1. 'ভাঙার গান' কবিতাটি কার লেখা?
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতাটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা।
2. কবিতাটি কবির কোন্ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে?
উত্তরঃ কবিতাটি কবির 'ভাঙার গান' নামক কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। *
3. 'কারার ওই লৌহ-কপাট' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ 'কারার ওই লৌহ কপাট' বলতে কবি পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসকের কারাগারের কথা বলেছেন।
4. কবি কী ভেঙে ফেলতে বলেছেন?
উত্তরঃ ভাঙার গান' কবিতায় কবি অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন।
5. কবি কারার লৌহকপাটকে কেন ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বলেছেন?
উত্তরঃ কবি দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের জন্য কবিতায় বিপ্লবী সন্তানদের কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে বাইরে আনার কথা বলেছেন।
6. কারার লৌহকপাট ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য কবি কাদের কীভাবে এগিয়ে আসতে বলেছেন?
উত্তরঃ কারার লৌহকপাট ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য কবি শিবের প্রলয়ংকার রূপ ধরে দেশের তরুণ সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন।
7. 'শিকল-পুজো' বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তরঃ শিকল-পুজো' বলতে শাসকের অত্যাচারে বিপ্লবীদের রক্তে রক্তাক্ত কারাগারকে বোঝানো হয়েছে, যা দেশমাতৃকার পূজার পাষাণ-বেদি।
8. 'পাষাণ-বেদী' বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তরঃ কবি নজরুল ইসলাম 'পাষাণ-বেদী' বলতে বন্দিশালাকে বুঝিয়েছেন।
9. 'ওরে ও তরুণ ঈশান'-'তরুণ ঈশান' কে? আর কোন্ অর্থে 'ঈশান' শব্দটির প্রয়োগ হয়?
উত্তরঃ 'তরুণ ঈশান' বলতে কবি শিবরূপী তরুণ প্রজন্ম অর্থাৎ বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। 'ঈশান' শব্দটির অন্য এক অর্থ হল উত্তর-পূর্ব কোণ।
10. 'বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ'-'প্রলয়-বিষাণ' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ 'বিষাণ' শব্দের অর্থ শিঙা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। এখানে কবি ধ্বংসের বার্তাবহ রণবাদ্যের নির্ঘোষ বোঝাতে প্রলয়-বিষাণ প্রয়োগ করেছেন।
11. 'উড়ুক প্রাচী'র প্রাচীর ভেদি-এখানে ব্যবহৃত 'প্রাচী' শব্দটির অর্থ লেখো।
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতায় ব্যবহৃত 'প্রাচী' শব্দটির অর্থ হল পূর্ব দিক বা পৃথিবীর পূর্বাঞ্চল।
12. 'উড়ুক প্রাচী'র প্রাচীর ভেদি'-বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ পুব আকাশের অন্তরাল বা আড়াল ভেদ করে তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের নতুন সৃজনী নিশানা প্রতিষ্ঠা করবে, কবিমনের এই বাসনাই উদ্ধৃতাংশে ধ্বনিত হয়েছে।
13. কবি 'প্রাচী'র প্রাচীর' ভেদ করে কী ওড়ার কথা বলেছেন?
উত্তরঃ কবি 'ভাঙার গান' কবিতায় তরুণ সম্প্রদায়কে 'প্রাচী'র প্রাচীর' ভেদ করে ধ্বংস নিশান ওড়ানোর কথা বলেছেন।
14. 'গাজনের বাজনা বাজা' 'গাজন' কী?
উত্তরঃ চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে শিব বা ধর্মঠাকুরকে কেন্দ্র করে যে উৎসব হয়, তা 'গাজন' নামে পরিচিত।
15. বুঝিয়েছেন? 'গাজনের বাজনা বাজা' বলতে কবি কী
উত্তরঃ চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবের গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে ভক্তরা ঢাক, ঢোল ইত্যাদির সমন্বয়ে গগনভেদী বোল তোলে। কবি উপমাটি ব্যবহার করে শাসককে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলার কথা বলেছেন।
16. কাদের বুঝিয়েছেন? 'কে মালিক? কে সে রাজা?' বলতে কবি
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতায় কবি সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসককুলকে মালিক ও রাজার প্রতিভূ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
17. কাকে সাজা দেওয়া যায় না?
উত্তরঃ কবি নজরুলের বিশ্বাস মুক্ত স্বাধীন সত্যকে সাজা দেওয়া যায় না।
18. কবির কেন হাসি পায়?
উত্তরঃ কবি তরুণ বিপ্লবীদের মৃত্যুঞ্জয়ী শিবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাই এই জীবন্ত শিবরূপী বিপ্লবীদের ফাঁসি বা মৃত্যুর কথা শুনে কবির হাসি পায়।
19. 'ভগবান পরবে ফাঁসি?'- 'ভগবান' বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে?
উত্তরঃ প্রদত্ত উদ্ধৃতাংশে 'ভগবান' বলতে কবি নজরুল ইসলাম স্বাধীনতাকামী আন্দোলনরত বন্দি তরুণদের কথা বলেছেন।
20. 'শিখায় এ হীন তথ্য কে রে?'- 'হীন তথ্য' বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তরঃ 'হীন তথ্য' বলতে কবি সত্যের অপলাপ বা বানানো মিথ্যার বেসাতি করার কথা বলেছেন।
21. 'শিখায় এ হীন তথ্য কে রে?'- 'হীন তথ্য' বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তরঃ মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণ বিপ্লবীদের ফাঁসি দেওয়া যায়, ইংরেজ শাসকের এই ভাবনাই হল 'ভাঙার গান' কবিতায় 'হীন তথ্য'।
22. 'পাগলা ভোলা' কে? কবিতায় কাকে 'পাগলা ভোলা' বলা হয়েছে?
