়ালে মানবমনের আর্তি ও অনুরাগকেই অনন্য চিত্রকল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন।
8. 'ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা'- উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো। অথবা, 'এরই মাঝে বাংলার প্রাণ'- 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় গ্রাম-বাংলার প্রাণময়তার অনুভূতি কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা কবিতা অবলম্বনে ব্যাখ্যা করো। ৫
উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় ঘনায়মান সন্ধ্যার লাবণ্যময় আঁধারের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শময় নৈসর্গিক জগতে প্রাণময়তার স্পন্দন খুঁজে পেয়েছেন। বাংলার বুকে প্রতিদিন সন্ধ্যা নামে। সেই আবহমান সন্ধ্যার কোনো একটি দিনের দৃশ্যান্তরের মুহূর্ত কবির অন্তর্মনের যাদুস্পর্শে অনন্য রূপ ধারণ করেছে। সূর্য অস্তাচলগামী, তার গাঢ় লালের আলোড়নে মেঘের রং হয়েছে পাকা কামরাঙার মতো। গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে বিলীয়মান এই মেঘদলকে কবির মনে হয় মৃত মনিয়া পাখির মতো। ঠিক এই সময়ে সবার অলক্ষ্যে এক কিশোরী যেন তার নির্ভার কেশরাশি ছড়িয়ে দেয়। তার চুলের নরম-সজীব চুম্বনের স্পর্শে হিজল-কাঁঠাল-জামে ব্যাপৃত বাংলার দিগন্ত প্লাবিত হয়। মায়াময় আবছায়ায় মোড়া এমন প্রাণময় সন্ধ্যা আর কোথাও নেমে আসে না। নরম ধান, কলমি, হাঁসের -পালক, শর, পুকুরের জলে চাঁদা ও সরপুঁটিদের শরীরের মৃদু গন্ধে সন্ধ্যার আঁধার যেন পরিপূর্ণতা পায়। কবির মনে হয় রূপসীর চুলের স্নিগ্ধ গন্ধের মতো এই সান্ধ্য সুবাস। কিশোরের পদদলিত ঘাসে, কিশোরীর চালধোয়া ভিজে হাতের মমতা মাখা উষ্ণতায় এবং ছিন্ন লাল বটফলের ব্যথিত পরিণতির মধ্যে কবি দিনান্তের ক্লান্ত নীরবতাকে খুঁজে পান। বাংলার নিসর্গ প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান যেন দিনান্তের বেদনা-বিষণ্ণতাকে জীবনের প্রাণবন্ত অনুরাগে প্রকাশ করে।
9. 'আমি পাই টের'- উদ্ধৃতাংশটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কবির কোন্ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তরঃ জীবনানন্দ তাঁর 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতায় সন্ধ্যার সৌন্দর্যকে একদিকে মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। অপরদিকে বিভিন্ন গন্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলার প্রাণের স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন। এক কথায় কবির কাছে এই দুয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলার প্রাণের স্পন্দন ধরা পড়েছে। তাই কবি 'আমি টের পাই' উক্তিটি করেছেন।
জীবনানন্দের মতো কবিই বলতে পারেন 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর'। পশ্চিম দিগন্তে অস্তগামী সূর্যের প্রভায় আলোকিত কামরাঙার মতো লাল মেঘ ক্রমশ তার বর্ণচ্ছটায় মৃত মনিয়ায় মতো বিচিত্র রঙে দিগন্ত বিস্তৃত করে ডুব দেয় গঙ্গাসাগরে। তারপর প্রকৃতির বুকে নেমে আসে কেশবতী কন্যায় চুলের মতো অন্ধকার। যা চুমে যায় হিজ-কাঁঠাল-জামের শাখা-প্রশাখাকে। সেই অন্ধকার কবির চোখের, মুখের ওপরে ভেসে ওঠে। কবিকে স্পর্শ করে এক মানবিক অনুভূতি। নরমধানের, কলমির, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা-সরপুঁটির গন্ধ কবিকে পৌঁছে দেয় বাংলা মাটির কাছাকাছি। কিশোরীর ভিজে হাত যেন আন্তরিকতার উত্তাপ এনে দেয়। আর কিশোরের পায়ে দলা মুথা ঘাস ও বটফলের ব্যথিত গন্ধের মধ্যে দিয়ে কবি অনুভব করেন ক্লান্ত নীরবতা-যা কবিমনকে আলোড়িত করে। আর তখনই আকাশে ফুটে ওঠে সাতটি তারা। সেই নক্ষত্রের আলোর প্রতিফলনের মধ্যেই কবি যেন খুঁজে পান বাংলার মুখ, তার প্রাণের স্পন্দন।
No comments:
Post a Comment