উত্তরঃ পৌরাণিক চরিত্র 'মহাদেব'-কে পাগলা ভোলা বলা হয়। পাঠ্য কবিতায় কবি আত্মদানে তৎপর তরুণ সম্প্রদায়কে 'পাগলা ভোলা' বলে সম্বোধন করেছেন।
23. কবি কাকে প্রলয়-দোলা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন?
উত্তরঃ কবি নবযৌবনের অগ্রদূত তরুণ সম্প্রদায়-স্বরূপ পাগলা ভোলাকে প্রলয়-দোলা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
24. 'জোরসে-ধরে হেঁচকা টানে'- কারা কোথায় হ্যাঁচকা টান দেবে?
উত্তরঃ কবি নজরুল পাগলা ভোলা-স্বরূপ তরুণ প্রজন্মকে বন্দিশালার গারদ ধরে হ্যাঁচকা টান দিতে বলেছেন।
25. 'মার হাঁক হৈদরী হাঁক'- 'হৈদরী হাঁক' কী?
উত্তরঃ 'হৈদরী হাঁক' বলতে হজরত মহম্মদের ভ্রাতৃস্থানীয় হজরত আলির যুদ্ধক্ষেত্রে তেজোদৃপ্ত হুংকারকে বলা হয়েছে, যে কণ্ঠস্বর কবি পরাধীন ভারতের তরুণ সম্প্রদায়ের কণ্ঠে শুনতে উদ্গ্রীব।
26. 'দুন্দুভি' কী?
উত্তরঃ 'দুন্দুভি' হল প্রাচীন দামামা জাতীয় বৃহৎ ঢাক বিশেষ। 'ভাঙার গান' কবিতায় 'দুন্দুভি' রণবাদ্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
27. কাকে 'জীবন-পানে' ডাকার কথা কবি বলেছেন?
উত্তরঃ কবি নজরুল 'ভাঙার গান' কবিতায় মৃত্যুকে জীবন-পানে ডাকার কথা বলেছেন।
28. কবি কাদের মৃত্যুকে কীভাবে জীবন-পানে ডেকে আনতে বলেছেন?
উত্তরঃ কবি পরাধীন ভারতের মুক্তিকামী তরুণ প্রজন্মকে দাসত্বের শৃঙ্খলমোচনের জন্য যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছেন।
29. 'নাচে ওই কালবোশেখি'- বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতায় ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সমবেত ভারতবাসীর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সংগ্রামী অভ্যুত্থানকে কবি কালবৈশাখী ঝড়ের রুদ্র-রূপের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
30. 'নাচে ওই কালবোশেখি, /কাটাবি কাল বসে কি'-'কালবোশেখি' ও 'কাল বসে কি' কথা দুটির অর্থ লেখো।
উত্তরঃ 'কালবোশেখি' শব্দটির অর্থ হল বৈশাখী ঝড়, আর 'কাল বসে কি' শব্দবন্ধের অর্থ হল নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে বসে সময় অতিবাহিত করা।
31. 'কাটাবি কাল বসে কি?'—কীসের ইঙ্গিত?
উত্তরঃ দেশজুড়ে যখন ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ঢেউ উঠেছিল তখন নিষ্ক্রিয়ভাবে ঘরে বসে সময় অতিবাহিত না করার বার্তা দিতে কবির এই মন্তব্য।
32. 'ভীম কারার ওই ভিত্তি নাড়ি!'-এ কথার অর্থ কী?
উত্তরঃ পরাধীন ভারতে অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিশাল কারাগার বা জেলখানাকে ধ্বংস করে তাদের উৎখাত করার প্রসঙ্গে এ কথা বলেছেন।
33. 'লাথি মার ভাঙরে তালা'-কাকে কীসের তালা ভাঙতে বলেছেন?
উত্তরঃ কবি নজরুল ইসলাম 'ভাঙার গান' কবিতায় স্বাধীনতাকামী যুবসমাজকে বন্দিশালার তালা ভাঙতে বলেছেন।
34. 'ভাঙরে তালা'-এখানে কোন্ তালার কথা বলা হয়েছে?
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতায় অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের ভয়াবহ কারাগারের তালা ভেঙে ফেলার কথা বলা হয়েছে।
35. 'যত সব বন্দিশালায়'- এখানে কোন্ বন্দিশালার কথা বলা হয়েছে?
উত্তরঃ ইংরেজ শাসনাধীন ভারতের বন্দিশালাগুলিতে মুক্তিকামী বিপ্লবীদের বিনা বিচারে অবরুদ্ধ করে রাখা হত। এখানে সেই সমস্ত বন্দিশালার কথা কবি বলেছেন।
36. 'ফেল উপাড়ি'-কী উপড়ে ফেলতে হবে?
উত্তরঃ মুক্তিকামী তরুণ প্রজন্ম ইংরেজ শাসনাধীন ভারতের বন্দিশালাগুলিতে আগুন জ্বালিয়ে তার ভিত্তিভূমিকে উপড়ে = ফেলবে। এই হল কবির অভিপ্রায়।
37. 'ভাঙার গান' কবিতাটি কোন্ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত?
উত্তরঃ কবি নজরুল তাঁর 'ভাঙার গান' কবিতাটি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশব্যাপী উত্তাল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রচনা করেছিলেন।
38. 'ভাঙার গান' কাব্যগ্রন্থটি কাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছিল?
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কাব্যগ্রন্থটি কবি নজরুল ইসলাম স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রণী যোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ সমস্ত মেদিনীপুরবাসীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন।
39. কবি নজরুল তাঁর লেখায় বিদেশি শব্দ ব্যবহারে অত্যন্ত পটু ছিলেন। 'ভাঙার গান' কবিতা থেকে এমন দুটি বিদেশি শব্দের উদাহরণ দাও।
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতায় ব্যবহৃত দুটি বিদেশি শব্দ হল 'গারদ' এবং 'হৈদরী'।
❐ কমবেশি ৬০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও :
1. 'রক্ত-জমাট শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী? উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য লেখো।
উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশটি নজরুলের 'ভাঙার গান' কবিতার অংশ বিশেষ। পরাধীন ভারতের বিপ্লবকে স্তব্ধ করার অন্যতম হাতিয়ার হল কারাগার। স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষায় সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত বিপ্লবীদের ব্রিটিশ সরকার শিকল পরিয়ে কারাগারের অন্ধকারে নিক্ষেপ করত। রক্তাক্ত হত সেই বিপ্লবীরা। তাদের রক্ত জমাট বেঁধে থাকত কারাগারের পাষাণ বেদিতে। কারাগারের অন্তরালে দেশমাতৃকার উদ্দেশ্যে বিপ্লবীদের এই নীরব আত্মদানের ব্যথাকে কবি আরাধনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই কথাই ব্যক্ত করতে কবির এই উদ্ধৃতি।
2. 'ওরে ও তরুণ ঈশান!/বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ'-'তরুণ ঈশান' কী? 'বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ'-এর তাৎপর্য কী? ১+২ = ৩
উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশে 'তরুণ' শব্দটির অর্থ 'নবীন' আর 'ঈশান' শব্দটির অর্থ 'শিব'। এক্ষেত্রে কবি 'তরুণ ঈশান' বলতে কবি পরাধীন ভারতের তরুণ বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। কবির বিশ্বাস এরা শিবের মতো শক্তিধর এবং প্রলয়ংকর।
'বিষাণ' শব্দের অর্থ 'শিঙা' জাতীয় বাদ্যযন্ত্র যা সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা শিবের হাতে শোভা পায়। শিব অর্থাৎ নটরাজ প্রলয় সৃষ্টির কালে এই শিঙা বাজাতেন। কবি সেই অনুষঙ্গ ধরে পরাধীন ভারতের তরুণ বিপ্লবীদের ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রলয়রূপী তীব্র বিপ্লব গড়ে তুলতে 'প্রলয় বিষাণের' প্রসঙ্গ এনে তাদের উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন।
3. 'ধ্বংস-নিশান,/উড়ুক প্রাচী'র প্রাচীর ভেদি -'ধ্বংস-নিশান' কী? 'প্রাচী'র প্রাচীর ভেদি' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? ১+২ = ৩
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতায় রুদ্ররূপী নবীন প্রজন্মের প্রলয়ংকর ভাঙনের মহাযজ্ঞে উড্ডীন ধ্বংসের জয়ধ্বজাকে কবি 'ধ্বংস-নিশান' শব্দবন্ধের মাধ্যমে প্রতীকায়িত করেছেন।
দেশ পরাধীন। তাই দাসত্বের অন্তরালে যেন ভারতের পুব আকাশ আবৃত। প্রাচী শব্দটির অর্থ পূর্ব দিক। অর্থাৎ স্বাধীনতার ও মুক্তির বহু আকাঙ্ক্ষিত সূর্যোদয় ঘটে না। একমাত্র তারুণ্য-নির্ভর যুবশক্তিই দাসত্বকে ধ্বংস করে পুব আকাশে স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটাতে পারবে। আশাবাদী কবির এই ভাবনাই উদ্ধৃতাংশে ব্যক্ত হয়েছে।
4. 'গাজনের বাজনা বাজা'- 'গাজন' কী? কবি কেন গাজনের বাজনা বাজাতে বলেছেন? ২+১=৩
উত্তরঃ 'গাজন' বলতে আমরা চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে পালিত বাংলার লৌকিক উৎসবকে বুঝি। মূলত শিবঠাকুরকে কেন্দ্র করেই এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। গাজন উৎসবের সাথে গোঁড়া হিন্দুধর্মের আচার অনুষ্ঠানের কোনো যোগ নেই। সংস্কৃতে একে 'কালাক রুদ্র পূজা' বলে যার অর্থ কাল সদৃশ ভীষণ অর্ক বা সূর্যের পূজা। এই উৎসবে ঢাক-ঢোলের গগনভেদী বোল ওঠে। কবি এ কথা বলার মধ্যে দিয়ে পরাধীন ভারতের তরুণ বিপ্লবীদের কাছে বার্তা দিতে চেয়েছেন যে তারা যেন একাত্ম হয়ে গাজনের বাজনার মতো তীব্র বোল তুলে সংগ্রামী পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
5. 'কে মালিক? কে সে রাজা?/কে দেয় সাজা' -এখানে 'মালিক' ও 'রাজা' বলতে কবি কাদের বুঝিয়েছেন? কাকে সাজা দেওয়া যায় না? ২+১ = ৩
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতায় কবি 'মালিক' বলতে শাসক শাসকের অনুগত ধনিক শ্রেণি এবং 'রাজা' বলতে রাজতন্ত্রের ভপ্রতিভূ সাম্রাজ্যাবাদী ইংরেজ শাসককুলকে বুঝিয়েছেন।
বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে বিশ্বাসী নবীন প্রজন্মের দেশমাতার শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্ন ও বাসনা হল মানুষের মনের চিরকালীন মুক্ত। স্বাধীন সত্য। মানুষের হৃদয়ের এই মুক্তি ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার কখনো মৃত্যু হয় না। তাই কোনো মালিক বা রাজা তাকে সাজা বা শাস্তি দিতে পারে না।
6. 'কে দেয় সাজা/ মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?'-'মুক্ত স্বাধীন সত্য' বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? অ তাকে কে সাজা দিতে চায়? ২+১ = ৩
উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের দেশমাতৃকার পরাধীনতা মোচনের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে 'মুক্ত স্বাধীন সত্য' বলা হয়েছে। বিপ্লবীরা সত্যের উপাসক এবং ন্যায়ের বার্তাবাহক। মুক্তিকামী এই তরুণ প্রজন্মের বিশ্বাস, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। তাই দেশের মুক্তিই হল তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। 'মুক্ত স্বাধীন সত্য' বলতে কৃবি এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের ব্রিটিশ রাজশক্তি সাজা দিতে চায়।
7. 'হা হা হা পায় যে হাসি,'-কার হাসি পায়? হাসি পাওয়ার কারণ কী? ১+২ = ৩
উত্তরঃ চিরবিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর 'ভাঙার গান' কবিতায় নিজের হাসি পাওয়ার কথা বলেছেন। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার জন্য তরুণ বিপ্লবীদের সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে ব্রিটিশ শাসক বিপ্লবীদের ওপর নানান দমন-পীড়ন চালাতেন। কবির কথায় স্বাধীনতার স্বপ্নকে বুদ্ধ করা যায় না, কেননা বিপ্লবীর মৃত্যু হলেও বিপ্লবের মৃত্যু হয় না। তাঁর মতে, বিপ্লবীরা সত্য, ন্যায় ও মুক্তির সাধক বলে তারা মৃত্যুঞ্জয়ী ভগবানের অংশ। তাই এদের ফাঁসি দেওয়াটা শুধু অর্থহীন নয় হাস্যকরও বটে।
8. 'দে রে দে প্রলয়-দোলা'-কার উদ্দেশ্যে এ কথা বলা হয়েছে? তার কাছে কবি কী আবেদন করেছেন? ১ + ২ = ৩
উত্তরঃ কবি উদ্ধৃতাংশে 'পাগলা ভোলা' সম্বোধন করে পরাধীন ভারতের মুক্তিকামী তরুণ প্রজন্ম অর্থাৎ বিপ্লবীদের এ কথা বলেছেন। অত্যাচারী ব্রিটিশদের কারাগারে আবদ্ধ দেশের যুবশক্তিকে কবি কারাগারের লৌহ কপাট হেঁচকা টানে নিশ্চিহ্ন করতে বলেছেন। কেননা কবির বিশ্বাস এই তরুণরাই পারে রুদ্র রূপ ধরে স্থবির সৃষ্টির বুকে প্রলয় দোলার আঘাত আনতে। কবি এদের যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে, কণ্ঠে হায়দারী তেজ নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, কালবৈশাখীর ঝড়ের তাণ্ডবে বিশাল কারাগারের ভিত নড়িয়ে, বন্দিশালায় তালা লাথি মেরে ভেঙে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিতে বলেছেন।
9. 'মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!- উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ সাধারণভাবে মৃত্যুর দিকেই জীবন এগিয়ে চলে। কিন্তু 'ভাঙার গান' কবিতায় কবি জীবনের পথেই মৃত্যুকে আহ্বান করেছেন। তিনি পরাধীন ভারতবর্ষে তরুণ সম্প্রদায়কে ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে দেখেছেন। আত্মদানে উন্মুখ মুক্তিকামী এই নবীন প্রজন্ম জীবনকে ভালোবাসে বলেই, অত্যাচারী ইংরেজের দমন-পীড়নকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে মৃত্যুকেই প্রকারান্তরে আহ্বান করেছে। মৃত্যুঞ্জয়ী এই অগ্রপথিকদের আত্মোৎসর্গের অভিপ্রায়কে ফুটিয়ে তুলতেই কবি বলেছেন "মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে"।
10. 'নাচে ওই কালবোশেখি' ও 'কাটাবি কাল বসে কি' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ কালবৈশাখী ঝড় আচমকা সৃষ্টি হয়ে প্রকৃতির শান্ত-সমাহিত স্থিতাবস্থাকে এক লহমায় অস্থির ও অশান্ত করে তোলে। কবির চোখে ইংরেজ অপশাসনের অবসানের জন্য দেশবাসীর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংগ্রামী রুদ্র-রূপ এই বৈশাখী ঝড়ের মতোই প্রলয়ংকর। মুক্তিকামী মানুষের তীব্র সংঘর্ষের সর্বনাশী তাণ্ডবের ভয়াবহতাকে ফুটিয়ে তুলতেই কবি এরূপ। তুলনা টেনেছেন।
ইংরেজ বিতাড়নের সংকল্পে দেশব্যাপী সংগ্রামী তৎপরতা যখন তুঙ্গে, তখন ভাঙনের এই মহান কর্মযজ্ঞে শামিল না হয়ে যা ঘরে বসে সময় কাটানো বা কালক্ষেপ করা অনুচিত। এই বার্তা দিতেই 'কাটাবি কাল বসে কি?' পঙ্ক্তিটির অবতারণা।
11. 'ভীম কারার ওই ভিত্তি নাড়ি' – 'ভীম কারা’ কী? কীভাবে তার ভিত্তি নাড়ানো যাবে?
উত্তরঃ কবি 'ভাঙার গান' কবিতায় অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের ভয়াবহ বন্দিশালা এবং ব্যাপক অর্থে কারাগাররূপী সমগ্র পরাধীন ভারতকে দাসত্বে অবরুদ্ধ ভীম কারার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ইংরেজ অপশাসনের অবসানের জন্য কবি দেশের যুবশক্তিকে আহ্বান জানিয়েছেন। অকুতোভয় তারুণ্যই পারে এই লাঞ্ছনা ও দাসত্বের সমাপ্তি ঘটাতে। নবযৌবনের অগ্রদূত এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের দল এজন্য মৃত্যুকে বরণ করে নিতেও পিছপা হয় না। তাঁরাই আত্মদানের বিনিময়ে ইংরেজ শাসকের ভয়াবহ কারাগারের ভিত উপড়ে ফেলে ইংরেজ শাসনতন্ত্রকে চিরতরে উৎখাত করতে পারে।
12. 'যত সব বন্দিশালায়-/আগুন জ্বালা'-কবি কার উদ্দেশ্যে, এই কথা বলেছেন? বন্দিশালায় আগুন জ্বালাতে বলেছেন কেন? ১ + ২ = ৩
উত্তরঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলেছেন। স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে বহু স্বদেশপ্রেমিক মানুষ ব্রিটিশ কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
তাঁরা বন্দিশালার অন্ধকার কক্ষে অসম্ভব অত্যাচারে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হয়ে চলেছেন। অথচ দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার অপরাধে কাউকে বন্দি করা যায় না। তাই কবি তরুণ সম্প্রদায়কে ওই ব্রিটিশ কারাগারগুলিকে ভেঙে ফেলার কিংবা আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর ফলে বন্দিশালাগুলির ভিত্তিভূমিকে যেমন উপড়ে ফেলা যাবে, তেমনি ইংরেজ শাসনতন্ত্রের ভিতকেও চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা যাবে।
13. লৌহ কপাটের প্রতি কবির আক্রোশের কারণ কী?
উত্তরঃ কবি নজরুলের 'ভাঙার গান' কবিতায় লৌহ কপাট একদিকে যেমন কারাগারে বন্দি শত-সহস্র মুক্তিকামী তরুণের লাঞ্ছনা ও অবদমনের প্রতীক, অন্যদিকে তেমনি দেশমাতৃকার বন্দিত্বের ক্ষতচিহ্ন। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকের দাসত্বের হাত থেকে মুক্ত হতে পরাধীন ভারতবর্ষে অসংখ্য তরুণ-তরুণী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজশক্তি এই অপরাধে স্বাধীনতাকামী সেই নবীন প্রজন্মকে বিনা বিচারে বন্দি করে নির্মম অত্যাচার চালায়। দিনের পর দিন তাঁরা ব্রিটিশ কারাগারের অন্ধকার কোণে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হন। দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের এই পরিণতি দেখে বিক্ষুব্ধ কবিমন প্রলয়ংকর রুদ্র-রূপ ধারণ করে স্বদেশপ্রেমিক তরুণ প্রজন্মকে বন্দিশালার লৌহকপাট ভেঙে ফেলবার পরামর্শ দিয়েছেন।
❐ কমবেশি ১৫০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও :
1. 'ভাঙার গান' কবিতাটির নামকরণ কতটা যুক্তিসংগত হয়েছে বলে তুমি মনে করো লেখো। ৫
উত্তরঃ আমাদের পাঠ্য নজরুলের 'ভাঙার গান' কবিতাটি 'তাঁর 'ভাঙার গান' নামক মূল কাব্যগ্রন্থের অংশ। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের 'বাংলার কথা' পত্রিকার জন্য তাঁর স্ত্রী বাসন্তীদেবীর কথায় ও সুকুমার রঞ্জন দাশের অনুরোধে গানটি রচিত হয়। গানটিতে সক্রিয় বিপ্লবের পুথে ভারতের স্বাধীনতা লাভের কথাই ধ্বনিত হয়েছে। আর এই স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রয়োজন অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন। কবিতার প্রথম দুই চরণে কবি ভাঙার কথা বলেই শুরু করেছেন। তিনি তরুণ বিপ্লবীদের অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের কারাগারের লৌহ কপাট ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। আসলে চিরবিদ্রোহী নজরুল কারাগারের প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমস্ত ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ অত্যাচারের অবসানের জন্য এমন উক্তি করেছেন। আর এই ভাঙন একমাত্র ঘটাতে পারে দেশের তরুণ বিপ্লবীরা। কবি তাই তাদের মধ্যে অশুভ শক্তির ধ্বংস ও শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠার রূপকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তাদের 'তরুণ ঈশান', 'পাগলা ভোলা' রূপে সম্বোধন করেছেন। মহাদেব হলেন একই সঙ্গে সৃষ্টি ও সংহারের দেবতা, তাই কবি তাকে আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে হায়দারের বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠও শাসকের ভীতির কারণ হতে পারে ভেবে কবি আহ্বান জানিয়েছেন। আসলে দেশকে স্বাধীন করতে গেলে পরাধীনতার শৃঙ্খলকে ভাঙতে হবে আর সে-কথাই কবিতাটির বিভিন্ন ছত্রে ফুটে উঠেছে। তাই নামকরণটি যথাযথ ও সার্থক।
2. কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'ভাঙার গান' কবিতাটির মর্মার্থ নিজের ভাষায় লেখো। ৫
উত্তরঃ পরাধীন ভারতের তরুণ বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে কবির উদাত্ত আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে 'ভাঙার গান' কবিতাটিতে। অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কবিতাটি রচিত হলেও এবং অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থনকারী ব্যক্তিদের পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হলেও, কবিতাটিতে কিন্তু সক্রিয় বিপ্লবের পথে ভারতের স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা ধ্বনিত হয়েছে। ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করতে কবি তাঁর বিদ্রোহী কণ্ঠে ভাঙনের গান গেয়েছেন যা কবিতাটির ছত্রে ছত্রে অনুরণিত হয়ে সমগ্র ভারতবাসীর হৃদয়ে স্বাধীনতার অনুরণন জাগিয়েছে। তিনি বিপ্লবী বন্দিদের কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে লোপাট করার আহ্বান জানিয়েছেন। কবি এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দানকারী অগ্রপথিক হিসেবে 'তরুণ ঈশান', 'পাগলা ভোলা' অর্থাৎ সৃষ্টি ও সংহারের দেবতা মহাদেবের রূপকে দেশের তরুণ বিপ্লবীদের আহ্বান জানিয়েছেন। কবি তাদের বিপ্লবকে কখনো পরমসত্য, কখনো বা তাদেরকে মৃত্যুঞ্জয়ীর রূপকে সূচিত করে আসলে বিপ্লবের অবিনশ্বরতাকেই মান্যতা দিতে চেয়েছেন। কবি তরুণ বিপ্লবীদের 'পাগলা ভোলা' রূপে আহ্বান করে অত্যাচারের প্রতীক শাসকের গারদগুলোকে হেঁচকা টানে ভেঙে ফেলার বার্তা দিয়েছেন। কবি নবযৌবনের বার্তাবাহকদের 'হৈদরী কণ্ঠে' যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে বৃথা সময় অতিবাহিত না করে, মৃত্যুকে তুচ্ছ করে ব্রিটিশদের ভীষণাকার গারদের ভিত নাড়িয়ে, লাথি মেরে, আগুন জালিয়ে উপড়ে ফেলতে বলেছেন। আসলে তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্রে তরুণ বিপ্লবীদের দীক্ষিত হবার আহ্বান জানিয়েছেন।
3. 'কারার ওই লৌহ-কপাট/ভেঙে ফেল, কররে লোপাট'-'লৌহ-কপাট' শব্দটির অর্থ কী? লৌহ-কপাট ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়ে কবিমনের কোন্ বাসনা প্রকাশিত হয়েছে লেখো। ১+৪=৫
উত্তরঃ 'লৌহ-কপাট' শব্দটির অর্থ হল 'লোহার দরজা'। এখানে 'লৌহ-কপাট' ইংরেজ শাসকের বন্দিশালার লোহার দরজাকে চিহ্নিত করে।
রোমান্টিক ও স্বদেশপ্রেমিক নজরুল ছিলেন স্বভাব-বিদ্রোহী। ঔপনিবেশিক ইংরেজের দমন-পীড়নে ভীত না হয়ে, তিনি তাদের অপশাসনের হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেছেন। কবি শিকল পরেই শিকলকে বিকল করার পন্থায় আস্থাশীল। তাই পরাধীন দেশের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসকামী বুদ্র-নটরাজের আক্রমণাত্মক রূপ ধারণ করার আহ্বান জানান। দেশের তরুণ-নবীন-যুবাকে তিনি একাত্ম হয়ে গাজনের বাজনা বাজিয়ে এক সংঘর্ষময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে বলেন। কেননা নির্ভীক তারুণ্যই পারে নটরাজের প্রলয়-রূপ ধরে স্থবির সৃষ্টির বুকে সর্বনাশা আঘাত ক হানতে। কণ্ঠে হায়দারি হাঁক আর কাঁধের দুন্দুভির গগনভেদী কল ধ্বনিকে সম্বল করে এই পাগলা ভোলার দল অত্যাচারী ইংরেজ ত শাসককে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলুক। কবির মতে, বন্দিশালাগুলি স হল ব্রিটিশ রাষ্ট্রশক্তির অবিচার ও অহংকারের কেন্দ্রবিন্দু। তাই এ সেখানে যদি আঘাত করা যায়, রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ভেঙে ফেলা যায় তার সমস্ত তালা, আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে ত দেওয়া যায় ইংরেজ শাসনযন্ত্রের সমস্ত কলকবজায়, তাহলেই ন একমাত্র ভারতবর্ষের সামগ্রিক মুক্তি সম্ভব। এইজন্যই কবি কাজী নজরুল ইসলাম বন্দিশালার লৌহকপাট ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন।
এসেছে। শত শত ভারতবাসীর স্বাধীনতার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে তাদের কারাগারের অন্ধকারে নিক্ষেপ করে ব্রিটিশরা নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসক বুঝতে পারেনি যে, বিপ্লবী বা মুক্তিকামী মানুষের মৃত্যু হলেও বিপ্লবের ও মুক্তির আদর্শের মৃত্যু নেই। তাই কবি অত্যাচারী ব্রিটিশ শক্তিকে এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, মানুষকে সাজা দিয়ে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে বিপ্লবকে শেষ করা যায় না। স্বাধীনতা ও বিপ্লবের আগুনকে অনুভব করে, ইংরেজ শাসকের অবস্থার - কথা ভেবে কবির হাসি পেয়েছে ও মনে করুণার উদ্রেক হয়েছে।
4. 'মার হাঁক হৈদরী হাঁক, / কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক, / ডাক ওরে ডাক মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!' - 'হৈদরী হাঁক' এবং 'দুন্দুভি ঢাক'-এর প্রসঙ্গ এসেছে কেন? মৃত্যুকে জীবনপানে ডাকার তাৎপর্য কী ২+৩=৫
উত্তরঃ বিদ্রোহী কবি নজরুল দেশমাতৃকার দাসত্ব ও শৃঙ্খল মোচনের জন্য 'ভাঙার গান' কবিতায় ভাঙনের জয়গান গেয়েছেন। এই ব্যাপারে কবি সবচেয়ে আস্থা রেখেছেন দেশের নবীন প্রজন্ম অর্থাৎ তরুণ বিপ্লবীদের ওপর। কবিতার প্রথম দিকে কবি এই তরুণ বিপ্লবীদের 'তরুণ ঈশান' ও 'পাগলা ভোলা' রূপে সম্বোধন করে তাঁর সৃষ্টি ও সংহার রূপের সাহায্যে ব্রিটিশ রাজশক্তির অত্যাচারের প্রতীক কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে ফেলতে, কখনো-বা গারদগুলো হেঁচকা টানে ধ্বংস করতে আহ্বান জানিয়েছেন। ঠিক একইভাবে কবি হিন্দু-মুসলমানের ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাম্প্রদায়িক বাতাবরণকে দূরে সরিয়ে সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টির জন্য চতুর্থ খলিফা হায়দার আলির তেজোদৃপ্ত কণ্ঠস্বরের অবতারণা করেছেন। দুন্দুভি ঢাকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে কবি যুবশক্তিকে যুদ্ধের দামামা বাজাতে আহ্বান জানিয়েছেন। শাসকের কারাগার ভেঙে লোপাট করতে হবে শিকলপূজার পাষাণবেদি। এই যুদ্ধবাদ্যের গগনভেদী ধ্বনি তারই সূচক।
প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। কেউ মৃত্যুকে জীবনের দিকে ডাকে না। কিন্তু এই কবিতায় কবি জীবনের পথেই মৃত্যুকে আহ্বান জানিয়েছেন। তরুণ বিপ্লবীরা দেশের মুক্তির জন্য আত্মদানে উন্মুখ। তারা অত্যাচারীর দমন-পীড়নকে তুচ্ছ জ্ঞান করে স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে মৃত্যুকে প্রকারান্তরে আহ্বান করেছেন। আর তাদের আত্মোৎসর্গের অভিপ্রায়কে ফুটিয়ে তুলতেই কবি এরকম উক্তি করেছেন।
5. 'দেরে দেখি-ভীম কারার ওই ভিত্তি নাড়ি'-কারাকে 'ভীম কারা' বলবার কারণ কী? কবি কীভাবে তার ভিত্তিকে নেড়ে দিতে বলেছেন? ২ + ৩ = ৫
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতা থেকে প্রদত্ত উদ্ধৃতাংশে 'ভীম -কারা' শব্দটিকে কবি কারাগারের ভয়াবহতা বোঝাতে ব্যবহার করেছেন। ইংরেজ-শাসিত ভারতের বন্দিশালাগুলোয় মুক্তিকামী বিপ্লবীদের বিনা বিচারে আটকে রেখে নৃশংস অত্যাচার করা হত।
এ কারণেই কারাগারগুলিকে কবি 'ভীম কারা' আখ্যা দিয়েছেন। আর এ ছাড়াও কারাগাররূপী সমগ্র দেশকেও কবি দাসত্বে অবরুদ্ধ 'ভীম কারা'-র সঙ্গেও তুলনা করেছেন। বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে বিশ্বাসী কবি নজরুল তরুণ প্রজন্মকে কারাগারের ভিত্তিভূমি উপড়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। এই নতুন প্রজন্মকে তিনি 'ঈশান' ও 'পাগলা ভোলা' বলে সম্বোধন করে নটরাজের সর্বনাশা প্রলয়ংকর রূপ ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি চেয়েছেন সর্বত্যাগী যুবশক্তি হায়দারি হাঁক দিয়ে, দুন্দুভি ঢাক বাজিয়ে দেশের জনগণকে উদ্দীপ্ত করবে। তাঁদের সমবেত আগ্রাসন অত্যাচারী ইংরেজ শাসককে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তুলবে। সমগ্র দেশবাসীর সক্রিয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংঘর্ষময় ভয়াবহতা বৈশাখী ঝড়ের মতো ইংরেজ শাসনতন্ত্রের উপর এক লহমায় আছড়ে পড়ে তাকে উৎখাত করবে। তিনি জানেন এই পথ মৃত্যুময়, তাই মৃত্যুকে 'জীবনপানে' বরণ করে নেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যান। কেননা মৃত্যুঞ্জয়ীর এই মৃত্যু জীবনের বিনাশ ঘটায় না, বরং জীবনকে বিকশিত করে। তাঁদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে 'শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী' যেমন নিশ্চিহ্ন হয় তেমনই ইংরেজ রাজশক্তির কারাগারের চক্রব্যূহের ভিত্তিভূমিকেও তা উৎপাটিত করে। আলোচ্য কবিতায় কবি এভাবেই 'ভীম কারা' নাড়িয়ে উৎখাত করার কথা বলেছেন।
6. যত সব বন্দিশালায়-/আগুন জ্বালা/আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি!' -'ভাঙার গান' কবিতা অবলম্বনে কবি নজরুলের বিদ্রোহী মানসিকতার যে প্রকাশ দেখতে পাও, তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো। ৫
উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম। 'ভাঙার গান' কবিতার ছত্রে ছত্রে সেই রণক্লান্ত বিদ্রোহী কবির উদাত্ত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের অত্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে কবি সৃষ্টি ও সংহারের দেবতা রূপে দেশের নবীন প্রজন্মকে প্রতীকায়িত করেছেন। দেশমাতাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে এসে বিপ্লবীরা আজ কারাবন্দি। ব্রিটিশ শক্তি কারাগারের অন্তরালে এইসব বন্দিদের ওপর চালায় সীমাহীন অত্যাচার। রক্তাক্ত হয় তারা। তাদের রক্ত জমাট বেঁধে থাকে বন্দিশালার পাষাণ বেদিতে। কবি তরুণ ঈশানরূপী যুবশক্তিকে ধ্বংসের সূচনাকারী শিঙা বাজিয়ে বন্দিশালাকে ধ্বংস করে বিনাশের নিশান ওড়াতে বলেছেন। কবির দৃষ্টিতে এই পাগলা ভোলার রূপকে রূপায়িত তরুণ বিপ্লবীরা প্রলয় দোলায় বন্দিশালার গারদগুলো উপড়ে ফেলবে। কণ্ঠের তেজোদৃপ্ত হায়দারি হাঁক এবং যুদ্ধের দামামার গগনভেদী শব্দ শাসককে ভীত-সন্ত্রস্ত্র করে তুলবে। কালবৈশাখী স্বরূপ তাদের বিপ্লবের ঝড়ে ইংরেজ রাজশক্তির প্রতীক ভীমকারার ভিত্তিভূমিতে কাঁপন ধরবে। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও তারা তাকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হবে। কবি অত্যাচারের প্রতীকস্বরূপ বন্দিশালাগুলিকে লাথি মেরে ভেঙে ফেলতে এবং আগুন জ্বালাতে বলেছেন। 'ভাঙার গান' কবিতায় বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে সহজেই ধরা পড়ে নজরুলের বিদ্রোহী মানসিকতা।
7. 'ভাঙার গান' কবিতায় কবি কোন্ দুটি পৌরাণিক নামে দেশের তারুণ্যকে আহ্বান করেছেন? কবির ওইরূপ সম্বোধনের কারণ কী বলে তোমার মনে হয়? ২+৩=৫ অথবা, 'তরুণ ঈশান' এবং 'পাগলা ভোলা'-র পৌরাণিক প্রসঙ্গ উত্থাপন করে 'ভাঙার গান' কবিতায় কবি কী ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, কবিতা অবলম্বনে আলোচনা করো। ৫
উত্তরঃ 'ভাঙার গান' কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মহাদেবের দুটি নামে পরাধীন দেশের তরুণ প্রজন্মকে সম্বোধন করেছেন। নাম দুটি হল 'ঈশান' ও 'ভোলা'। পঙ্ক্তি দুটি হল 'ওরে ও তরুণ ঈশান' এবং 'ওরে ও পাগলা ভোলা'।
হিন্দুরা 'ঈশান' এবং 'ভোলা' এই দুটি শব্দেই দেবাদিদেব মহাদেবকে বুঝে থাকেন। মহাদেব একই সঙ্গে ধ্বংস ও সৃষ্টির দেবতা, অশুভকে নাশ করে নতুন বিশ্বকে জন্ম দেন তিনি। তাই তিনি প্রলয়ের দেবতা। তাঁর নৃত্যের মধ্য দিয়ে যুগান্তরের বার্তা এসে পৌঁছায় মানুষের মনে। সেই যুগান্তরের বার্তাই নজরুল-ইসলাম দিতে চেয়েছেন এই নাম দুটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। তিনি দেখেছেন, ইংরেজের অত্যাচারে অসহায় ভারতবাসীকে। এই অবস্থা থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করতে গেলে প্রয়োজন সশস্ত্র বিপ্লব। আর সে বিপ্লব সংঘটিত করতে গেলে মহাদেবের মতো যৌবন-উদ্দাম প্রাণশক্তিময় তারুণ্যের প্রয়োজন। সেই তারুণ্যকেই কবি তাই বারবার আহ্বান করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, এরাই মহাদেবের মতো বিধ্বংসী রূপ নিয়ে ইংরেজ রাজশক্তির অশুভ কারাগারে আঘাত হানতে পারবে। এরাই পারবে নতুন ভারতবর্ষ রচনা করতে। এই বিষয়টিকে বোঝাতেই কবি মহাদেবের পৌরাণিক কাহিনিকে আধুনিক প্রেক্ষিতে ব্যবহার করে কখনও 'ঈশান' নামে কিংবা কখনও 'পাগলা ভোলা' নামে নবযৌবনের অগ্রদূত হিসেবে নবীন প্রজন্মকে আহ্বান করেছেন।
8. 'ভাঙার গান' কবিতায় কবির মধ্যে সমসাময়িকতা এবং স্বাদেশিকতা বোধের যে প্রকাশ ঘটেছে, তার পরিচয় দাও। ৫
উত্তরঃ সমসাময়িকতার অভিঘাত কবি নজরুলের কবিতার সম্পদ। পাঠ্য 'ভাঙার গান' কবিতাটিও এর ব্যতিক্রম নয়। এই গান বা কবিতাটি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ গ্রেফতার হওয়ায় সে-সময় তাঁর স্ত্রী পত্রিকার কার্যভার গ্রহণ করেন। মূলত তাঁরই অনুরোধে 'ভাঙার গান' লেখেন নজরুল।
মুক্তিকামী মানুষের ওপর ইংরেজ অপশাসনের দমন-পীড়ন চরমে পৌঁছেছিল। কবি তাই নবীন প্রজন্মকে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি তাঁদের মহাদেবের প্রলয়ংকর রুদ্ররূপ ধারণ করে শাসকের বন্দিশালার লৌহকপাট ভেঙে ফেলার জ জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, তারুণ্য সর্বদাই সত্য স্বভাব ও ন্যায়ের পুজারি, মুক্ত-স্বাধীন সত্যের সাধক ও প্রচারক। তাই দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের জন্য তাঁরা আত্মোৎসর্গ করতেও পিছপা হন না। এই যুবশক্তিই পারে বৈশাখী ঝড়ের মতো বিধ্বংসী রূপ ধরে ইংরেজ শাসনতন্ত্রের ভিত্তিভূমিকে উৎপাটিত করতে। তিনি চেয়েছেন সর্বগ্রাসী আগুনে সমস্ত বন্দিশালাগুলিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে বিপ্লবীদের মুক্তি দিতে। একইসঙ্গে দাসত্বে অবরুদ্ধ কারাগাররূপী দেশকে কবি ধ্বংসের আগুনে পুড়িয়ে স্বাধীনতার বিশুদ্ধতায় উন্নীত করতে চেয়েছেন আর এই কাজের অগ্রপথিক হিসেবে তরুণ-যুবাদের অন্তরের আহ্বান গান শুনিয়েছেন। এভাবেই কবি নজরুলের স্বদেশপ্রেম মূর্ত হয়ে উঠেছে।
No comments:
Post a Comment